ইউটিউব মাওলানাদের জোশ এবং হেফাজতি জযবা

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:৫২ এএম, ০৮ এপ্রিল ২০২১

দুদিন আগে কথিত শিশুবক্তা রফিকুল ইসলামের একটি ফেসবুক লাইভের লিংক ইনবক্সে পাঠিয়ে এক সাংবাদিক বন্ধু ক্ষোভের সঙ্গে বললো, একটু হলেও দেখেন। সরকার এদের ধরে না, ধরে যারা কার্টুন আঁকে তাদের! শিশুবক্তাটিকে আমার কাছে ‘ইউটিউব মাওলানাদের’ মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর মনে হতো। জানি না এটা তার অবয়বের কারণে কিনা। বাংলা প্রবাদ ‘যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা’- মনে হয় ওর সঙ্গে যায়। বিরক্তিকর হলেও শুনলাম- তার রাষ্ট্রবিরোধী, সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ১৫ মিনিটের লাগামহীন বক্তব্য। সরাসরি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে সে। যারা হেফাজতে বিশ্বাসী না তারা মুরতাদ, সরকার মুরতাদ- এদের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় আমিরের নেতৃত্বে জেহাদ চায় সে। প্রতিপক্ষের হাতও ভেঙে দিতে চায়।

আমি ইউটিউব ওয়াজ শুনি না মাওলানাদের প্রতি আমার বিদ্বেষ বেড়ে যাবে এই ভয়ে। তারা ওয়াজের নামে যেসব কর্মকাণ্ড করে সব হাস্যরস এবং বিনোদনের খোরাক। মুর্খতা আর জঙ্গিবাদের উসকানিতে ভরা। ইসলাম ধর্মের নামে তারা যখন এসব করেন তখন সেটা পুরো ধর্মের গায়ে লাগে। এ ব্যাপারে তারা ভাবেন বলে মনে হয় না বরং ইউটিউব দিয়ে পরিচিতি পেয়ে তাদের কারও কারও মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন। ঔদ্ধত্য তাদের সীমাহীন হয়ে গেছে। রফিকুল ইসলাম তাদের একজন, যদিও সে শিশু নয়, শিশু অবয়বে আটকেপড়া শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড মানুষ। বয়স তার ২৬-২৭ হবে।

৭ এপ্রিল ২০২১ রফিকুল ইসলামকে র‌্যাব গ্রেফতার করেছে। র‌্যাব বলেছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কুৎসা, কটূক্তিমূলক বক্তব্য, ভিডিও ও ফেসবুক কনটেন্ট পেয়েছে তার। মামলার প্রস্তুতি চলছে তখনও। রফিকুলও দেখা যায় কাবিন ছাড়া বিয়ে করেছে। ২০১৯ সালে নিজের ভাবির এক চাচাতো বোনকে মুখে মুখে কবুল বলে বিয়ে করে এবং এই বিয়ের খবর জানে না দুইপক্ষের পরিবারের কেউ। সে বিয়ের কাবিন বা সাক্ষী সম্পর্কেও স্পষ্ট তথ্য দিতে পারেনি। র‌্যাব দাবি করেছে, কথিত শিশুবক্তার মোবাইল ফোন চেক করে একাধিক পর্নো ভিডিও পাওয়া যায়। তার মোবাইল ফোনের ফেসবুক মেসেঞ্জারে বিভিন্নজনকে পাঠানো আপত্তিকর ছবিও পাওয়া গেছে।

আমি সমাজে সব মত-পথের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। উপমহাদেশে কওমিধারার মাওলানাদের পূর্বসূরিরাই ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ করেছেন, তাই এদের ওপর আমার শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক মাসের কিছু ঘটনায়, বিশেষ করে আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর এদের কর্মকাণ্ড দেখে মনটা বিষাক্ত হয়ে গেছে হেফাজতে ইসলামের ওপর।

বাংলাদেশের কওমিধারার মাদরাসাছাত্রদের পশ্চাৎপদতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। তাদের পক্ষে লিখেছি। কারণ অন্ধকারে পড়ে থাকা কাউকে অন্ধকারে রেখে আমাদের এগিয়ে যাওয়াকে প্রগতিশীলতা বলে না। অন্ধকারে পড়ে থাকা মানুষকে আলোয় আনা প্রগতিশীলদের কাজ। সারাদেশে ১৪ হাজার কওমি মাদরাসায় প্রায় ১৬ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। এই কর্মঠ জনগোষ্ঠীকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার না করে দূরে ঠেলে সমাজকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন তারা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ছিল, দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি তাদের সেই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকেই মানুষ অনেক সময় চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটা উপলব্ধি করেছেন বলেই তাদের সার্টিফিকেটের মর্যাদা দিয়েছেন। তারাও তাকে ‘কওমি জননী’ আখ্যা দিয়েছে।

এরপর কওমিদের দায়িত্ব ছিল নিজেদের তাগিদেই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। তারা যায়নি বরং গিয়েছে জঙ্গি রাজনীতির দিকে। করোনার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণ আন্দোলন করেছে। সর্বশেষ নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে টানা তিনদিনের তাণ্ডবে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করেছে, ঝরিয়েছে প্রায় ১৪ জন মানুষের প্রাণ। অথচ হেফাজতে ইসলাম কোনো রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জন্ম নেয়নি। ২০১০ সালে এটি ‘নাস্তিকতাবিরোধী’ সংগঠন হিসেবে জন্ম নেয়। হেফাজতের জনক দেশের প্রবীণতম আলেম হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম আল্লামা আহমদ শফীর মাধ্যমে জেহাদ অথবা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কথা কখনো বলেননি। অথচ রফিকুল-মামুনুলরা কথায় কথায় জেহাদ চাচ্ছেন।

২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে 'নাস্তিকতাবিরোধী' কর্মসূচি দিয়ে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল আল্লামা শফী সেই দূরত্ব শেষ করে দিয়েছিলেন। কওমি ঘরানার লোকজনের কাছে তিনি অত্যন্ত পরিচিত এবং সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন, যদিও সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি পান শাপলা চত্বরে ঘটনায়। ওই ইস্যুটি তাকে কওমি ধারার একক নেতায় পরিণত করেছিল। তার মৃত্যুর পর এখন কওমিদের মধ্যে খেলাফতের মহাসচিব মামুনুল হকসহ যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আছেন তারা সংগঠনটিকে বিপথে পরিচালিত করে পুরো কওমি পারিবারের লোকদের বিপদের মুখে ফেলেছেন।

আল্লামা শফী যে পরিস্থিতিতে মৃত্যুবরণ করেছেন তার মৃত্যুর পর হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক কে হবেন এবং কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কে হবেন, সর্বোপরি রাজনীতির দাবার ঘুঁটি হেফাজতের নেতৃত্ব কার কাছে যাবে- সেটা নিয়ে জনমনে আশঙ্কা ছিল। শফী সাহেবের মৃত্যুর পটভূমি, পরিবেশ পরিস্থিতিতে বোঝা গিয়েছিল সেটি বিএনপি-জামায়াত অনুগত হেফাজতের লোকদের হাতে যাবে। এখন তাই হয়েছে। এমনকি মামুনুল হকের ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গেছে হেফাজত।

তারা ইসলামকে হেফাজতের নামে মামুনুল হককে রিসোর্ট কেলেঙ্কারি থেকে হেফাজতে নেমেছেন। হেফাজত ফতোয়া দিয়েছে মানুনুলের কথিত দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ। অথচ বিয়ের কোনো খবর মেয়ের মা-বাবা জানে না, মামুনুলের প্রথম স্ত্রীও গত দুই বছর ধরে জানে না তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এমন বিয়ে যে ইসলামে শুদ্ধ নয়, আর কারও তা বলার দরকার নেই। এমন বিয়ে নিয়ে মামুনুলের ওয়াজের ভিডিও এখন লোকজন তাকে শোনাচ্ছে, যেখানে তিনি বলেছেন- ‘যে নারী নিজের অভিভাবকদের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করবে আল্লাহর রসুল বলেছেন তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল।’

রফিকুলকে গ্রেফতারের পর হেফাজত হুমকি দিয়ে এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘অবিলম্বে মাওলানা রফিকুল ইসলামকে মুক্তি দিন। অন্যথায় এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও আলেম ওলামার ইজ্জত রক্ষা এবং মসজিদ মাদরাসা হেফাজতে দল-মত নির্বিশেষে লড়াই করতে আপামর জনগণ সর্বদা প্রস্তুত আছে।’ খেলাফত নেতা মামুনুল হকও এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আলেম-উলামাদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র চলছে। ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এর দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।’

একটি রিপোর্টে দেখলাম হেফাজত মামুনুল ইস্যুতে আপাতত চুপ থাকবে। ধীরে ধীরে তাকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেবে। মনে হয় মামুনুল কাণ্ডের পর মোদি ইস্যুতে ঢাকার তাণ্ডব নিয়ে কেন্দ্রীয় ক’জন নেতা মামলা খাওয়ায় তাদের হুস হয়েছে। ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী তাণ্ডবের পর সরকারের দায়ের করা মামলায় এদের কারও নাম ছিল না। সেই সঙ্গে এখন সারাদেশের তাণ্ডবে জড়িতদের ধরাও শুরু হয়েছে।

জানি না সরকার কীভাবে হেফাজত ইস্যু সামাল দেবে। সবচেয়ে বড় কথা সরকার এদের মূলস্রোতে আনার যে উদ্যোগ নিয়েছিল সেটা হেফাজতিদের মূর্খতায়, অদূরদর্শিতায় বিফলে যেতে পারে। বিফলে গেলে নেতাদের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না সত্য, হবে মাদরাসায় পড়া লাখ লাখ শিক্ষার্থী। ইতোমধ্যে মামুনুলকাণ্ডের পর তারা সোনারগাঁয়ে যা করেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে উগ্র গোষ্ঠী, জঙ্গি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে- সেটাও অশনিসংকেত। যে ‘হেফাজতি ভাইরাসে’ তারা আক্রান্ত হয়েছে সেটা দূর না হলে রাষ্ট্রকেও বিপদের মধ্যে ফেলে দেবে তারা। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশিদের জন্য বয়ে আনবে দুর্নাম।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/বিএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।