টিকায় মন্ত্রীর হতাশা : আমলায় ভরসা
ফাইজারের টিকার ট্রায়াল রাউন্ড চলছে রাজধানীতে। টিকা নিয়ে হাহাকার এবং নানা টিপ্পনির মধ্যে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী সোমবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়-বিএসএমএমইউ, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে শুরু হয়েছে এ কার্যক্রম । সব ঠিক থাকলে এই হাসপাতালগুলোর প্রতিটিতে প্রতিদিন ১২০ জনকে টিকা দেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে টিকার ১ লাখ ৬২০ ডোজ। কেবল মন্দের ভালো নয়, বড় রকমের ভালো খবর এটি।
ফাইজারের টিকা সারা দেশে পরিবহন করার মতো কোল্ড চেইন সিস্টেম না থাকায় এগুলো মূলত রাজধানীতেই দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফাইজারের টিকা অবশ্যই মাইনাস ৬০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়।এদিকে, বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় চীনের সিনোফার্মের কাছ থেকে আগামী মাসেই টিকা পাওয়ার আগাম বার্তা দিয়ে রেখেছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। পরে বাংলাদেশ দুঃখ প্রকাশ করে চীনকে নরম করার পদক্ষেপ নেয়। শনিবার থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে চীন সরকারের উপহার দেওয়া ১১ লাখ ডোজ সিনোফার্মের টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু। এর মাধ্যমে দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ের গণটিকাদান শুরু হয়। এখন চুক্তির টিকা পাওয়ার অপেক্ষা। প্রশ্ন বা সংশয় থাকলেও একজন আমলা তথা কূটনীতিকের কথা আমলে নিতে হয়।
করোনার টিকা নিয়ে আশা-নিরাশা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নানা পর্ব সেই শুরু থেকেই। এ নিয়ে কথা-বার্তার কোনো অর্থ নেই। এ নিয়ে ক্ষোভ-বিরক্তিও অনেকের। ক্ষমতাসীন দলের একনিষ্ঠ চিকিৎসক স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ স্বাচিপ সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান বছর খানেক আগে হতাশ হয়ে টিকা নিয়ে প্রকাশ্যে টিভিতে কয়েক কথা বলেছিলেন। তিনি করোনা নিয়ন্ত্রণ পরামর্শক কমিটির সদস্য হয়েও বলেছিলেন, কমিটি থেকে বারবার বলা হচ্ছে টিকার ব্যাপারে তৎপর হতে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ আমলাদের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেন তিনি। তার কথা ছিল এ রকম- ‘ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি আরো কিছু দেশ তাদের জনসংখ্যার তিনগুণ সংখ্যক ভ্যাকসিনের অগ্রিম অর্ডার ও টাকা দিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর মন্ত্রণালয়ের বড় আমলারা সেকথা কানেই তোলেন না। তাদের কথা ছিল, তখনো কোনো কোম্পানির ভ্যাকসিন ট্রায়াল শেষ হয়নি, কেউ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়নি, আমরা কেন ভ্যাকসিনের বুকিং দিতে যাব? ইউরোপ-আমেরিকার মন্ত্রী-আমলারা বোকা, তাই ওরা অগ্রীম টাকা দিয়ে বসে আছে’।
টিকা নিয়ে অবস্থা যে লেজে-গোবরে, তা লুকাতে গিয়ে মিথ্যাচারের ওপর মিথ্যাচার যোগ করতে হয়েছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটউটের কাছ থেকে তিন কোটি কোভিশিল্ড টিকা কিনতে বাংলাদেশ সরকার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করেছিল। এর মধ্যে সেরাম দুই দফায় ৭০ লাখ টিকা সরবরাহের পর টিকা সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। সিনোফার্মের কাছ থেকে সরকারের দেড় কোটি টিকা কেনার আলোচনা গত মাসে প্রায় চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু, ল্যাঠা বাধে এক অতিরিক্ত সচিবের কথায়। চীনের কাছ থেকে কেনার দাম ফাঁস করে দেন তিনি। তাও গোপনে নয়। একেবারে সংবাদ সম্মেলনে। এ নিয়ে চিঠি চালাচালিসহ বাঁধে গোলমাল। এরপরও দৃশ্যত কথা কমাননি মন্ত্রীরা। অত তারিখে টিকা আসবে, এত লাখ অমুক মাসে আসবে এত কোটি ডোজ ইত্যাদি বাড়তি কথা প্রচার করতে হয়েছে। সেইসাথে করোনাজয়ের নামে অবিরাম নানা জয়ধ্বনিও ছড়াতে হয়েছে।
কথামালার এক পর্যায়ে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেই ফেলেছেন, টিকার দেবে বলে অনেকে আশ্বাস দেয়, কিন্তু দেয় না। পরবর্তীতে গত সপ্তাহে স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বীকারোক্তির মতো জানিয়েছেন, আগস্ট পর্যন্ত তিনি ভ্যাকসিন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন হতাশার বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস দিলেন আশ্বাস। অনেকটা নিশ্চিত করে বলেছেন, জুলাই থেকে ব্যাপক হারে টিকা দেওয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় অনেকের কাছে মন্ত্রীর হতাশার চেয়ে সচিবের আশ্বাসের ওপর ভরসা রাখায় যুক্তি বেশি। ঠিক এমন সময়ে আশ্বাসের জানান দিলেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনও। বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় চীনের পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে এক কোটি টিকা কেনার বিষয়ে দেনদরবারের কথাও জানিয়েছেন তিনি। সিনোভ্যাক ও আনুই জিফেই নামের দুটি প্রতিষ্ঠান তো রয়েছেই।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমকেএইচ