শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ০১ জুলাই ২০২১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রিয় আঙিনা, আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মোচনের সবুজ পৃথিবী। প্রিয় সব সতীর্থ ও অধ্যাপকদের স্মৃতিতে ভাস্বর। প্রত্যাশা-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা আর নিজেকে জাগানো আমার পার্থিব স্বর্গরাজ্যও এটি। সেখানকার বৃক্ষ-লতা-ঘাসের সঙ্গে লেগে থাকা যৌবনের আবেগমথিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মানবিক ভাবাবেগের ভেতরে প্রবেশের অনন্য সিংহদুয়ারও এটি। ২০২০ সাল ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। করোনা মহামারির কারণে মুজিববর্ষ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উদযাপিত হচ্ছে। অন্যদিকে ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপিত হলো মার্চ মাসে। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং তারপর আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উপস্থিত হয়েছে।

১ লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। শতবর্ষের আঙিনায় প্রতিষ্ঠানটির নতুন করে যাত্রা শুরু হলো। আমরা যারা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি কিংবা ভিন্ন সব ডিগ্রি অর্জন করে এদেশের রাষ্ট্র ও সমাজের বিচিত্র কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত- সকলেরই রয়েছে এর সঙ্গে আন্তরিক সংযোগ। বিশেষত যেসব গ্র্যাজুয়েট দেশের বাইরে অবস্থান করছেন কিংবা ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্ত থেকে তাঁদের প্রিয় ক্যাম্পাসে পদচারণা করেছিলেন তাঁরা আশি বছর বয়সে এসেও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কে স্মৃতির মণিকোঠায় ধারণ করে আছেন।

এদেশের ঢাকা যেমন একমাত্র শহর, তেমনি এদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একমাত্র সফল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান, গবেষণা, জ্ঞান আদান-প্রদান এবং আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পর্যন্ত অনন্য। জরিপ অনুসারে এশিয়া কিংবা বিশ্ববাসীর তালিকায় এই প্রতিষ্ঠানের নাম নিচে কিংবা উপরে থাকার চেয়ে বাঙালির কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদা। তবে নিজের প্রতিষ্ঠানের সুনাম সকলেই প্রত্যাশা করেন, সকলেই চান এর মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক। উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে গত এক যুগ কেবল আলোচনা, সমালোচনা ও সেমিনার হয়েছে। মাঝে মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়েছেন বিশিষ্টজনরা। অবশ্য কার্যকর পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত গৃহীত হয়নি।

একথা ঠিক সুষ্ঠু পরিবেশ, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গুণগত শিক্ষা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান(প্রয়াণকাল ২০২০, ১৪ মে) যখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তখন সুযোগ-সুবিধা কম থাকলেও যোগ্য অধ্যাপকদের অভাব ছিল না। তাঁর স্মৃতিকথা কাল নিরবধি এবং বিপুলা পৃথিবীতে তিনি যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে দেখা যায় পাকিস্তান আমলের বিরূপ রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও তিনি নিজের চেষ্টায় এবং তাঁর অধ্যাপকদের আন্তরিকতায় জীবনে সফল হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। তাঁকেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার জন্য নাজেহাল হতে হয়েছে। বরং চারিদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঢেউ আর পাকিস্তানপন্থী শত্রুদের মধ্যে থেকেও তিনি লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে গেছেন।

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ নানা কাজের মধ্য দিয়ে গত ৫০ বছরে বিশ্বের কাছে গৌরবজনক আসন অর্জন করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক গ্র্যাজুয়েটদের দেশপ্রেম ও দায়বদ্ধতার কারণে। যেমন, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর এই দু’জনের অর্জন ও অবদান বিশ্বজন স্বীকৃত। আসলে আমরা যতই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, পাঠ্যক্রম, গবেষণা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন তদারকির কথা বলি না কেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের অর্জন কম কথা নয়। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি একশ বছর যাবৎ আমাদের চিন্তা-চেতনাকে প্রগতির পথে চালিত করেছে। কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক ভাবনা, অবিচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা শিখিয়েছে। গড়ে তুলেছে বৈষম্যহীন সমাজ। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা এখন অনুপস্থিত। শতবর্ষে এসে এই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের রাজনৈতিক ঐক্য অর্থাৎ দল-মত নির্বিশেষ মানুষকে প্রগতিশীল চিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিতে আনতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

ইদানিং কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে হতাশার কথা উচ্চারণ করেন। তাঁরা বলেন মান অবনতির সবচেয়ে বড় কারণ হলো শিক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব। তারপর যে বিষয়গুলো ধর্তব্যের তা হলো- গবেষণা, অবকাঠামো, বাজেট, যোগ্য শিক্ষক এবং ছাত্র শিক্ষক অনুপাত প্রভৃতি। মানের এই অবনমনের জন্য প্রধানত দায়ী শিক্ষকরা। দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলে থাকেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সরকারি কর্তৃত্ব, শিক্ষকদের স্বায়ত্তশাসনের অপব্যবহার, শিক্ষায় বরাদ্দ ও গবেষণার অপ্রতুলতা, শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অসংগতি, শিক্ষার্থীদের আবাসন ও ছাত্র রাজনীতিতে সংকটজনক পরিস্থিতির মতো বিষয়গুলো মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে চিন্তায় আনতে হবে।

অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অর্জনে আগ্রহ কমে গেছে। উপরন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ এখনো বিশ^মানের নয়। আরো অভিযোগ হলো- শিক্ষকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হলেও এখন মূলত দলীয় রাজনীতি প্রধান হয়ে উঠেছে এবং সরকারদলীয় শিক্ষকদের দাপট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পড়েছে নির্বাচনকেন্দ্রীক। বছরজুড়ে শিক্ষকদের নানা নির্বাচন লেগেই থাকছে। ২০২০ থেকে সূচনা হওয়া করোনা মহামারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির কাছে শিক্ষার সংকট নিরসনে দিক-নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

এ সম্পর্কে আমাদের অভিমত হলো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় যেহেতু একাডেমিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বিধির অনুবর্তী সেজন্য নির্বাচন এবং শিক্ষকদের দলীয় প্ল্যাটফর্ম থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে বিষয়টি এখন সামনে আনা দরকার তা হলো- দলীয় আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে অধ্যাপকদের রাজনীতিতে বেশি সময় ব্যয় কিংবা রাতদিন নিজের দলের ভেতর একাধিক গ্রুপের অতিতৎপরতা প্রভৃতির অনুশীলন। আওয়ামী লীগ মতাদর্শের সমর্থকদের ভেতর একাধিক বিভাজন থাকাটা কতটা যৌক্তিক কিংবা এক গ্রুপের বিরুদ্ধে অন্য গ্রুপের নোংরা প্রচারণা থাকা আদৌ দরকার কিনাÑ এসব বিষয় নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। কারণ ড. আনিসুজ্জামানের পূর্বোক্ত গ্রন্থদ্বয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বার্থপর অধ্যাপকদের নোংরামির বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।

আসলে শিক্ষক রাজনীতি যে কলুষিত হয়েছে এটা মানতেই হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যরা শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের ছাত্রজীবনে ভালো ফলাফলকে গুরুত্ব না দিয়ে দলীয় বিবেচনায় ভোটার নিয়োগ দিয়েছিলেন। ফলে সেসব নিম্নমেধার শিক্ষকরা এখন অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়ে দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করছেন। এতে নতুন চিন্তা-ভাবনা এবং মুক্তবুদ্ধির প্রসারণের চেয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়েছে নির্বিকার সার্টিফিকেট বিতরণের জায়গা। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বা গবেষণার চেয়ে সরকারদলীয় আনুগত্য প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতে শিক্ষকতার মান, শিক্ষার্থীদের সুযোগ ও গবেষণার মতো বিষয়গুলো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।

গত ১২ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টায় উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটলেও পুরানো ভূত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দূর হয়নি। এমনকি ইউজিসি’র দায়িত্ব বাড়লেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের ওপর নজরদারির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়নি। অথচ আমরা সকলে বলে থাকি, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও উন্নত গবেষণা হচ্ছে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি। অবশ্য সকলে এক কথায় স্বীকার করবেন, শেখ হাসিনা সরকারের সময়োপযোগী শিক্ষানীতি ও এর সফল বাস্তবায়নের সুবাদে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণায় বরাদ্দ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ফ্যাকাল্টি মেম্বার বিশ্বের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁদের গবেষণার ফলাফল নন্দিত হচ্ছে। অনেকেরই গবেষণা ও প্রকাশনা আন্তর্জাতিক মানের। তারা মেধার ভিত্তিতেই সেখানে গিয়েছেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই বিষয়গুলো সকলে মনে রাখলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব কখনো ম্লান হবে না। আমি গৌরবান্বিত এজন্য যে এই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছি, সৌভাগ্য অনুভব করছি শতবর্ষ উদযাপনে শরিক হয়ে।

লেখক : ইউজিসি পোস্ট ডক ফেলো এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/এমকেএইচ

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের অর্জন কম কথা নয়। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি একশ বছর যাবৎ আমাদের চিন্তা-চেতনাকে প্রগতির পথে চালিত করেছে। কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক ভাবনা, অবিচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা শিখিয়েছে। গড়ে তুলেছে বৈষম্যহীন সমাজ। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা এখন অনুপস্থিত। শতবর্ষে এসে এই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের রাজনৈতিক ঐক্য অর্থাৎ দল-মত নির্বিশেষ মানুষকে প্রগতিশীল চিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিতে আনতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।