চীনে বিশ্বের বৃহত্তম ৫জি মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং অতঃপর
আমি যখন কোনো ব্রান্ডের পণ্য একবার ব্যবহার করা শুরু করি, তখন সেটা কোনো ঝামেলা না-করা পর্যন্ত ছাড়ি না। চীনে আসার পর আবাম ছালাউদ্দীন ভাই ‘কানথেন’ ব্রান্ডের পানি খাওয়া শেখালেন, আজও সেই পানি খাচ্ছি; চীনা সহকর্মী আকাশ পরিচয় করিয়ে দিলেন চীনের ‘সিয়াওমি’ ব্রান্ডের স্মার্টফোনের সঙ্গে, আজও সিয়াওমি ছাড়িনি। এমনকি, আমার ঘরের বায়ু বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রটিও সিয়াওমি ব্রান্ডের! আমি যখন কোনো ব্রান্ডের পণ্য একবার ব্যবহার করা শুরু করি, তখন সেটা কোনো ঝামেলা না-করা পর্যন্ত ছাড়ি না। চীনে আসার পর আবাম ছালাউদ্দীন ভাই ‘কানথেন’ ব্রান্ডের পানি খাওয়া শেখালেন, আজও সেই পানি খাচ্ছি; চীনা সহকর্মী আকাশ পরিচয় করিয়ে দিলেন চীনের ‘সিয়াওমি’ ব্রান্ডের স্মার্টফোনের সঙ্গে, আজও সিয়াওমি ছাড়িনি। এমনকি, আমার ঘরের বায়ু বিশুদ্ধকরণ যন্ত্রটিও সিয়াওমি ব্রান্ডের!
আমার প্রথম সিয়াওমি স্মার্টফোনটি ছিল ৪জি কম্পিটিবল। কিন্তু তখন আমার মোবাইল অপারেটর আমাকে দিত ৩জি সেবা। যখন ৪জি সেবা চীনের বাজারে এলো, তখন অপারেটরের কাছ থেকে ম্যাসেজ পাওয়া শুরু করলাম। ৩জি থেকে ৪জি-তে যাওয়ার আহ্বান, সঙ্গে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার অফার। আমি নির্বিকার। স্মার্টফোনে আমার যা কাজ, তা ৪জি দিয়েই দিব্যি চলছিল। তো একদিন দেখি, আমার ফোনে ৪জি সাইন দেখাচ্ছে। বুঝলাম, মোবাইল অপারেটর আমাকে না-চাইতেই ৪জি সেবা দেওয়া শুরু করেছে এবং এর জন্য এক্সট্রা কোনো চার্জও করছে না।
কিছুকাল যেতে-না-যেতেই ৫জি’র ঘন্টা বাজতে শুরু করলো; বাজারে আসতে শুরু করল ৫জি স্মার্টফোন। সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার ফোন যখন চেঞ্জ করার দরকার হবে, তখন ৫জি ফোন নেব। একসময় দরকার হলো। কিন্তু সিয়াওমির ৫জি ফোন তখনও বাজারে আসেনি। আমি একান্ত বাধ্যগত ভক্তের মতো অপেক্ষায় থাকতে লাগলাম। একসময় তিনি বাজারে এলেন; মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো বউ আমাকে একটি কিনেও দিলেন।
গিফ্ট পেলে খুশি হয় না—এমন মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়নি; জন্মাবেও না। আমিও খুশি হলাম, আর অপেক্ষায় থাকলাম ফ্রি ৫জি সেবার জন্য। সবরের ফল মিঠা হয়। কিছুদিন আগে আমার মোবাইল অপারেটর (চায়না মোবাইল) ম্যাসেজ পাঠালো। চীনা ভাষায় অবশ্যই। সেটা মোবাইলফোনের ট্রান্সলেটর অ্যাপে ফেলে দেখলাম, ওরা আমাকে আগামী এক বছরের জন্য ফ্রি ৫জি সেবা দেবে। ট্রান্সলেটরের ওপর শতভাগ ভরসা করা মুশকিল। আবার সেটা ভ্যারিফাই করার আগ্রহও অনুভব করলাম না। কারণ, আমার কাছে ৪জি আর ৫জি’র মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
আসলে এখনও চীনে ৪জি মোবাইল প্রযুক্তিই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৪জি এর পিকে পৌঁছে গেছে, ৫জি ধীরে ধীরে এর জায়গা দখল করে নিচ্ছে। এখন যেমন ৩জি’র বলতে গেলে তেমন কোনো অস্তিত্বই নেই, ঠিক তেমনি একসময় চীন থেকে ৪জি-ও বিদায় নেবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৫ সাল নাগাদ চীনের মোট মোবাইল সংযোগের ৫৩ শতাংশ হবে ৪জি এবং বাকি ৪৭ শতাংশ দখল করে নেবে ৫জি প্রযুক্তি। এমনটা আসলে হবেও। কারণ, চীনারা আমার মতো ব্যাকডেটেড নয়; তাদের অধিকাংশই নতুনত্বের পূজারি!
এক জরিপ অনুসারে, চীনারা বিশ্বের যে-কোনো দেশের মানুষের চেয়ে ৫জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। গত বছর ৬২ শতাংশ চীনা ৫জি-র ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। আর ইতোমধ্যেই যারা ৫জি মোবাইল সংযোগ ব্যবহার করছেন, তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই বলেছেন, ৫জি টেলিকম সেবা তাদের চাহিদা ভালোভাবেই মেটাচ্ছে, তারা সন্তুষ্ট।
৫জি মোবাইল সেবা পেতে ৫জি স্মার্টফোন লাগে। চীনে তাই ৫জি স্মার্টফোনের বিক্রিও হু হু করে বাড়ছে। ২০২০ সালে ১৬ কোটি ৩০ লাখ ৫জি স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে চীনের মূল ভূভাগে (হংকং, ম্যাকাও, তাইওয়ান বাদে)। বলা বাহুল্য, এই ১৬ কোটি ৩০ লাখের মধ্যে স্ত্রীর কাছ থেকে গিফ্ট হিসেবে পাওয়া আমার সিয়াওমি মোবাইলটিও রয়েছে।
৫জি স্মার্টফোনের বিক্রি বাড়া মানেই ৫জি সংযোগ-গ্রহীতার সংখ্যাও বাড়া। ২০২০ সালে চীনে প্রায় ২০ কোটি নতুন গ্রাহক ৫জি সংযোগ নিয়েছেন বা পেয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে যত ৫জি সংযোগ আছে, তার ৮৭ শতাংশই চীনে। গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন্স এসোসিয়েশান গত ২২ ফেব্রুয়ারি এক রিপোর্টে এ তথ্য জানিয়েছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০২৫ সাল নাগাদ চীনে ৫জি সংযোগের সংখ্যা ৮২ কোটি ২০ লাখে উন্নীত হবে। এমনটাই হবে। কারণ, ২০২০ সালেই চীনে মোবাইল সংযোগ-গ্রহীতার সংখ্যা ছিল ১২২ কোটি। তাদের মধ্যে আবার ৯৯ কোটি মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যাদের সংখ্যা ২০২৫ সাল নাগাদ আরও ২০ কোটি বাড়বে। ইন্টারনেটের গতি নির্ভর করে সংযোগের ওপর। ৫জি সংযোগের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার এটা মূল কারণ।
৫জি সংযোগের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এ খাতে কাড়ি কাড়ি টাকা বিনিয়োগ করছে চীনের টেলিকম কোম্পানিগুলো। ২০২০ সালে মহামারির মধ্যেই তারা চীনজুড়ে ৬ লাখ ৫জি বেইজ স্টেশান নির্মাণ করেছে। এখন চীনে ৫জি বেইজ স্টেশানের মোট সংখ্যা ৭ লাখ ৯২ হাজারের বেশি। অন্যভাবে বললে, চীনে ইতোমধ্যেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম ৫জি মোবাইল নেটওয়ার্ক। চলতি বছর আরও ৬ লাখ ৫জি বেইজ স্টেশান নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
৫জি সংযোগের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে নেটওয়ার্কিংয়ের দিক দিয়ে সবাইকে পেছনে ফেললেও, গতির দিক দিয়ে এক্ষেত্রে এখনও পিছিয়ে আছে চীন। মোবাইল নেটওয়ার্ক স্পিডের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৩৯টি অগ্রসর দেশের মধ্যে চীনের অবস্থান চতুর্থ। বলা বাহুল্য, তালিকার শীর্ষে উঠতে চায় চীন, চীনের মোবাইল অপারেটররা। এক রিপোর্ট অনুসারে, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে চীনা টেলিকম অপারেটারগুলো বিনিয়োগ করবে ২১০০০ কোটি মার্কিন ডলার, যার ৯০ শতাংশই ব্যয় হবে ৫জি প্রযুক্তির উন্নয়নে।
চীনের ৫জি প্রযুক্তিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির চাপে পড়েই ব্রিটেন হুয়াওয়েইর সঙ্গে করা ৫জি নেটওয়ার্কিংসংশ্লিষ্ট চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করেছে। কিন্তু, এ ধরনের বাধা অতিক্রম করেই ৫জি প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে যাচ্ছে চীন। শুধু ৫জি নয়, চীনের চতুর্দশ পাঁচসালা পরিকল্পনায় ৬জি প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বস্তুত, আগামী পাঁচ বছর ডিজিটাল ইকনোমি হবে চীনের অন্যতম মূল চালিকাশক্তি।
লেখক : চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)-র বার্তা সম্পাদক।[email protected]
এইচআর/এমকেএইচ