সাইবার আইনের সাংবিধানিক বিশ্লেষণ ও ব্যবহার
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ২২ ধারায় বিভিন্ন মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স দেয়া হয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে ২৬ ও ৪৫ ধারায় লাইসেন্স বাতিল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়। কিন্তু মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগে মানুষ ভিন্ন ধরনের অপরাধ করতে থাকে যা এই আইনে প্রতিকার দেয়া সম্ভব ছিল না। তাই অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে প্রতিকার প্রদানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ প্রনয়ণ করা হয়।
প্রযুক্তি ব্যবহারকারীরা ১১ ধাপে সাইবার অপরাধ করছে যেমন: সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, রাজনৈতিক অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ, গ্যাং কালচার, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, আসক্তি এবং নারীদেরকে ব্ল্যাকমেইলিং। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ সালের ৬৮ ধারা মতে ঢাকায় একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যাল স্থাপিত হয়েছে। আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের করতে পারেন অথবা পুলিশের কাছে অভিযোগ দেবেন এবং পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত আদালতে মামলাটি গ্রহণের জন্য প্রেরণ করবেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ আইনের অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগ রয়েছে অর্থাৎ ৪(১) ধারা মতে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাহিরে কোনো অপরাধ সংঘটন করলে যদি এই আইনের অধীন দণ্ডযোগ্য হয়, তাহলে তিনি বাংলাদেশেই অপরাধ সংঘটন করেছেন বলে বিবেচিত হবে এবং এই দেশের আদালতে মামলা করা যাবে।
আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮ (১) বর্ণিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই নীতিসমূহ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। অর্থাৎ এই মূলনীতি গুলো সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত এবং লঙ্ঘন করলে অনুচ্ছেদ ৭ক অনুসারে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২(প) এ ‘‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’’ অর্থ যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্ধুদ্ধ করিয়াছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ। ফলে একই অপরাধ প্রযুক্তির মাধ্যমে সংগঠিত হলে ২১(১) অনুয়ায়ী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান তাহলে ১০ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং পুনরায় সংঘটন করলে, তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে, বা ৩কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। উল্লেখ্য, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিধান সংবিধানের ৪(১) ও (২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ও নিশ্চয়তা প্রদান করা হলেও ৪(৪) অনুচ্ছেদে বলে দেওয়া হয়েছে জাতীয় পতাকা, সংগীত ও প্রতীক সম্পর্কিত বিধানাবলী আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে। ফলশ্রুতিতে এই বিধানাবলী লঙ্ঘনের শাস্তিও সংশ্লিষ্ট আইন দ্বারাও আরোপিত হবে।
উল্লেখ্য, আমাদের সংবিধানের ৪ ক অনুযায়ী দেশে বিদেশে সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত সকল প্রতিষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি যথাযথ মর্যাদায় প্রদর্শন ও সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক যা সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধানের কোন অংশ লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনে সহায়তা ও ষড়যন্ত্র করা রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। তাই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি বা ছবি অবমাননা অথবা ভাংচুরের অভিযোগে মানহানির মামলা কোনভাবেই নয়, বরং ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করতে হবে যার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তবে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা আমলে নেয়ার আগে অত্র আইনের ১৯৬ ধারা মোতাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন পূর্বক অনুমোদন লাগবে। মূলত যে অপরাধ প্রযুক্তির আশীর্বাদে অভিশাপ হয়ে এসেছে এবং এই অপরাধটি প্রতিরোধের জন্য এই আইনের ২৮ ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে তা হলো 'হ্যাকিং' অর্থাৎ কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করে তার তথ্য বা সেই ডিভাইসের বিনাশ, বাতিল, পরিবর্তন বা ক্ষতিসাধন করলে অনধিক ১৪ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আর দ্বিতীয় বার সংঘটন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
একইভাবে আমদের সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদের বাক্ স্বাধীনতার সীমানা অতিক্রম করে যদি মানুষের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন করে তবে তা শুধু শিষ্টাচার বহির্ভূত হবেনা, এটি একটি অপরাধ। বর্তমানে একই অপরাধ ডিজিটাল মাধ্যমে সংগঠিত হলে অন্য কোন ব্যক্তি নয়, উপযুক্ত কর্তৃত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৯ ধারার অধীনে মানহানির মামলা করার সুযোগ রয়েছে, যেখানে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারা হতে কেবল মানহানির সংজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে।মানহানিকর কোনও তথ্য-উপাত্ত প্রমাণিত হলে ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড এবং পুনরায় একই অপরাধ করেন তবে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে।
এছাড়াও ২৫ (১) ধারায়, ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শন বা অপমান করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৩ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৩ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। দ্বিতীয় বার সংঘটন করলে, তাহা অনধিক ৫ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এতে সুবিধা হলো দণ্ডবিধির আইনে মানহানির মামলায় সাধারণত কোন পরিনতি নেই বা ফলাফল পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে মানহানি যদি প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে করা হয় সেক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অত্যন্ত কার্যকর হয় এবং এই বিশেষ আইনে দায়েরকৃত মামলার পরিনতি ও প্রতিকার অত্যন্ত ফলপ্রসূ। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুসারে মানহানির মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ করলে আদালত তা আমলে নিবেন না।
বাংলাদেশ প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ এবং সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদ মতে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে। এছাড়াও অনুচ্ছেদ ১২ অনুযায়ী ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপব্যবহার এবং কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি নিপীড়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।উপরন্তু অনুচ্ছেদ ২৮(১) অনুসারে কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি বৈষম্য যাবেনা। ফলে স্বীয় ধর্ম পালন মৌলিক অধিকার, যাতে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এবং রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব তা নিশ্চিত করা। আর যদি কেউ প্রযুক্তির ব্যবহার করে তা লঙ্ঘন করে তার প্রতিকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রয়েছে। অত্র আইনের ২৮(১) ধারা মতে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উস্কানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহবে একটি অপরাধ এবং তিনি অনধিক ৫ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। যদি তিনি দ্বিতীয় বার একই অপরাধ করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১০ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
সাইবার অপরাধের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, যা প্রতিরোধে এই আইনের ২৭(১) অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করা এবং জনগণের মধ্যে ভয়ভীতি সঞ্চার করিবার অভিপ্রায়ে কোনো কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বৈদেশিক রাষ্ট্রের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বা জনশৃঙ্খলা পরিপন্থি কোনো কাজ সাইবার সন্ত্রাস বলে গণ্য হবে এবং অনধিক ১৪ বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং পুনরায় অপরাধ করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বা অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। অপরদিকে সাইবার অপরাধের সবচেয়ে অনিয়ন্ত্রিত দিক হলো গুজব রটানো, যা দাবালনের মতো মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়।
তাই এই অপরাধ প্রতিরোধে অত্র আইনের ৩১(১) ধারা মতে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যা কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৭ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। যদি দ্বিতীয় বার সংঘটন করেন, তাহা হইলে অনধিক ১০ বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
উল্লেখ্য, যদি কোন ব্যক্তি ফেসবুকে উপরোক্ত অপরাধ করে কোন পোস্ট দেন এবং অন্য কোন ব্যক্তি তা শেয়ার করেন বা লাইক বা কমেন্ট দ্বারা উতসাহ প্রদান করেন সেই ব্যক্তিও এই আইনের ৩৫(১) অনুসারে অপরাধ সংঘটনে সহায়তার কারণে মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রহিয়াছে, সহায়তাকারীও সেই দণ্ডেই দণ্ডিত হইবেন। তাই যেকোনো পোস্ট দেয়া বা শেয়ার, লাইক, কমেন্ট করার আগে বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে এবং অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
Bangladesh Cyber Crime Awareness (CCA) ফাউন্ডেশনের গবেষণায় ওঠে এসেছে বর্তমানে দেশে যত সাইবার অপরাধ হয় তার প্রায় ৭০ (৬৭.৯) শতাংশের শিকার হচ্ছে নারী। যেসব অপরাধের শিকার হয়ে ভুগতে হয় নারীদের সেগুলো হচ্ছে: ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া বা হুমকি দেওয়া বা হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করা, ফেসবুক আইডি হ্যাক করা, ব্ল্যাকমেইলিং করা, ছবি বা ভিডিও এডিট বা সুপার ইম্পোজ করে ছড়িয়ে দেওয়া, পর্নোগ্রাফি ছবি দিয়ে আপত্তিকর কনটেন্ট বা ফেক আইডি তৈরি করা, সাইবার বুলিয়িং বা ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়া, হয়রানিমূলক এসএমএস, মেইল বা লিংক পাঠানো।
CCA ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট মতে, সাইবার অপরাধের শিকার নারীরা ৮০.৬ শতাংশই আক্রান্ত হওয়ার পরও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করে না। তাই ভুক্তভোগীরা যেন ভয়ভীতিহীনভাবে অভিযোগ জানাতে পারেন সেজন্য 'Police Cyber Support for Women' নামে একটি অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ চালু করা হয়েছে। যেখানে অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত এবং পরামর্শ প্রদানসহ সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা থাকবেন পুলিশের নারী সদস্যরা। অভিযোগকারী নারী নিজের পরিচয় গোপন রেখেও নিজের ওপর সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে প্রতিকার চাইতে পারবেন। অসুবিধা হচ্ছে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা চলাকালে অনেক অভিভাবক মেয়ের বিয়ে হয়ে হওয়ায় বা ভুক্তভোগী নিজে বিয়ে না হওয়ার আশংকায় এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে শালিস করায় মামলা আর পরিচালনা করতে আগ্রহী থাকেন না অথবা মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এতে একদিকে যেমন ভুক্তভোগী বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন, অপরদিকে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে এবং নতুন করে অপরাধ সংগঠনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে! ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও ক্রাইম ডিভিশন সূত্রেমতে, সাইবার অপরাধের মধ্যে পর্নোগ্রাফি মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা হয়েছে যথাক্রমে ২৩২, ২০৬, ২৮০, ৩৭৩ ও ৫৪০টি যা আপোস মিমাংসার ফসল ও উদ্বেগজনকও বটে। মনে রাখতে হবে৷ আর এই আইনের ১৮ ধারায় ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে বেআইনী প্রবেশের অপরাধ কেবলমাত্র আপোসের বিধান রাখা হয়েছে, অর্থাৎ অন্য সকল সকল প্রকার ও সব ধারার অপরাধ আপোস যোগ্য।
উল্লেখ্য যে, এই আইনে কিছু ছোট অপরাধ জামিন যোগ্য বলা হলেও গুরুতর ও বেশির ভাগ অপরাধই অজামিন যোগ্য। কিন্তু ৪০ ধারা অনুযায়ী তদন্ত মোট ১০৫ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে, না হলে ট্রাইব্যুনালের অনুমোদনক্রমে যৌক্তিক সময় বর্ধিত করার বিধান থাকলেও ট্রাইব্যুনালের অনুমতি না নেয়ার কারণে অনেক অপরাধী জামিন পেয়ে যাচ্ছেন এবং বের হয়ে ভুক্তভোগীকে হুমকি দেয়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। আবার বেশির ভাগ মামলা সাধারণ আদালতে দায়ের হওয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ ৫০ ধারায় বলা আছে মামলা পরিচালনায় ফৌজদারি কার্যবিধি প্রয়োগ হবে, আর ফৌজদারি কার্যবিধিতে তদন্তের সুনির্দিষ্ট সময় সীমা নেই। তবে এই বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্টে একটি রুল জারি করা হয়েছে, রুলটি নিষ্পত্তি হলে এই আইনী জটিলতা দূর হবে বলে আশা করা যায়। এই আইনের ৩৭ ধারায় বিশেষ বিধান হলো ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষতির শিকার হলে সীমিত হলেও ক্ষতিপূরণের বিধানও রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালে দেশে করোনাকালীন সময়ে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারণা৷ একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে তেমনি সচেতন নাগরিকগণের আইনের আশ্রয়লাভের দৃশ্যমান চিত্র ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও ক্রাইম ডিভিশন সূত্রে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালে সারা দেশে সাইবার অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে ৬৩৮টি, যা ২০১৬ সালে বেড়ে হয় ৯২৩টি। একইভাবে ২০১৭ সালে ১০৫৮টি, ২০১৮ সালে ১১৩৬টি এবং ২০১৯ সালে হয়েছে ১৪৫৬টি মামলা। যদিও দেশে পর্যাপ্ত ফরেনসিক ডিভাইস নেই এবং এবিষয়ক ল্যাবও তেমন গড়ে ওঠেনি, তবুও সাইবার থানার কাঠামোসহ পুলিশ সদর দফতরে ইতিমধ্যে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে৷ প্রস্তাবিত এই সাইবার থানার প্রধান হবেন একজন পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা৷ প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন পুলিশ কর্মকর্তারা এখানে নিয়োগ পাবেন৷ পাশাপাশি প্রযুক্তি বিষয়ে তাদের একাধিক প্রশিক্ষণও হবে৷ কার্যক্রম শুরু হলেই মামলাগুলোর তদন্ত করবে সাইবার থানা এবং চার্জশিট সরাসরি সাইবার ট্রাইব্যুনালেই দাখিল করবেন সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা৷
ইদানীং লক্ষ্যণীয় কিছু লেখক, সাংবাদিক, কার্টুনিস্টসহ সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের অনুচ্ছেদ ৩৯ এর বিধি নিষেধ অতিক্রম করে এবং রাষ্ট্রীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রতি কুৎসা রটনা ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে হেয় প্রতিপন্ন করার অভিযোগে এই আইনে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এইক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ব্যাতীত যেকেউ যত্রতত্র মামলা দায়ের ও গ্রহণ বন্ধ করা এবং সাংবাদিকদের লেখনী ও বাক-স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা দরকার। আবার অভিযোগ রয়েছে, মফস্বল পর্যায়ের সাংবাদিক নামধারী কিছু ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে অনুমতি ব্যতীত তথ্য সংগ্রহ করে ইউটিউবে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার করেন। যা কোন ভাবেই কাম্য নয় এবং এক্ষেত্রে শুধু আইনের ব্যবহারের দোষ দিলে চলবে না, বরং নিজেদের ব্যবহারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে হয়রানি রোধে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তদন্তের আগে মামলা নেওয়া বা কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না, সরাসরি মামলা নেওয়া হবে না। কোন অভিযোগ এলে পুলিশ প্রথমে তদন্ত করে দেখবে এবং তদন্ত সাপেক্ষে তারপরে মামলা নেওয়া হবে। তাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। রাজনীতি বিশ্লেষক।
এইচআর/এমকেএইচ