কমিটির দুঃশাসন কি শুধুই ভিকারুননিসায়?
মো. রহমত উল্লাহ্
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ফোনালাপকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার (মুকুল) ও অভিভাবক ফোরামের নেতা মীর সাহাবুদ্দিন টিপুর কথোপকথনের অংশ বলে দাবি করা হচ্ছে। ওই ফোনালাপে অধ্যক্ষকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হুমকি দিতে শোনা যায়। ফোনালাপের এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলেন, ‘আমি কিন্তু বালিশের নিচে পিস্তল রেখে ঘুমাতাম। কোনো ... বাচ্চা যদি আমার পেছনে লাগে আমি কিন্তু ওর পেছনে লাগব, আমি শুধু ভিকারুননিসা না আমি তাকে দেশছাড়া করব।’
এমন আরও কিছু বক্তব্য রয়েছে যা প্রকাশ যোগ্য নয়। তবে অধ্যক্ষ কামরুন নাহার বলছেন, ফাঁস হওয়া ওই ফোনালাপটি ‘এডিট করা’। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত সাত মাস আগে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক আমি এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করার পর থেকে অভিভাবক ফোরামের কয়েকজন দলবল নিয়ে এসে অনৈতিক সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব দিয়ে আসছে। তাদের কথা না শুনলে আমি এখানে থাকতে পারবো না বলে হুমকি দেয়া হয়। দুইবার আমার অফিস রুমে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। রুমে প্রবেশ করে টেবিল চাপড়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এমনকি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে। তাতে আমি গুরুত্ব না দিয়ে নিয়মের মধ্যে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছি। এ বছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির লটারির সময়ও ১২০ সিট খালি রয়েছে।
এছাড়া কিছু শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। সবমিলিয়ে প্রায় ১৫০-৬০ সিট খালি আছে। মূলত সেগুলোতে অবৈধ ভর্তি বাণিজ্য করতে অভিভাবক প্রতিনিধিরা আমাকে অনেক আগে থেকে চাপ দিচ্ছে। আমি তাদের কথা না শোনাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সুবিধাবাদি কিছু অভিভাবকদের নিয়ে আমাকে চেয়ার থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। যোগদানের দিনেও তারা আমাকে অফিস কক্ষে প্রবেশ করতে দেয়নি। পরে মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দায়িত্বে বসি।
সম্প্রতি একাদশ শ্রেণিতে একজনকে ভর্তির জন্য অভিভাবক মীর সাহাবুদ্দিন টিপু আমাকে চাপ দিয়ে আসছিলেন। তার কাজ করে না দেয়ায় আমার সঙ্গে তার ফোনালাপ এডিট করে যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়া হয়েছে।’ এ বিষয়ে মীর সাহাবুদ্দিন টিপু বলেন, ‘অধ্যক্ষ আমার পূর্ব পরিচিত। এজন্য মাঝে মাঝে তার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো। গত শুক্রবার (২৩ জুলাই ২০২১) শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের বিষয়ে তাকে আমি ফোন করি। এ সময় তিনি অভিভাবক প্রতিনিধি ও সাধারণ অভিভাবকদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।’
ফোনালাপের সেই অশোভন ভাষাকে অধ্যক্ষের ভাষা ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ফোনালাপটি সত্য হলে অবশ্যই তা নিন্দনীয়! অধ্যক্ষের সঙ্গে কমিটির সদস্যদের বিরোধ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরইমধ্যে অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়েও কথা বলেছেন কেউ কেউ। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির আহ্বায়ক ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, 'ভিকারুননিসার অধ্যক্ষের পাশে আছি। ফোনে কথা বলা এটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিষয়৷ যদিও বিষয়টি আমি এখনো ক্লিয়ার না। তবুও এসব প্রকাশ করা আইসিটি আইনের লঙ্ঘন৷ ভাসা ভাসা তদন্ত করলে হবে না৷ সমস্যার মূল জায়গাটা খুঁজে সমাধান করতে হবে৷ সেখানে যে ধরনের অনিয়ম দুর্নীতি হয় সেগুলো সামনে আসুক। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতে শতভাগ স্বচ্ছতার মাধ্যমে ভর্তি করানো হয়৷
রাজধানীর দু-তিনটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন প্রতিবার সংবাদের শিরোনাম হবে! ভর্তি নিয়ে সমস্যা কেন থাকবে! ভিকারুননিসা একটা নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেখানে ভর্তির বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা তেমন একটা কঠিন কাজ নয়৷ আমরা চাই সরকার একটা কঠিন অবস্থানে যাক৷ একটা ভালো প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে যাক সেটা আমরা কেউই চাই না৷ ওটা একটা মেয়েদের স্কুল। গভর্নিং বডি কেন ফুল টাইম অফিস করবে, তাদের জন্য কেন আলাদা অফিস থাকবে। এটা শিক্ষকদের জন্য একটা মানসিক চাপ৷’
সরকারি আশিক মাহমুদ কলেজের অধ্যক্ষ মোজাহিদ বিল্লাহ্ ফারুকী তার ফেসবুক পেজে লিখেছেন, 'অদ্ভুত এক আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সময়-প্রতিবেশে বাস করছি আমরা। যেখানে সৎ-চিন্তা, সদুদ্দেশ্য, সৎ-প্রতিবাদ কিংবা সৎ-প্রতিরোধ উপহাসের বিষয় হয় অতিদুষ্ট, অতিস্বার্থান্ধ প্রতিপক্ষের ক্রমাগত উস্কানিতে, প্রবল মানসিক নির্যাতনে একমুহূর্তের জন্য ধৈর্য হারিয়ে দুএকটি বেফাঁস শব্দ (গালি) উচ্চারণ করার কারণে! (রেকর্ড এডিট করার অভিযোগ আছে)।
পূতিগন্ধময় সমাজ-প্রতিবেশেও আমরা চাই আমাদের প্রতিটি শিক্ষক হবেন নিষ্কলঙ্ক ফেরেশতা! অথচ শিক্ষককে শিক্ষক হয়ে উঠার জন্য আদর্শ কোনো পরিবেশ আমরা দিতে চাই না। প্রশাসনিক শিক্ষকের কর্মপরিবেশ সবচেয়ে অনিরাপদ, ভীতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ! নিরাপত্তাহীনতা এবং শিক্ষা-পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা পালনে অক্ষমতা শিক্ষকতা পেশাকেই আজকাল অমর্যাদাকর পেশায় পরিণত করেছে। স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হয় বাইরের ফ্যাক্টরের দিকে। তাদের সহযোগিতা বা সহায়তা ছাড়া শিক্ষা প্রশাসক অক্ষম, অসহায়—ক্ষেত্রবিশেষে চরম লাঞ্ছনার শিকার হন। কথাগুলো হয়তো স্বল্প কিছুসংখ্যক ভাগ্যবানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আর্থিক কারণে (স্কুলের জন্য ৬০ কোটি টাকার ধানমন্ডির জমি ক্রয়) ও ভর্তি বাণিজ্যের সুযোগ লাভের জন্য পরিচালনা কমিটির কিছু সদস্য ও অভিভাবক ফোরাম অধ্যক্ষের উপর কতটা চাপ তৈরি করেছে তা এখন স্পষ্ট। তাই উত্তেজিত মুখের গালিটাকে মুখ্য না করে পেছনের ঘটনাকে মুখ্য করলে জানা যাবে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের প্রকৃত অবস্থা। তখন হয়তো দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো অধ্যক্ষকে দুটো সস্নেহ গালি দিয়েও মাফ করে দিতে ইচ্ছে করবে আপনার।'
বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন এর সভাপতি অধ্যক্ষ আবুল বাশার হাওলাদার নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, 'ভিকারুননিসার অধ্যক্ষকে ধন্যবাদ। যখন সারাদেশে শিক্ষকসমাজ দুর্নীতিবাজ পরিচালনা পরিষদের কাছে অসহায়, নির্যাতিত ঠিক সেই সময় গর্জে উঠেছে শিক্ষকের কণ্ঠস্বর। সব শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ হউন। প্রতিবাদ ও ক্ষোভের ভাষা কখনো মধুর হয় না। ঠিক আছে, অশালীন বলে থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে কেন এমন হলো, পেছনের ঘটনা জানুন - এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
উল্লিখিত দুটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের বক্তব্যে একটা বিষয় আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি গুলোকে শিক্ষার জন্য এখন আর কল্যাণকর মনে করেন না প্রায় শতভাগ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সচেতন মহল। তারা মনে করেন বেশিরভাগ কমিটি হচ্ছে রাহু। কমিটি নামক এই রাহুর কবলে পড়ে আজ অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রধান এবং শিক্ষকগণ অতিষ্ঠ। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা আজ নিম্নমুখী। ভালো শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান মুখী। যা প্রকাশ করার সাহস ও সুযোগ থাকে না বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের। ভিকারুন্নেসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ সরকারি শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা বলে এবং সৎসাহস আছে বলে সামান্য প্রকাশ করতে পেরেছেন, করেছেন। কেননা ওনার চাকরি হারাবার ভয় নেই। ওনার পক্ষে সরকারিরা আছেন, থাকবেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য বেসরকারিরাও থাকবেন। বড়জোর তিনি বদলি হবেন। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত কমিটির অশিক্ষিত/ অর্ধশিক্ষিত দলীয় লোকদের মন মতো কাজকর্ম না করলে তারা প্রতিদিনই প্রতিষ্ঠান প্রধান ও শিক্ষকদের চাকরি খান দুই তিন বেলা। সব কমিটির সব লোকই যে এমন মন্দ তা নয়। তবে ভালর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য এবং ভালরা খুবই কর্নাড। আমি নিজের প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি না, সারাদেশের কথা বলছি।
এমন একসময় ছিল, যখন কমিটির লোকজন আসলেই শিক্ষা অনুরাগী ছিলেন। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করতেন, নিজেরা জমি দিতেন, টাকা দিতেন, শিক্ষকদের বেতন দিতেন, ঘর তৈরি করে দিতেন, আসবাবপত্র দিতেন, শিক্ষাসামগ্রী দিতেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিতেন এবং আরো অনেক রকম সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তারপর এমন একসময় গেছে, যখন কমিটির লোকেরা নিজেদের অযোগ্য সন্তানদের বা টাকা খেয়ে অন্যের অযোগ্য সন্তানদের অথবা দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক বানাতো। সেই অযোগ্যদের কারণেই আজ যোগ্য শিক্ষকের বড় অভাব এই দেশে।
এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। কমিটির নিকট থেকে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে এনটিআরসিএকে দিয়ে রাষ্ট্রই স্বীকার করে নিয়েছে যে, কমিটি শিক্ষক নিয়োগে চরম অনিয়ম করত। তবু্ও বর্তমানে কমিটির হাতে অবশিষ্ট আছে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কর্মচারী নিয়োগের এবং চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা। বাস্তবে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তেমন কোনো কাজকর্ম বর্তমানে কমিটির লোকজন খুব একটা করে না। কিছু করলেও এর পিছনে তাদের অধিক স্বার্থ জড়িত থাকে। তাই অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, কমিটির লোকদের কাজ কী? কমিটি থাকার দরকার কী?
বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকার শতভাগ বেতন দেয়। সাধ্যমতো ভাতা দেয়। প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো তৈরি করে দেয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়। বিনামূল্যে বই দেয়। শিক্ষাসামগ্রী দেয়। ভর্তি হয় অনলাইনে। ভর্তি ফি নির্ধারণ করে সরকার। টিউশন ফি নির্ধারণ করে সরকার। স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে সরকার। আর শিক্ষার মান যাচাই করার জন্য, শিক্ষকদের কাজ তদারক করার জন্য প্রতি থানায়/উপজেলায় রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, সহকারী অফিসার ও পরিদর্শক। সরকারের পক্ষে তারাইতো পারে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দিক দেখবাল করতে। এ ছাড়াও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কার্যবিবরণী অনলাইনের মাধ্যমে জমা নেওয়া যায় মন্রণালয়ে। ডায়নামিক ওয়েব ও অন্যান্য এপ্লিকেশনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও একাডেমিক কাজের স্বচ্ছতা। তাহলে এখন আর কেন প্রয়োজন এই পরিচালনা কমিটি?
কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত নিজেদের মালিক আর শিক্ষকদের গোলাম ভেবে অহেতুক দাবড়ানো ছাড়া কমিটির আর কাজ কী এখন? কমিটির অনেকেই মনে করেন, প্রতিষ্ঠানের টাকা মানেই তাদের টাকা। সত্য/মিথ্যা যাই হোক এমনও শোনা যায় যে, কোন কোন কমিটির কেউ কেউ সারাদিন প্রতিষ্ঠানেই খায়-থাকে, প্রতিষ্ঠানের মাঠ ভাড়া দেয়, গরুর হাট বসায়, হল/ঘর ভাড়া দেয়, নিজেরা অনুষ্ঠান করে, পুকুরের মাছ নেয়, খামারের ফসল নেয়, গাছের ফল নেয়, দোকানের ভাড়া নেয়, জমির দখল নেয়, গাছপালা কেটে নেয়, ফ্যান-লাইট নিয়ে নেয়, ইটা-বালি-সিমেন্ট নেয়, ঠিকাদারি কাজ নেয়, সাপ্লাই কাজ নেয়, ছাপা কাজ নেয়, ড্রেস সাপ্লাই দেয়, টিফিন সাপ্লাই দেয়, খাতাপত্র সাপ্লাই দেয়, স্টেশনারি সাপ্লাই দেয়, ইন্টারনেট ভাড়া দেয়, ওয়েবসাইট বিক্রি দেয়, সফটওয়্যার ভাড়া দেয়, ভর্তি দিয়ে টাকা নেয়, বই পাঠ্য করে টাকা নেয়, ফ্রি-হাফফ্রি করে দেয়, ফরম পূরণের তালিকা দেয়, নিয়োগ দিয়ে টাকা নেয়, মিটিং করার টাকা নেয়, শিক্ষকদের ডিউটির টাকার ভাগ নেয়, নিজেদের কাজে প্রতিষ্ঠানের গাড়ি নেয়, প্রতিষ্ঠানের আয়া-পিয়ন বাসায় নেয়, ফেল/বখাটে শিক্ষার্থীর পক্ষ নেয়, নিজের পছন্দের শিক্ষকদের ইংরেজি/অঙ্ক ক্লাস দেয়, ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনেই শিক্ষকের ভুল ধরার নামে বকাবকি দেয়, কথায় কথায় শোকজ দেয়, নিজেদের সন্তানদের বিনা টাকায় প্রতিষ্ঠানে এমনকি প্রাইভেটেও পড়াতে বাধ্য করে। অবস্থা ও অবস্থান ভেদে আরও কত কী যে করে তা বলে শেষ করার মতো নয়। এসবের আংশিক সত্য হলেও তা অত্যন্ত অমঙ্গলজনক!
কমিটির কোন কোন অসৎ সদস্যদের অবৈধ আয়ের সুযোগ না দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে প্রতিনিয়ত হয়রানি করা হয়। শান্তিতে কোন কাজ করতে দেওয়া হয় না। ভালো চিন্তা করার সুযোগ দেওয়া হয় না। শিক্ষার উন্নয়নে মনোনিবেশ করার পরিবেশ দেওয়া হয় না। চাকরিতে টিকে থাকতে দেওয়া হয় না। চাপ প্রয়োগ করতে করতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়। কখনো কখনো শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। জীবন হুমকির মুখে ফেলা হয়। উল্লিখিত চারজন অধ্যক্ষের বক্তব্যে তা স্পষ্ট। আবার প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজে অসৎ হলে তিনিও অবৈধ আয়ে ভাগ বসান কমিটির অসৎ সদস্যদের সঙ্গে। উভয় পক্ষ মিলেমিশে ভাগ করে খান প্রতিষ্ঠান! লাটে উঠে শিক্ষার মান। ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ হলে চাকরি হারান বা পালিয়ে বাঁচেন প্রতিষ্ঠান প্রধান। উভয় ক্ষেত্রেই বহাল তবিয়তে থাকেন কমিটির লোকজন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি বা সদস্য হওয়া এখন আর সেবামূলক কাজ নয়; বিভিন্নমুখী লাভজক কাজ। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি বাণিজ্য, ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোতে কম বাণিজ্য। ভোটের রাজনীতিও আছে এখানে। তাই সভাপতি বা সদস্য হওয়ার জন্য ও থাকার জন্য মরিয়া অনেকেই। এমপি-মন্ত্রী-নেতারা ছাড়তে চান না এই পদ। তারা নিজেরা বা তাদের কর্মী-সমর্থকদের দখলে রাখতে চান কমিটির সব পদ। আবার স্থানীয় প্রশাসনের কর্তারাও হতে চান প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তারা ৫-১০ টি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারলে প্রতি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মিটিংএ সম্মানী বাবদ পেয়ে যান হাজার হাজার টাকা। তাঁদের দপ্তরের লোকজনও পেয়ে যান কিছু কিছু। শিক্ষকগণ বেতন-ভাতা পাক বা না পাক এইসব সম্মানী(?) পরিশোধ করতে হয় প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে। সভাপতি নিজেই নির্ধারণ করেন তিনার সম্মানীর পরিমান। যে প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা দিতে সক্ষম সে প্রতিষ্ঠানের কাজ হয় দ্রুত। ঝাড়ি খেতে থাকেন গরিব প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভলান্টারি সার্ভিস দেওয়ার জন্যই গঠিত হয় গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটি।
তাছাড়া প্রতিষ্ঠান থেকে যে সামান্য ভাতাদি পান শিক্ষকগণ, তা যেন কমিটির লোকদের দয়ার দান। অনেক দেশে শিক্ষামন্ত্রী নিজে শিক্ষকদের স্যার বলেন। কিন্তু আমাদের কমিটির লোকেরা শিক্ষকদের স্যার বলতে চান না; বরং তারা চান যে শিক্ষকরা ও প্রধানরা জনসম্মুখে তাদের স্যার স্যার করুক। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকুক। তাদের কথায় উঠবস করুক এবং তাই হয় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে। তারা ভুলে থাকেন যে শিক্ষগণ তাদের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত ও সম্মানিত।
এমনকি যে শিক্ষার্থীর বাবা-মা কমিটির সদস্য হন সেই শিক্ষার্থীও খবরদারি করেন শিক্ষকগণের ওপর। যে শিক্ষক-কর্মচারীকে প্রশ্রয় দেয় কমিটির লোকজন তারাও খবরদারি করে প্রতিষ্ঠান প্রধানের উপর। শুধু তাই নয়, কমিটির সভাপতি/সদস্যের দলের, বংশের, বাড়িঘরের সবাই খবরদারি করেন শিক্ষকদের ওপর এবং তা মানতে বাধ্যও হন শিক্ষকগণ। না হলে চোখ মুখ বন্ধ করে মেনে নিতে হয় সেই শ্যামল কান্তির মতো পরিণতি। এভাবে সমাজে ভূলুণ্ঠিত হয় শিক্ষকের মর্যাদা। আমি আবারো বলছি, সব কমিটির সব লোকই যে মন্দ তা নয়। তবে ভালোর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
কমিটির কারণে বহু অধীনতার অন্ত নেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের। অনেক শিক্ষক এটি বুঝতে চান না। সকল শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান যে ভাল তাও নয়। তবে কমিটির মন্দ লোকদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই টিকে থাকে মন্দরা। প্রতিষ্ঠান প্রধান ভাল হোক আর মন্দ হোক বর্তমান বাস্তবতায় তার স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নেই বললেই চলে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সে মেনে নিতে বাধ্য কমিটির সকল সিদ্ধান্ত। সাধারণত দলীয় নেতা সভাপতি ও কর্মী-সমর্থক সদস্য থাকায় বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিগুলো মূলত ওয়ান ম্যান কমিটি। সারাদেশে কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত সভাপতি মুখে যা বলেন তাই সিদ্ধান্ত, তাই করতে হয় প্রতিষ্ঠান প্রধানের। সভাপতির বলার প্রমাণ থাকে না, প্রতিষ্ঠান প্রধানের করার প্রমাণ থাকে। সভাপতি যা বলেন তা ন্যায়-অন্যায় মঙ্গল-অমঙ্গল যাই হোক, প্রতিষ্ঠান প্রধান করতে বাধ্য। বড়জোর মনে মনে ক্ষুব্দ হতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন। সরকারি হলে খুঁটি ধরতে পারেন, বেসরকারি হলে চাকরি হারাতে পারেন! সারাদেশের বাস্তব চিত্র কিন্তু অনেকটা এমনি!
এহেন পরিস্থিতিতে প্রচলিত কমিটির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার বিধান বাতিল করে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নির্বিঘ্নে শিক্ষকতা করার ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। সেইসাথে প্রয়োজন শিক্ষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিতকরণ ও যোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ।
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক।
এইচআর/এমকেএইচ