৬ দফার বাংলাদেশে অগ্রিম সুস্বাগতম
১৯৬৫ তে তার গ্রহণযোগ্যতা যখন তলানিতে, আইয়ুব খান তখন ‘কোন কথা নেই, বার্তা নেই’ ভারত আক্রমণ করে বসেন। আইয়ুব খানের ধারণা ছিল লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর প্রধানমন্ত্রিত্বে টালমাটাল ভারত এ ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে না। কাজেই ভারতকে হঠাৎ ধাক্কায় কুপোকাত করে নিজের ডুবন্ত তরীটি কূলে ভেড়ানোর ধান্দা ছিল তার। আইয়ুব খানের ধারণায় ভুল ছিল। ফিল্ড মার্শালের সব হিসাব-নিকেশ উল্টে দিয়ে লাহোরের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল সেবার ভারতীয় সেনারা।
যুদ্ধের পর আইয়ুব খানের বিদায় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় বিরোধী দলকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগটি গ্রহণ করেন পূর্ব পাকিস্তানের পদত্যাগী গভর্নর জেনারেল আজম খান। তিনি তার লাহোরের বাসায় বিরোধীদলীয় নেতাদের একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। বঙ্গবন্ধুও যোগ দেন ১৯৬৬-এর ফেব্রুয়ারির ৫ ও ৬ তারিখের সেই বৈঠকটিতে। লাহোরেই তিনি উপস্থাপন করেন তার ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রস্তাব।
ফেডারেল কাঠামোর পাকিস্তানের দুটি অংশের জন্য আলাদা মুদ্রা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক, প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র শুধু বাদ দিয়ে প্রদেশের হাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এমনকি প্রাদেশিক প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের প্রস্তাব ছিল ৬ দফায়। পাশাপাশি ছিল আবার সংসদীয় সরকারে ফিরে আসার প্রস্তাবও। লন্ডন প্রবাসী শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখায় জানা যায়, আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপনের আগে বঙ্গবন্ধু শুধু তোফাজ্জল হোসেন, মানিক মিয়া, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন আর তার সাথে এ নিয়ে পরামর্শ করেন। তিনি জানতেন বিষয়টি আগেভাগে প্রচারিত হলে পাকিস্তানিরা তাকে আবারও কারাগারে পাঠিয়ে দিবে আর অংকুরেই বিনষ্ট হবে ৬ দফা।
বঙ্গবন্ধুকে অবশ্য লাহোরের সেই বৈঠকে ৬ দফা উত্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়নি। পরে তিনি সেখানে একটি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ৬ দফা উত্থাপন করেন। তবে ৬ দফা আওয়ামী লীগ ও বাঙালির আকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করে। লাহোর থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু ৬ দফার সমর্থনে গণজোয়ার গড়ে তোলেন। যথারীতি তাকে আবারও গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তবে এতে হয় হীতে বিপরীত। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূর্ত প্রতীক- বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৬৬'র, ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুসহ প্রায় ৮০০ রাজবন্দীর মুক্তি এবং ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে। এদিন পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন ১০জন আন্দলোনকারী। আজ সেই তারিখ- আজ ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস।
আমরা কথায় কথায় ৬ দফাকে ম্যাগনা কার্টার সাথে তুলনা করি। কিন্তু আমি শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাথে একমত। বাঙালির জন্য ৬ দফা ম্যাগনা কার্টার চেয়েও অনেক বেশি কিছু কারণ ম্যাগনা কার্টা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র থেকে ইংরেজদের মুক্তির সনদ। অন্যদিকে ৬ দফা বাঙালির ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আত্মিক মুক্তির দলিল। কারণ ৬ দফার পথ বেয়েই বাংলাদেশ। এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনারও প্রয়োজন নেই। বঙ্গবন্ধুর মুখেই শুনুন। ৬ দফা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, "আমি বাঙালির সামনে স্বাধিকারের সাঁকো দিলাম। এই সাঁকো বেয়েই একদিন বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করবে।"
বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর সেই সাঁকো বেয়ে স্বাধীন বাঙালি এখন বঙ্গবন্ধু সেতু বেয়ে জয় করেছে যমুনাকে। সামনে তার চোখে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে কর্ণফুলির পাতাল জয়ের স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সামনে কোভিড অতিমারি মোকাবেলায় জ্ঞানে-গবেষণায় দেশকে নেতৃত্ব দিবে বাঙালির সেই স্বপ্ন এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ডানায় চেপে মহাশূন্যের বিশালতাকে ছুতে চাচ্ছে। ৬ দফা দিবসে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের ২০২৩ পরবর্তী স্বপ্নালু যাত্রায় অগ্রিম সুস্বাগতম।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এএসএম