শতবর্ষে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি : সাফল্যের রহস্য কী?
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শততম বার্ষিকী পালন হতে যাচ্ছে এবছর ১ জুলাই। ১৯২১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দলের জন্ম হয়। ১৯৪৯ সালে মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না) জন্ম হয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। সেই থেকে চীনকে প্রগতির পথে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সিপিসি। চীনদেশের সঙ্গে অনেক বছরের যোগাযোগের ফলে বেশ কাছ থেকে দেখেছি সে দেশের সমাজ। কীভাবে আজ তারা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ শক্তি হয়ে উঠলো সে রহস্য জানার চেষ্টা করেছি।
এখানে বলে রাখি আমার শৈশব কেটেছে কমিউনিস্ট বিপ্লবের কথা শুনে। চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও জেতুংয়ের জীবনের গল্প শুনেছি বাবার কাছে। আমার বাবা কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ছিলেন পঞ্চাশের দশকে প্রথম সারির কমিউনিস্ট কর্মী । তাই তিনি খুব সহজ ভাষায় সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন। পঞ্চাশের দশকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের সঙ্গে তাঁর যে যোগাযোগ ছিল সেই স্মৃতিচারণও করতেন। আমি যখন প্রথম চীনদেশে যাই(২০১১ সালে) তখন বাবা আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি চেয়ারম্যান মাও জেতুংয়ের সমাধি এবং তাঁর জন্মস্থান অবশ্যই দেখে আসবে।’ বাবার কাছে দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি আমি পালন করতে পেরেছিলাম। সেই গল্পও আজ পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করবো।
এ বছর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। এই একশ বছরে সিপিসি চীনদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে। সিপিসির এই গৌরবজনক অভিযাত্রায় প্রধান অবদান রয়েছে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি সমাজতন্ত্রের আদর্শে জীবন উৎসর্গ করা নেতা কর্মীদের। চীনের সভ্যতা পাঁচ হাজার বছরের বেশি প্রাচীন। সেই উত্তরাধিকার যেমন রয়েছে তেমনি বর্তমান চীনের রয়েছে আধুনিক গণমুখী দৃষ্টিভঙ্গী। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে আজকের চীন।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের একটি বিশাল সাফল্য হলো দারিদ্র্য দূরীকরণ। তারা দশ কোটির বেশি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার উপরে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই অতুলনীয় সাফল্য প্রসঙ্গে আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও কিছু কথা বলতে পারি। চীনদেশে সত্যিই খুব সফলভাবে দারিদ্র্য দূরীকরণ করা সম্ভব হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষ তাদের ব্যক্তিগত পরিশ্রম ও সরকারি সহায়তায় নিজেদের ভাগ্যকে বদলে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। আমি বাস করি ইউননান প্রদেশের কুনমিং শহরের এক প্রান্তে ছেংকং বিশ্ববিদ্যালয় শহরতলীতে। আমি সেখানে ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করছি। সেখানে দেখেছি অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষরা নিজেদের দোকান, হস্তশিল্পের কোন প্রতিষ্ঠান বা কৃষি খামার স্থাপন করে নিজেদের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো করে তুলেছেন।
আমার কাছে মনে হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টির একেবারে শীর্ষস্তর থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত যদি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সুসংহত পরিকল্পনা না থাকতো তাহলে এটা সম্ভব হতো না। আমি ইউননানের কয়েকটি ছোট শহরেও ভ্রমণ করেছি। খাইইউয়ান, মিলো, ফুচাহেইয়ের মতো ছোট শহরগুলোতে দেখেছি তারা পর্যটনশিল্পকে প্রসার ঘটনোর মাধ্যমে কীভাবে আর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় একটি পর্যটন স্পট। যেমন ফুচাহেইতে দেখলাম পদ্মফুল ফোটাকে কেন্দ্র করে সেখানে বড় একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে স্থানীয় সরকার। সেই উদ্যোগের ফলে এলাকার জনগোষ্ঠির অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপক। গড়ে উঠেছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সুভ্যেনির শপ, ছোট ছোট পরিবহন ব্যবস্থা। এগুলোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে অসংখ্য মানুষের।
একইভাবে চীনের একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের ভিতরেও পর্যটন শিল্প প্রসার লাভ করেছে। গ্রামীণ টুরিজম বলে একটা বিষয় সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, খাদ্য, কৃষি খামার ইত্যাদি নিয়ে যে গ্রামীণ জীবন তার আস্বাদ পাওয়ার জন্য পর্যটকরা গ্রামে যাচ্ছেন সেখানে কোন বাড়িতে থাকছেন, খামারের টাটকা সবজি, ফল খেতে পারছেন। এভাবে গ্রামীণ পর্যটন বাড়ছে। এগুলো আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। কেন্দ্রীয় সমন্বিত পরিকল্পনা এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব একটা দেশকে কীভাবে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারে সেটা চীনে থাকার সময় বুঝতে পারছি। প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্রের আদর্শকে ধারণ না করলে এটা সম্ভব হতো না।
চীনের সরকারি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় দুই অধিবেশন নামে পরিচিত জাতীয় কংগ্রেসে। সেগুলো জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে হয়ে থাকে। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সেখানে রয়েছে। পরিকল্পনাগুলো হয় ‘পিপলস অরিয়েনটেড’ বা জনকেন্দ্রিক। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং একজন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা। তিনি সিপিসিরও জেনারেল সেক্রেটারি। তার সুযোগ্য ও সুদক্ষ নেতৃত্বে দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো এ বিশাল অর্জন সম্ভব হয়েছে। তাঁর লেখা বই আমি পড়েছি। তাঁর অনেক স্মরণীয় বাণীও জেনেছি। প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং তাঁর বলিষ্ঠ ও জনদরদী নেতৃত্বের মাধ্যমে চীনকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাচ্ছেন।
কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরাও সমাজতন্ত্রের আদর্শে নিবেদিত। কমিউনিস্ট পার্টি শুধু যে যুবসমাজের জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে তা নয়। চীনের প্রবীণ জনগোষ্ঠিও খুব আরামে আছে এবং নিশ্চিন্তে আছে। আমার সঙ্গে বেশ কয়েকজন সিনিয়র সিটিজেনের আলাপ রয়েছে। তারা অত্যন্ত সুখী জীবন যাপন করছেন। তাদের চিকিৎসা সেবা, যাতায়াত ও বিভিন্ন বিনোদন একদম ফ্রি। প্রবীণদের দেখেছি পার্কে বেড়াচ্ছেন, নাতি নাতনি নিয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছেন বা একসঙ্গে দলবেঁধে পিকনিকে যাচ্ছেন। তাদের চেহারায় যে প্রশান্তি দেখেছি সেটা নিশ্চিন্ত জীবন ছাড়া সম্ভব নয়। বেইজিং হোক বা কুনমিং সব শহরে এবং গ্রামেও দেখেছি নাগরিকরা হাসিখুশি, নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করেন।
কমিউনিস্ট পার্টির সাফল্যের পিছনে আমার যেটা মনে হয়েছে তা হলো, তাদের সমাজতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় আস্থা এবং নেতাদের প্রতি গভীর বিশ্বাস। সেইসঙ্গে এটাও বলবো চীনের জনগণ বিশেষ করে পার্টির কর্মীরা খুবই পরিশ্রমী। আইনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাও অবিচল। ফলে নিজেদের দেশকে এগিয়ে নিতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। তাদের দেশপ্রেমও সুগভীর।
চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্রের শুভ প্রভাব দেশের সর্বত্রই পড়েছে। সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে মনে পড়ছে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মহান নেতা মাও জেতুং এবং চৌএন লাইয়ের কথা। আমার বাবা এই দুই মহান নেতার খুব ভক্ত ছিলেন। তাঁর কাছেই এদের জীবনের অনেক কথা শুনেছিলাম। ২০১৭ সালে আমার সৌভাগ্য হয় হুনান প্রদেশের শাওশান গ্রামে মহান নেতা মাও জেতুংয়ের জন্মস্থান, শৈশব স্মৃতি বিজড়িত পারিবারিক বাসস্থান, তার গ্রাম এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখার। মনে হচ্ছিল যেন বাবার কাছে শোনা গল্পগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আমার শুধু দুঃখ হচ্ছিল যদি বাবাকে এখানে নিয়ে আসতে পারতাম। হুনান প্রদেশের ছাংশায় রয়েছে চেয়ারম্যান মাও জেতুংয়ের এবং কমিউনিস্ট পার্টির স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থান।
আমি বেইজিংয়ে থিয়েনআনমেন স্কোয়ারে চেয়ারম্যান মাও জেতুংয়ের স্মৃতি সমাধি সৌধ দেখেছি। সে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। মহান নেতার মমিকৃত অবয়ব দেখে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর পর মনে হয়েছে জীবন সার্থক হলো। সমাজতন্ত্রের আরেকটি সুফলের কথা আমি জোর গলায় বলতে চাই। কমিউনিস্ট পার্টির সুদক্ষ পরিচালনা ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ফলেই চীনকে নারী নির্যাতনমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৪৯ সালে মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর চীনে নারী পুরুষের সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করা হয়।
চীনের নারীরা সমাজে সমমর্যাদা, অধিকার এবং নিরাপত্তা ভোগ করেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি নারীর জন্য চীন অত্যন্ত নিরাপদ একটি দেশ। কারণ চীনের আইন যে কোন প্রকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে বেশ কঠোর। চীনে তাই নারীরা তাদের পূর্ণ শ্রমশক্তি ব্যবহার করে দেশকে এগিয়ে নিতে পারছেন পুরুষের সমমর্যাদায় ও অধিকারে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। চীনের পররাষ্ট্রনীতি হলো পারষ্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধার। প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নামে যে যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ তাতে যোগ দিয়েছে ২০১৬ সালে। বাংলাদেশের উন্নয়নে ও বাণিজ্যে সবচেয়ে বড় অংশীদার চীন। পদ্মাসেতু, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে চীনের প্রকৌশলী ও নির্মাণ সংস্থাসমূহ নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের দেশকে শিল্পোন্নত করায় সহযোগিতা করছে চীন। করোনা মহামারীর ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন। বিভিন্ন মেডিকেল সামগ্রী চীন বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। পাশাপাশি চীনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সমাজতান্ত্রিক আদর্শের চীন এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পরস্পরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করে উন্নয়নকে এগিয়ে নিচ্ছে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমকেএইচ