রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাস্থ্য ভাবনা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘ প্রাণ ’ আমরা প্রায় সবাই পাঠ করেছি । ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে / মানবের মাঝে বাঁচিবারে চাই ।’ কিন্তু মানুষ কিভাবে বাঁচতে চায় ? সে চায় আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু । সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকায় প্রকৃত বেঁচে থাকা । রহস্যসূত্র অন্বেষণের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্র – কবিতায় গানে । বিজ্ঞান - দীক্ষিত রবীন্দ্রনাথের মনোজগৎ এভাবে বারবার উন্মোচিত হয়েছে । কবির বিজ্ঞানপ্রীতি আমাদের মুগ্ধ করে । শুধু বিজ্ঞান মনস্কতা বা সচেতনতা নয়, বিজ্ঞানের বিস্তৃত ভুবনেও ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত । রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ করে ‘বিশ্ব পরিচয় লিখে ফেলেননি । বিজ্ঞানের জটিল বিষয় বোঝাতে যেয়ে বিশ্ব পরিচয় এ বাস্তব জীবন থেকে এমন উপমা - দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছেন , যা সহজেই কিশোর পড়–য়াদের বোধগম্য হয়ে ওঠে ।
কবির ছোট গল্পে ফটিক চরিত্র রচিত হয়েছিল আজ থেকে ১২৯ বছর আগে । “বালকের জ্বর অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রি প্রলাপ বকিতে লাগিল। বিশ্বম্ভরবাবু চিকিৎসক লইয়া আসিলেন।”অসুস্থতার বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়, ফটিক নিউমোনিয়া -তে আক্রান্ত হয়েছিল। মাথাব্যথা শিহরণ শীতবোধ জ্বরাক্রান্ত হবার পূর্বাভাস। এই শারীরিক অবস্থায় ফটিক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও উদ্ভ্রান্ত হয়ে মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে; রোগের প্রবণতা আরো সক্রিয় ও উজ্জীবিত হয়ে যায়। এই ঘটনাকে রোগের পূর্ববর্তী সক্রিয়করণ অবস্থা বলা হয়। শরীরে প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে আসে ও সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই বীজাণু সংক্রমণে এই রোগের সৃষ্টি হয়; যদিও আরো কয়েক ধরনের বীজাণুও এই অসুস্থতার কারণ হতে পারে। সংক্রমণের এক থেকে সাতদিনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকার পর এই রোগের প্রকাশ ঘটে। সহসা শিহরণ-সহ জ্বর ও তার ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকে ও রোগী কাতর হয়ে প্রলাপ বকতে থাকে, অনতিকালের মধ্যে রোগীর অবস্থা সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠে। যথাসময়ে চিকিৎসা না হলে সাতদিন থেকে দশদিনের মধ্যে চরম পরিণতি ঘটে। আগেই উল্লেখ করেছি , ‘ছুটি’ গল্প ১২৯৯ বঙ্গাব্দের (১৮৯২ খ্রি.) অর্থাৎ আজ থেকে ১২৮ বছর পূর্বে রচিত। রোগ নির্ণয়ের বিশেষ পদ্ধতি ও বীক্ষণাগারে পরীক্ষার এত ব্যাপকতা ছিল না। রঞ্জন রশ্মি প্রয়োগে রোগ নির্ধারণ প্রচলিত হয় নি। রঞ্জন রশ্মি আবিষ্কৃত হয় ১৮৯৫ সালে; তার প্রয়োগ পদ্ধতি আরম্ভ হয় আর কয়েক বছর পরে। এর থেকে বোঝা যায় মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে সবসময় ভাবতেন ।
মৃত্যু কাউকেই রেহাই দেয় না, এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু স্বাস্থ্য ও রোগভোগ সমাজের সবার ক্ষেত্রে কখনোই সমানভাবে প্রতিফলিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা ছিল যাপিত জীবনের নানান অনুসঙ্গের সাথে ব্যবহারিক শিক্ষার সংযোগ ঘটানো । ১৯৪০ সালের দিকে শান্তিনিকেতনের আশেপাশে গ্রামগুলোতে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা দেখেছিলেন । মৃত্যু সেইসময়ে গরিবদের যতটা প্রভাবিত করেছিল ততটা উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে নয়। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে গ্রাম-সমীক্ষার থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, গরিব নিন্মবর্ণের ওপরে এর বেশি প্রভাব পড়েছিল।
মধ্যবর্গীয় জাতিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ছিল যেখানে ১৪.০ শতাংশ নিন্মবর্গীয়দের মধ্যে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১৮.৯ শতাংশতে। সেইসময়ে রোগের যে প্রভাব শ্রীনিকেতনের আশেপাশের গ্রামগুলিতে ছিল তা দেখানো হয়েছে। এই তথ্য বিভিন্ন সমবায় সমিতি প্রতি মাসে শ্রীনিকেতনের পল্লি সংগঠন বিভাগকে পাঠাতেন। এই প্রতিবেদনের সব তথ্য এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ম্যালেরিয়া তো ছিলই কিন্তু তার সঙ্গে যক্ষা, ফুসফুসের নানারকম রোগ, পাকযন্ত্রের বিশেষ করে ক্ষুদ্র অগ্নাশয়ের পীড়া, আমাশয় ইত্যাদির প্রকোপ যথেষ্ট ছিল। এই রোগের চিত্রের থেকে বোঝা যায় যে বীরভূমের সেইসময়ের ক্রমশ ভেঙেপড়া আর্থিক কাঠামো এলাকার জনসাধারণের স্বাস্থ্যের ওপরে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীনিকেতনে নিবিড় এলাকার অন্তর্ভুক্ত সুপুর গ্রামে সমাজতাত্তি¡ক সমীক্ষা করা হয়। সমীক্ষায় গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে গ্রামের লোকদের স্বাস্থ্যসমীক্ষাও করা হয়। সেই সময়ের কোনো একটি গ্রামের সব লোকদের স্বাস্থ্যসমীক্ষা বোধহয় এই প্রথম করা হয়। এই সমীক্ষা থেকে গ্রামগুলির স্বাস্থ্য, গ্রামবাসীরা বিশেষ করে কী ধরনের রোগ থেকে ভুগতেন, তার ধারণা করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপুর গ্রামে যে সমীক্ষা করা হয় তার থেকে বর্ধিষ্ণু একটি গ্রামের স্বাস্থ্যের অবস্থার কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। সমীক্ষালব্ধে এই তথ্যের থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৩৯ সুপুর গ্রামে এক বছরে মোট ৩৪ জন মৃত্যুমুখে পড়েন।
এর কারণগুলির মধ্যে ম্যালেরিয়াতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সর্বাধিক-৭৬.৪৭ শতাংশ (২৬ জন)। অন্যান্য যেসব কারণে মৃত্যু ঘটেছিল তার মধ্যে নিমুনিয়াতে ৩জন, কলেরাতে ১ জন ও অন্যান্য অসুখে ৪ জন মারা গিয়েছিলেন। গ্রামে কলেরার প্রাদুর্ভাব বহু বছর আগে ১৮৭৪ সালে হয়েছিল কিন্তু এই সমীক্ষার সময় তা কদাচিৎ হত। অন্যদিকে অন্যান্য রোগের প্রকোপ গ্রামে ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল। গ্রামের লোকেদের মধ্যে বিভিন্ন যেসব রোগের উপসর্গ পাওয়া গিয়েছিল তাতে দেখা যাচ্ছে যে কুষ্ঠরোগে ৪ জন (একজনের সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল), যায় ৩ জন, হাঁপানি ১০ জন, দৈহিক পক্ষাঘাতে (প্যারালিসিস) ১ জন আক্রান্ত ছিলেন। গ্রামে যৌন রোগাক্রান্ত রোগীর সংখ্যা শুধু অনেক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া গ্রামের লোকেরা প্রতি বছর ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হবার ফলে অধিকাংশ লোকের প্লীহাবৃদ্ধি ঘটেছিল।
কবি কতটা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন যে আজ ৭০ বছর আগে ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য শ্রীনিকেতন ম্যালেরিয়া রোগ নির্ণয়ের একটি পরীক্ষাগার গড়ে তুলেছিলেন । এর মাধ্যমে গ্রামগুলিতে ম্যালেরিয়ার প্রভাব কতটা বাড়ছে বা কমছে তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে গোয়ালপাড়া, বল্লভপুর, লোহাগড়, বিনুরিয়া, পারুলডাঙা, শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনের এলাকার মধ্যে অবস্থিত সাঁওতাল গ্রামগুলিতে ও আরও কয়েকটি গ্রামে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে ওই গ্রামগুলিতে ম্যালেরিয়া হার অনেক কমে যায়। এর প্রভাব শ্রীনিকেতনের হাসপাতালেও পড়ে। এখানে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসার জন্যে আসা রোগীর সংখ্যা কমে যায় লক্ষ্যণীয়ভাবে।
স্বাস্থ্য সমবায় সমিতির এলাকায় ম্যালেরিয়া যথেষ্ট ভালো প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। শ্রীনিকেতন পল্লিসেবা সমিতি তাই ডি.ডি.টি. ছড়ানোর কাজ করা ও ব্রতীদলের মাধ্যমে গ্রামের জঙ্গল পরিষ্কার করা, কুইনাইন ও প্যালুডিন ট্যাবলেট বিতরণ করার মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ বজায় রাখে। অন্যদিকে, বসন্তরোগের প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন গ্রামে প্রতিষেধক ইনজেকশন বা ভ্যাকসিনেশন (মোট ১০১৫ জনকে) দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া জলবাহিত রোগের প্রকোপ যেমন কলেরা, নানা ধরনের আমাশয়, পেটের অসুখ, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগের হার যে যথেষ্ট পরিমাণে বজায় ছিল। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ একেবারে নির্মূল না হলেও এর প্রকোপ আস্তে আস্তে কমতে থাকে। অন্যদিকে, জলবাহিত ও বায়ুবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে।
শ্রীনিকেতনের চিকিৎসাকেন্দ্রে রুগিদের চিকিৎসার যে তথ্য আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সমস্ত রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়া রোগের সংখ্যা ১৯২৮ থেকে ১৯৩১ এর মধ্যে ৩৭.১৮% থেকে ৬৬.৬৭%-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ তা ১৯.৪%-এর নেমে আসে। কুষ্ঠ, কালাজ¦র, শিশুমৃত্য, অপুষ্টি, মাতৃত্বজনিত মৃত্যু ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই শুধু যে করা হয়েছে তা নয়, রোগের বিরুদ্ধে মানুষের চেতনা বৃদ্ধির জন্য নানা উপায় গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু তার থেকেও বড়োকথা বোধহয় রোগকে ভাগ্যের দান বলে মেনে নেওয়ার প্রবণতা কমতে থাকা। বিনুরিয়ার সাঁওতালরাও একসময়ে তাদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য সমবায়ের সুযোগ করে দেওয়ার দাবি জানিয়ে দরবার করেছে। এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। গ্রাম-উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে রোগের বিরুদ্ধে সমবায়গঠন করে এই সংগ্রাম একদল মানুষকে বাঁচার মতো করে বাঁচতে শিখিয়েছিল। তার কিছু প্রভাব ক্ষীণ হলেও সমাজের ওপর যে পড়েছিল তার এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৮০ বছর জীবনে কখনই সাহস হারাননি ।
সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মান
মুক্ত করো ভয়, আপনমাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।
দুর্বলের রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়, নিজের ’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়\
পুনশ্চ : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ‘ ডক্টরেট , উপাধি দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। রামগড়ের ঠিকানায় যাওয়া কবির সব চিঠির খামের ওপর লেখা থাকতো ‘ ডক্টর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ’ । দেখে শুনে রামগড়ের পোস্টমাস্টার চারদিকে রাষ্ট্র করে দেন , কলকাতা থেকে একজন বিখ্যাত ডাক্তার এসেছেন রামগড় পাহাড়ে । পাহাড়ি মানুষদের মধ্যে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত ।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক।
এইচআর/এএসএম