দুই মির্জার শব্দ বোমা যেন বাতাসে মিলিয়ে না যায়
মির্জা কাদের বসুরহাট পৌরসভার টানা তিনবারের চেয়ারম্যান, তিনি চেয়ারম্যান হয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নেই। কিন্তু এখন তিনি সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। কারণ তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন। মির্জা কাদের একজন ত্যাগী এবং পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতা। কিন্তু অভিমানেই তিনি দল ছাড়লেন। কোন অভিমানে দল ছেড়েছেন, সেটাও গোপন করেননি। একজন স্থানীয় নেতার বক্তব্য যে সারাদেশের রাজনীতি কাঁপিয়ে দিল, তার কারণ মির্জা কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের আপন ছোট ভাই।
শুরুতে তার অভিমানের তীর ছিল ভাবি ইশরাতেন্নেছা কাদেরের দিকে। কিন্তু বড় ভাই কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে, এখন তিনি মুখ খুলেছেন আপন বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধেও। মির্জা কাদের হঠাৎ করে বিপ্লবী হননি। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের ইশতেহার প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম শব্দ বোমা ছোঁড়েন। তারপর থেকে তিনি একের পর এক বোমা মেরেই যাচ্ছেন। তিনি সত্য বলার পণ করেছেন। দল ছাড়লেও তিনি সত্যকথন ছাড়েননি। মজাটা হলো তিনি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে, দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে, নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে যা বলছেন; তা কিন্তু একবিন্দুও মিথ্যা নয়। কিন্তু এক মির্জা কাদেরেই উন্মুক্ত হয়ে গেল আওয়ামী লীগের দুরবস্থা। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় হতে পারতো। মির্জা কাদেরের অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করা ও ব্যবস্থা নেয়া। অথবা একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার দায়ে মির্জা কাদেরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু আওয়ামী লীগ কিছুই করেনি।
মাঝে ঝরে গেছে দুটি প্রাণ। এক ছোট ভাইকে সামলাতেই ওবায়দুল কাদেরের যে অসহায় অবস্থা, তাতেই বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি কতটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে লড়াই হয়, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর। নির্বাচনের আগে অনেক হম্বিতম্বি হয়, বহিস্কারের হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয় না। যারা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নির্বাচনে অংশ নেন, তারাও জানেন, এসবই বাতকা বাত। জিতে আসলে তো বটেই, হারলেও প্রথম কিছুদিন সমস্যা হলেও দলের সঙ্গেই থাকতে পারবেন। তাই তারা ঝুঁকিটা নেন- জিতে গেলে তো ডাবল লাভ, দলও থাকলো, পদও থাকলো। তবে মির্জা কাদেরের বিষয় অন্য। তিনি যতটা না রাজনীতি, তারচেয়ে অনেক বেশি পারিবারিক বিরোধ। আওয়ামী লীগের তৃণমূল যে অনেক আলগা হয়ে গেছে, সেটা সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক হেফাজতের তান্ডব আওয়ামী লীগ মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু মোকাবেলা নয়; ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সোনারগাঁওয়ে তারা নিজেদের সম্পদও রক্ষা করতে পারেনি। হেফাজত যেভাবে বেছে বেছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে, তাতে তাদের অসহায় মনে হয়েছে।
এক মির্জার শব্দ বোমার আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই মাঠে নেমেছেন আরেক মির্জা। এই মির্জা অবশ্য আওয়ামী লগের নয়, তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা তো বটেই, মির্জা আব্বাস ঢাকা মহানগর বিএনপির একচ্ছত্র নেতা। সাদেক হোসেন খোকার মৃত্যুর পর মহানগরের রাজনীতিতে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। হাবিব-উন নবী সোহেল চেষ্টা করলেও মির্জা আব্বাসকে তাকেও ছাড় দিতে তৈরি নন। এই মির্জা আব্বাস সম্প্রতি রীতিমত পারমাণবিক শব্দ বোমা ছুড়েছেন। গত ১৭ এপ্রিল ছিল বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার নয় বছর পূর্তি। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে গাড়িচালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন ইলিয়াস আলী। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপুটে ছাত্রনেতা ইলিয়াস আলী মূল রাজীতিতে এসে সিলেটে সাইফুর রহমানের সাথে বিরোধে জড়ান। সাইফুর রহমানের মৃত্যুর পর সিলেটে বিএনপির রাজনীতির একক নিয়ন্ত্রণ ছিল ইলিয়াস আলীর হাতে। ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে বিএনপিসহ সব মহল এরজন্য সরকারকে দায়ী করে আসছিল। একজন মানুষ গুম হয়ে গেলে, গুম যেই করুক, দায় কিন্তু সরকারকে নিতেই হবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু এই নয় বছরে সরকার ইলিয়াস আলীকেও খুজেঁ বের করতে পারেনি। তাকে কে বা কারা গুম করেছে, তাদেরও খুঁজে বের করতে পারেনি।
ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কিন্তু মির্জা আব্বাস আগ বাড়িয়ে সরকারকে সেই দায় থেকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। প্রশাসনিক দায় না হলেও রাজনৈতিক দায় থেকে আওয়ামী লীগকে মুক্তি দিয়েছেন মির্জা আব্বাস। ১৭ এপ্রিল এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মির্জা আব্বাস দাবি করেন, ইলিয়াস আলীকে সরকার গুম করেনি। তিনি গুমের জন্য প্রকারান্তরে বিএনপি নেতাদেরই দায়ী করে বলেন, ‘ইলিয়াস গুম হওয়ার আগের রাতে দলীয় অফিসে কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর বাগ্বিতণ্ডা হয় মারাত্মক রকমের। ইলিয়াস খুব গালিগালাজ করেছিলেন তাঁকে। সেই যে পেছন থেকে দংশন করা সাপগুলো, আমার দলে এখনো রয়ে গেছে। যদি এদের দল থেকে বিতাড়িত না করেন, তাহলে কোনো পরিস্থিতিতেই দল সামনে এগোতে পারবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘গুমের সংবাদ পাওয়ার পর পরিচিত যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান, ইলিয়াস আলীকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং যে পুলিশ কর্তকর্তাদের সামনে তাঁকে নেওয়া হলো, সেই পুলিশ কর্মকর্তাদের আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই খবর আপনারা কেউ জানেন না। পুলিশের গাড়িতে যে কজন কর্মকর্তা ছিলেন, তাঁদের আজও পাওয়া যায়নি। যেমন ইলিয়াস আলীর চালককেও পাওয়া যায়নি। তাহলে এই কাজটা করল কে?’ তিনি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমি জানি আওয়ামী লীগ সরকার গুম করেনি। তাহলে গুমটা করল কে? এই সরকারের কাছে এটা আমি জানতে চাই।’
মির্জা আব্বাসের মত আমিও সরকারের কাছে জানতে চাই, ইলিয়াস আলীকে গুমটা করলো কে? আওয়ামী লীগ করুক, বিএনপি করুক; সরকারের দায়িত্ব হলো ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করা। মজাটা হলো মির্জা কাদেরের বক্তব্যের ব্যাপারে সরকার যেমন নির্বিকার, মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের ব্যাপারেও নির্বিকার। আওয়ামী লীগে নেতারা মির্জা আব্বাসের বক্তব্য ধরে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করলেও প্রশাসন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। অথচ মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের পর পুলিশের অবশ্যই উচিত ছিল মির্জা আব্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদ করা। কোন নেতার সাথে বাগবিতন্ডা হয়েছিল, কোন পুলিশ কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি; সেটার সত্য বের করা পুলিশের দায়িত্ব।
ফ্রুটিকার একটি বিজ্ঞাপন নিশ্চয়ই আপনাদের সবার মনে আছে। ফ্রুট জুস ফ্রুটিকা এতটাই পিওর, এটা খেলে সবাই সত্য বলতে থাকে। এখন মির্জা কাদের আর মির্জা আব্বাস কোন দোকানের ফ্রুটিকা খেলেন কে জানে। তাদের দুজনের সত্যকথনে দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ আর বিএনপির কাঁপাকাপি অবস্থা। অবশ্য মির্জা আব্বাস ফ্রুটিকা হজম করতে পারেননি। পরদিনই তিনি সব দায় মিডিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। কারণ তার বক্তব্যের ভিডিও এখনও ইউটিউবে আছে। আর ভার্চুয়াল সে অনুষ্ঠানে দলের অনেক নেতাই সংযুক্ত ছিলেন। এখন দল তার কাছে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে।
বিএনপি মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে অবস্থা নেবে জানি না। তবে প্রশাসনের অবশ্যই উচিত মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের সূত্র ধরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইলিয়াস আলীর গুম রহস্য উন্মোচন করা। একই সঙ্গে মির্জা কাদেরের উত্থাপিত অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করা এবং দায়ীদের ব্যবস্থা নেয়া। ফ্রুটিকা খেয়ে বলুন আর না খেয়ে; মির্জা কাদের এবং মির্জা আব্বাস হয় সত্যি বলেছেন, নয় মিথ্যা। দুটি তো এক সাথে হতে পারে না। সত্যি বললে অবশ্যই তাদের বক্তব্য ধরে কাজ করতে হবে। আর মিথ্যা বললেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দুই মির্জার শব্দ বোমা যেন নিছক বাতাসে মিলিয়ে না যায়।
২৫ এপ্রিল, ২০২১
এইচআর/এএসএম