নারী ইউএনও: সংসদে কার ফুঁ?

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ১৬ জুন ২০২১

খেয়েদেয়ে কাজ নাই, কাজ নাইতো খই ভাজ- এ ধরনের প্রচলিত কিছু স্লোকের ছায়া কি পড়েছে সংসদীয় কমিটিতে? তাও আবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এই কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনার দেয়ার ক্ষেত্রে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনওর বিকল্প খোঁজা। কমিটি বিকল্প ব্যক্তি নির্ধারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে মন্ত্রণালয়কে। ভাবা যায়?

ভাবা না গেলেও এটাই হয়েছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি আলাদা সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের ছায়া হিসেবে কাজ করে তারা। তাদের অন্যতম কাজ হচ্ছে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি, গাফিলতি দেখলে নোট দেয়া। সুপারিশ করা। প্রয়োজনে জড়িত বা সন্দেহভাজনকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তও করতে পারে এ কমিটি। এ সবের কিছুতে না গিয়ে করোনায় নাকাল সময়ে এ কোন কাজ খুঁজে বের করলো সংসদীয় স্থায়ী কমিটি? বাঘা বাঘা মুক্তিযোদ্ধা আছেন এই কমিটিতে। এই কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এর সদস্য। সদস্যদের মধ্যে আরও আছেন সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, রাজিউদ্দীন রাজু, কাজী ফিরোজ রশীদ, ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের মতো তুখোড় মুক্তিযোদ্ধারা। রাজনীতিতেও তাদের একেকজনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস।

কমিটির সভাপতি শাজাহান খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নারী ইউএনও গার্ড অব অনার দিতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। নারীরা তো জানাজায় থাকতে পারেন না। কিসের মধ্যে কী আনলেন তিনি। নানা ফরজ কাজ বাদ দিয়ে কী নিয়ে নামলেন তিনিসহ তার কমিটির সদস্যরা? নানা জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার দাপট, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে দখলবাজির মতো বিষয় বাদ দিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অব অনারে নারী ইউএনওর বিকল্প খোঁজা নিয়ে? কাজের এতো অভাব পড়ে গেল তাদের? বৈঠকে আলোচনায় উঠে আসে, সাধারণত নারীরা জানাজায় অংশ নেন না। এটি নিয়ে সমাজে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। তাই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনার দেয়ার ক্ষেত্রে যেখানে নারী ইউএনও আছেন, সেখানে বিকল্প একজন পুরুষ কর্মকর্তা নির্ধারণ করা দরকার।

সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় সংশ্লিষ্ট জেলা বা উপজেলা প্রশাসন। ডিসি বা ইউএনও সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে থাকেন। কফিনে সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। কোন অনিবার্য পরিস্থিতিতে এমন বিষয় চয়েস করা জরুরি হলো তাদের? হেফাজত-জামায়াতও এ নিয়ে কখনো কোনো ফতোয়া দিয়েছে বলে জানা নেই। এরপরও কোনো মহল থেকে দাবি বা পরামর্শ থাকলেও হতো। গার্ড অব অনার জানাজা নয়। শতাধিক উপজেলায় নারী ইউএনও রয়েছেন। সুপারিশটি তাদের জন্য অগ্রাহ্যমূলক। তাদের মনে কি কম কষ্ট দেয়া হয়েছে এ ধরনের সুপারিশে। কিন্তু, চাকরির বিধিবদ্ধ কারণে সেই কষ্ট-ক্ষোভ জানানো তাদের জন্য গর্হিত কাজ। তাই বলে কথা থেমে থাকছে না। জামায়াত-হেফাজতিরাও এ ধরনের কাজের সাহস পেত কি-না, প্রশ্ন এসেই যাচ্ছে। অপ্রয়োজনে নতুন ইস্যু তৈরির মদদ কি-না, সেই প্রশ্নও আছে।

বাংলাদেশে রাজনীতি-প্রশাসনসহ নারীর ক্ষমতায়ন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। আরেক দিকে নারী কর্মকর্তারা নানা চ্যালেঞ্জে পড়ছেন। প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে পুলিশ, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, প্রকৌশলেও নাম করছেন তারা। কর্মক্ষেত্রে অনেক দুর্ঘটনা, বিড়ম্বনা ও বিব্রতকর অবস্থায়ও পড়তে হয় তাদের। নারী হিসেবে বাড়তি কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি থাকে। স্বাস্থ্যগত ও মানসিক ঝুঁকি তো আছেই; পরিবারের নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হয়। কখনো কখনো রাতের বেলায় কোনো অভিযান চালাতে গেলে কিছু অসুবিধায় পড়তে হয়। আবার কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। নারী হওয়ায় মেয়ে বা বোন হিসেবে সহজেই অসহায় মানুষ নিজেদের সমস্যার কথা বলতে পারেন। তাতে কাজগুলো সহজে সমাধানও হয়। এসব প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে এবং সহমর্মিতায় মুগ্ধ হয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। কখনো কখনো ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানম বা মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুনের মতো নাজেহালও হতে হয়।

গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলীর ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। সরকারি বাসায় ঢুকে এ হামলার ঘটনার পর মাঠপর্যায়ে নারী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এ ঘটনার পর প্রতিটি উপজেলায় ইউএনওদের নিরাপত্তায় চারজন করে আনসার নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। সরকারের ওই পদক্ষেপে প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে এক ধরনের সন্তোষ রয়েছে। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে কার ফুঁ পড়লো?

ক্ষমতাসীন দলে বা আশপাশে নারীবিদ্বেষী কারও অনুপ্রবেশ ঘটেনি তো? তেমন কড়া প্রতিবাদও না থাকা কিছুটা উদ্বেগেরই। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানোর বিষয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ নেই। নারীর ক্ষমতায়নে বিশাল অবদান রাখা সরকারের আমলে সংসদীয় কমিটিতে এমন সুপারিশ অনেকের জন্যই কষ্টের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেমন কিছু হতে দেবেন না, তাও আশা করা যায়। প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সংস্কৃতি অবশ্যই এতোটা নিচে নামতে দেবেন না তিনি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানোর বিষয়ে নারী- পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ নেই। নারীর ক্ষমতায়নে বিশাল অবদান রাখা সরকারের আমলে সংসদীয় কমিটিতে এমন সুপারিশ অনেকের জন্যই কষ্টের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেমন কিছু হতে দেবেন না, তাও আশা করা যায়। প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সংস্কৃতি অবশ্যই এতোটা নিচে নামতে দেবেন না তিনি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।