পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন : বাঙালিয়ানা আর বাঙালিত্বের জয়

সদ্যই অনুষ্ঠিত হয়ে গেল পশ্চিশবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন। বরং বলা ভালো সদ্যই প্রকাশিত হলো নির্বাচনটির ফলাফল। কারণ নির্বাচনটি চলেছে একদিন-দুদিন নয়, আট দফায় টানা দুই মাস ধরে। পশ্চিববঙ্গের নির্বাচনটিকে ঘিরে এদেশের মিডিয়া আর পাশাপাশি মানুষেরও আগ্রহ ছিল বিশাল। দেশের নির্বাচনের বাইরে সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের জাতীয় নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচন এভাবে আমাদের মানুষ আর মিডিয়াকে আকর্ষিত করে না। কারণটাও সঙ্গত, মাঝের কাঁটাতারের বেড়াটুকু বাদ দিলে আমাদের পাসপোর্টই শুধু আলাদা।

বহুল আলোচিত এই নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃনমূল কংগ্রেস। এরই মাঝে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়েছেন দিদি। মমতার এই বিজয়কে নানাভাবে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এ নিয়ে ক’দিন আগে চমৎকার একটি আর্টিকেল লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গের নামজাদা সাংবাদিক, সম্প্রীতি বাংলাদেশের সুহৃদ জয়ন্ত ঘোষাল। গুনে গুনে দশটি কারণ তিনি খুঁজে বের করেছেন মমতার এই বিজয়ের পেছনে। জয়ন্তদার এই কলামটি এদেশের একটি নামজাদা দৈনিকে প্রকাশিত হয়। এরপরপরই সম্প্রীতি বাংলাদেশের ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বেশ কিছু টেক্সট চালাচালি। আমাদের এই সংগঠনটির বৈশিষ্ট হচ্ছে এর সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের অনেকেই দেশের প্রথম সারির কলাম লেখকও বটে। টেক্সটিংয়ের বিষয়বস্তুও পরিষ্কার। এ নিয়ে লেখার আগ্রহ ছিল আরও অনেকেরই, কিন্তু বাজিমাৎ করেছেন জয়ন্তদা। অবশেষে সমাধানটা দিলেন টরেন্টোয় বসে নিরঞ্জনদা।

একই বিষয়ে নানা আঙ্গিকে একধিক লেখায় বিষয়টি নানাভাবে উঠে আসবে। অতএব চলতেই পারে দিদির সাফল্যের রহস্যভেদ। নিরঞ্জদার সমাধানটা আসতে দেরি হয়েছে, ছাপতে দেরি হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান স্যারের এ বিষয়ে চমৎকার প্রবন্ধটি। বিষয়টা নিয়ে লেখিলিখি করছিলাম আমিও। জয়ন্তদার লেখাটা আসার পর একটু ব্যাকফুটে ছিলাম। তবে নিরঞ্জদার সমাধান আর তারপর মান্নান স্যারের অমন দারুণ একটা লেখা। আমাকে আর পায় কে?

আমি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনটাকে ডাক্তারির ফাঁকে ফাঁকে ফলো করার চেষ্টা করেছি আগাগোড়াই। আমার ধারণা ছিল দিদি জিতবেন এবং আমার এই ধারণার কথা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই আমি শেয়ারও করেছি অনেকের সাথেই। তবে এই জয় যে এমন হবে, এমনটি ছিল আমার ধারণারও অতীত। এখন যখন নির্বাচনের ফলাফলটা চোখের সামনে, একে যতই ঘাটছি আর যতই পড়ছি জয়ন্তদা বা মান্নান স্যারদের মতো ডাকসাইটে কলামিস্টদের কলামগুলো আর সাথে মিডিয়ার বিশ্লেষণ, আমার কাছে ততই বেশি করে মনে হচ্ছে এমনটাইতো হওয়ার কথা ছিল। জয়টাতো শুধু দিদির না, জয়টাতো বাঙালির! এমন জয়তো অতীতে কাটা তারের এপারে আমরাও দেখেছি বহুবার।

আমার কাছে মনে হয়েছে বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণা আর তারও আগে প্রার্থী মনোনয়ন পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দিত তাহলে তারা শেষ মেষ বোধয়হ আরেকটু ভালো করতে পারত। ভারত একটি বৃহৎ দেশ। এর একেকটি প্রদেশের মানুষের বৈশিষ্টগুলো একেক রকমের। তামিলনাডু, পাঞ্জাব আর উত্তর প্রদেশের মানুষগুলো ভারতীয় হলেও, তাদের বৈশিষ্টগুলো যেমন একেবারেই আলাদা, তেমনি বাঙালিও এর ব্যতিক্রম কিছু না। বাঙালির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে নোবেল লরেট অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, বাঙালির চরিত্র গড়ে উঠেছে ছয়শ বছরের বৌদ্ধ শাসন, তারপর চারশ বছরের মুসলিম শাসন আর সব শেষে দুইশ বিশ বছরের ব্রিটিশ শাসনের পটভূমিতে। বিষয়টি জয়ন্তদাও উল্লেখ করেছেন তার লেখাটিতে।

এহেন বাঙালি জাতিকে তিনি সবচেয়ে ভালো চিনেছিলেন তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির বাইরের সবকিছু গ্রহণ করতে ঠিকই, কিন্তু নিজেদের বাঙালিত্বে এত সহজে ছাড় দেবে না। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান তাই টিকে গেলেও তাকে টিকতে হয়েছে বাঙালি আর বাংলাদেশের কাছে নাকে খত দিয়েই। প্রধানমন্ত্রী মোদি একবার-দুবার পশ্চিমবঙ্গে এসে জনসভা করে চলে গেলে, সেটি এককথা। কিন্তু বিজেপির কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন প্রাদেশিক নেতাদের পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এত বেশি আনাগোনা আর প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু করে নির্বাচন পরিচালনা আর এমনিকি নির্বাচনী প্রচারণা, সবখানেই তাদের অমন দাপট পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিতো বটেই, প্রদেশটির বিজেপিও আদৌ ভালোভাবে নেয়নি। বিষয়টি মমতা খুব ভালোই বুঝেছিলেন, আর তাই তার মুখেও ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। অথচ এই স্লোগানের গুঢ় অর্থ না বুঝেই বিজেপির অবাঙালি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করেছিল এটি মমতার দুই বাংলাকে এক করার একটি চাল।

পাশাপাশি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারেও আপত্তি ছিল ওপারের বাঙালিদের, যার বহিঃপ্রকাশ নির্বাচনী ফলাফলেই স্পষ্ট। এই উদাহরণ এপারেও আছে ভুড়ি ভুড়ি। বাঙালি এমনিতে ধার্মিক, তা সে বাঙালি মুসলমানই হোক আর হিন্দুই হোক। কিন্তু ধর্ম বাঙালির ব্যক্তিজীবনের বাইরে তার রাজনীতি আর রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখবে এটি বাঙালি কখনই মেনে নেয় না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি হিন্দুরা যে শুধু বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্রত্যাখান করেছে তা’ই নয়, তারা একই সাথে প্রত্যাখান করেছে ফুরফুরা শরিফের পীর সাহেবের ছেলে আব্বাস সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেকুলার পার্টিকেও।

এদেশেও আমরা আটরশীর পীর সাহেবের জাকের পার্টির একই পরিণতি দেখেছি। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আটরশীর ওরশ উপলক্ষে, আজকের এফডিসির পাশের যে জায়গাটায় ঢাকার নতুনতম পাঁচতারকা ডেস্টিনেশনটি গড়ে উঠছে, সেখানকার সেই সময়কার বড় ফাঁকা মাঠটাতে হাজারো গরু, ছাগল আর উটের মেলা বসত। সারাদেশ থেকে মানুষ ওরশ উপলক্ষে এসব পশু হুজুরকে দান করত। পরে এ প্রাণীগুলোকে শতশত ট্রাকের কনভয়ে করে নিয়ে যাওয়া হতো আটরশীতে। সে এক দেখার মত দৃশ্য। আমার বাবার সরকারি গাড়িতে চেপে সেই পশুর মেলা দেখতে গিয়েছি বহুবার।

বিশেষ করে উটগুলো ছিল আমার কাছে বিরাট আকর্ষণ। অথচ জাকের পার্টি গঠিত হওয়ার পর ওই দলের থেকে কেউ এমনকি আটরশী থেকেও জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হতে পারেননি। প্রতিবছর ভক্তরা হুজুরের ওরশে যে পরিমাণ গরু, ছাগল আর উট দান করত, সে পরিমাণ ভোটও দলটির কপালে জোটেনি কোনো জাতীয় নির্বাচনেই।

দিদির জয়ের আরেকটি বড় কারণ বাঙালির কাছে ‘মায়ের’ সম্মানের জায়গাটা। বাঙালি কখনো মায়ের অসম্মান মেনে নেয় না। এবারের নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্ব যেভাবে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে আক্রমণ করেছেন তা বাঙালির সাথে বিজেপির দূরত্ব বাড়িয়েছে বলেই আমার ধারণা। বিশেষ করে একদিকে পায়ে প্লাস্টার করে দিদিন পুরো প্রদেশ চষে বেড়ানো, আর অন্যদিকে তার প্রতি বিজেপির আক্রমণ বাঙালি সমাজে গ্রহনযোগ্য হয়নি। বরং দিদি যেভাবে সামনে থেকে, ভাঙা পা নিয়ে সেসব আক্রমণের জবাব দিয়েছেন তা বাঙালির কাছে ঢের বেশি প্রশংসিত হয়েছে।

দিদি এখন ক্ষমতায়। দিদির শপথ নেয়ার দিনই তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীমহোদয়। এমনকি দিদিকে অভিনন্দিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের কাছে ভারতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি প্রদেশ হলেও ভারতের এই প্রদেশটির সাথে আমাদের নাড়ির যোগ। আমাদের টিভি সিরিয়াল, ঘোরাঘুরি, চিকিৎসা আর এমনকি ঈদ শপিংয়েও ঘুরে ফিরে চলে আসে পশ্চিমবঙ্গের নাম।

দিদিকে বাংলাদেশের বাঙালিরা বরাবরই দেখে এসেছে বাঙালিয়ানার অন্যতম প্রতীক হিসেবে। অথচ এহেন দিদির জমানাতেই এক তিস্তাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্কটা কেমন যেন প্যাঁচ খেয়ে গেল। সবার মনে এখন তাই প্রশ্ন ‘সামনে কী’? আমার ধারণা এবারের নির্বাচনটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য শিক্ষণীয়। আমার ধারণা বাঙালিয়ানা আর বাঙালিত্বের শক্তিতে ভর করে আবারও নবান্নে ফিরে এসে দিদি সামনে অনেক বেশি বাংলাদেশমুখী হবেন।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।