পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ০৯ মার্চ ২০২১

গত কিছুদিন ধরেই আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রাজ্যে ক্ষমতাসীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসকে হটানোর জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি কোমর বেঁধে নেমে পড়ছে। ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গুটি চালাচালি শুরু করেছেন বেশ আগে থেকেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ জুটি নাকি ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়েই মাঠে আছেন। কেন্দ্র এবং অনেকগুলো রাজ্য শাসনের অধিকার পেলেও পশ্চিমবঙ্গ তাদের নাগালের বাইরে থাকায় তারা অস্বস্তিতে আছেন। এবার তাদের টার্গেট পশ্চিমবঙ্গ।

নির্বাচনের দিন তারিখ ঠিক হওয়ার আগে থেকেই মোদি-শাহ জুটির তৎপরতা শুরু হয়েছে। তারা একদিকে যেমন সাধারণ ভোটারদের সমর্থন আদায় করতে চাইছেন, তেমনি সমানতালে মমতার ঘর ভাঙার কাজটিও করছেন ব্যাপক উদ্যমের সঙ্গেই। এর মধ্যে তৃণমূলের মূলোৎপাটনে যা যা করণীয় তা করতে কোনো ধরনের দ্বিধা মনে না পুষে যাকে বলে হামলে পড়া, তাই পড়েছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তৃণমূল থেকে কয়েকজনকে বিজেপিতে বরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মন্ত্রী-আইনপ্রণেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারাও আছেন। সর্বশেষ গত ৭ মার্চ নরেন্দ্র মোদির কলকাতা ব্রিগেড গ্রাউন্ডের জনসভায় উপস্থিত হয়ে বিজেপিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছেন জনপ্রিয় অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী। কয়েক দিনের মধ্যে আরও কেউ কেউ তৃণমূল ছাড়বেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কলকাতার ‘মহারাজ’ বলে খ্যাত জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা সৌরভ গাঙ্গুলিও বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন বলে গুজব শোনা গেলেও তিনি সম্প্রতি জানিয়েছেন, না তিনি এখনই গেরুয়া বসন ধারণ করবেন না।

আগামী ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত মোট আট দফায় ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এত লম্বা সময় ধরে আগে কখনো ভোট হয়নি। নির্বাচনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্যই নাকি এ ব্যবস্থা। তবে রাজনৈতিক পক্ষগুলো যে রকম মারমুখী বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত খুনাখুনি হানাহানিমুক্ত নির্বাচন হওয়া নিয়ে কারও কারও মধ্যে সংশয় তৈরি হতে শুরু করেছে। বিজেপি ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া, তৃণমূল চায় ঘাঁটি আগলে রাখতে। বাম-কংগ্রেস জোটও শক্তি দেখাতে পিছিয়ে রাখতে চায় না। এই তিন পক্ষের শক্তির দাপটে কী অবস্থা দাঁড়াবে, এখন দেখার বিষয় সেটাই।

২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। এর আগে টানা তিন দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট। বামফ্রন্ট জামানায় বেশিরভাগ সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তিনি ছিলেন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও তার প্রভাব ছিল। একবার তার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তার দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সায় না দেয়ায় সেটি হয়নি। জ্যোতি বসুর পর বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। দীর্ঘদিনের বামফ্রন্ট শাসনে পশ্চিমবঙ্গ নানাদিক থেকেই পিছিয়ে পড়েছে। নানা অবক্ষয় সিপিএমকে গ্রাস করেছিল। ফলে তাদের নির্বাচনে শুধু পরাজয় ঘটেছিল তাই নয় বামদুর্গেরও পতন হয়েছিল। বামফ্রন্টের ক্ষমত্যচ্যুতির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে যে পরিবর্তন এসেছিল নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, সেটা নাকি আসল পরিবর্তন নয়। আসল পরিবর্তনের সূচনা হবে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করে বিজেপি সরকার গঠনের পর।

৭ মার্চ ব্রিগেড ময়দানের বিশাল জনসমাবেশে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পর গত ৭৫ বছরে বাংলা থেকে যা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তা ফিরিয়ে দেব। আমার কথা লিখে রাখুন।’ তিনি কলকাতাকে ‘সিটি অব ফিউচার’ হিসেবেও গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। জনসভায় বিপুল জনসমাগম দেখে নাকি মোদি বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা করে উপস্থিত জনতার সামনে নানা স্বপ্নের কথা তুলে ধরেছেন। মোদিকে বলা হয়, ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা'। তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন। মানুষ তার কথার জাদুতে সম্মোহিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তার স্বপ্নের সাথী হবে কি-না তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে বিজেপি যে এরমধ্যেই মমতার শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই।

আমাদের দেশে যেমন, তেমনি ভারতেও এখন রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। পরস্পরবিরোধী আদর্শের দল ও ব্যক্তিরা পক্ষ বদল করছেন জোট গড়ে উঠছে বিপরীত আদর্শের দলগুলোর মধ্যে। এখন নীতিগতভাবে কেউ এগুতে চায় না। অন্য দলকে আটকানো কিংবা নিজ দলের আসন সংখ্যা বাড়ানোই সবার প্রধান লক্ষ্য। বিজেপিকে হিন্দুত্ববাদী প্রতিক্রিযাশীল দল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয় ভারতের সেক্যুলার রাজনীতির বারোটা বাজিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে বিশাল ভারতকে বিভক্ত করে এক ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।

বিজেপিকে যদি একটি ক্ষতিকর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে এই শক্তিকে রোখার জন্য তো অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক সব রাজনৈতিক জোট হওয়া দরকার। কিন্তু সেটা হচ্ছে না কেন? পশ্চিমবঙ্গের কথাই যদি ধরা হয় তাহলে কী দেখা যাচ্ছে? তৃণমূল কংগ্রেস যদি বাম দলগুলো এবং কংগ্রেসের সঙ্গে একজোট হয়ে ভোটে লড়ে তাহলে বিজেপির পরাজয় ঠেকানো যাবে না। কিন্তু সেই বৃহত্তর ঐক্য গড়ে না উঠে বাম-কংগ্রস জোট হাত মিলিয়েছে নবগঠিত একটি মুসলিম পার্টির সঙ্গে। ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী গত ২১ জানুয়ারি ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে ফেব্রুয়ারি মাসেই বাম-কংগ্রেস জোটের সঙ্গী হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলিম ভোট ভাগ করার লক্ষ্য মাথায় রেখেই নাকি আব্বাস সিদ্দিকীকে জোটে টানা হয়েছে।

আাসাদউদ্দিন ওয়াইসি নামের একজন উঠতি মুসলিম নেতাও তার ‘মজশিলে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ বা ‘মিম’ নামক একটি সাম্প্রদায়িক দল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতিতে হানা দিতে তৎপরতা চালাছেন। মিমকে বলা হয় বিজেপির বি-টিম। মূলত হায়দ্রাবাদভিত্তিক দল হলেও মিম মহারাষ্ট্র এবং বিহারের নির্বাচনে প্রার্থী দিয়ে সুফল পেয়েছে। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ২০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতে জয় পেয়েছে ওয়াইসির দল। এবার তার চোখ পশ্চিমবঙ্গে। মুসলিম ভোট ভাগ হয়ে তৃণমূলের ক্ষমতায় ফেরার রাস্তা কঠিন করা হলেও তাতে কি বাম-কংগ্রেসের পথ সুগম হবে, নাকি বিজেপির জন্য সুবিধা করে দেয়া হচ্ছে?

রাজনীতি সাধারণত সরল হিসাবের পথে চলে না। পশ্চিমবঙ্গেও চলছে বলে মনে হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৮ শতাংশ মুসলমান। গত দুইটি নির্বাচনে তৃণমূলের বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল এই মুসলিম ভোট। এবার এই মুসলিম ভোট বিভক্ত করতে গিয়ে রাজনীতিতে যে ‘আনহোলি অ্যালায়েন্স’ গড়ে উঠছে তা বিভেদের পথকেই প্রসারিত করবে বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন। অনেক দেশেই রাজনীতিতে দক্ষিণ পন্থার ঢেউ দেখা যায়। এই ঢেউ মোকাবিলার জন্য ভুল প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতি সাধারণ মানুষের নিরাপদ জীবনযাপনকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে মনে করলে তাকে ভুল বলা যাবে কি? নৈতিকতা বাদ দিয়ে যখন রাজনীতিতে কৌশলটাই বড় হয় তখন আশাবাদী হওয়ার কারণগুলোও সংকুচিত হয়।

লেখাটি শেষ করছি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় সেমন্তী ঘোষের একটি লেখা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে। সেমন্তী লিখছেন, ‘কৌশলের প্রধান লক্ষ্য নিশ্চয়ই, আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোটের ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের একটা ক্ষতি ঘটানো। মুসলিম নেতারা ভোটে দাঁড়ালে কিছু ভোট তৃণমূলের হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা। তবে সিদ্দিকী জোটে না ঢুকেও তৃণমূলের সেই ক্ষতি করতেই পারতেন, কেবল তাতে সিপিএমের ঘরে সেটা আসত না। আর জোটের এই বোঝাপড়া থেকে যেটুকু লাভ, সাধারণ বুদ্ধি বলছে, সেটা যাওয়ার সম্ভাবনা বিজেপির ঘরে, যেমন আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বিষয়েও ধরে নেয়া হয়। লাভক্ষতির এই অঙ্ক বাম নেতারা কষেছে নিশ্চয়ই, তবু দমেননি।

আরও একটা লক্ষ্য থাকতে পারে এই কৌশলের: আব্বাস সিদ্দিকীকে নীলকণ্ঠের মতো ধারণ করা। অর্থাৎ যদি সিদ্দিকী-ওয়াইসি জোট হয়ে একটা কট্টর মুসলিম মেরু তৈরি হতো এই বাংলায়, তা হলে নিশ্চয় আরও ভয়ানক হতো সেটা। বাম-কংগ্রেস জোটে সিদ্দিকী আসার ফলে সেই সম্ভাবনা বিনষ্ট করা গেল। কী হলে কী হতো বলা মুশকিল, তবে ভাবতে যদি হয়ই, এমনও কি ভাবা যায় না যে, সে ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং ইসলামবাদী রাজনীতি দুটোকেই সরাসরি আক্রমণ করা যেতে পারতো? সেও তো হত আর এক ধরনের কৌশলী রাজনীতি। বাম আদর্শের পক্ষে এটাই কি স্বাভাবিক হতো না? ওই যে বলছিলাম, এখনও আমাদের নাচার মন বিশ্বাস করতে চায় যে, একটা অন্য যুদ্ধের ইশারা হয়তো বাঁ দিক থেকেই আসতে পারে। না, তেমন কিছু হলো না। আজকের নেতারা বাম কৌশলে নৈতিকতা আর আদর্শের অমন স্থান আর রাখতে চান না।

অথচ এটা তো ঠিক যে, ভোটের আসনে বা পরিমাণে বিজেপিকে আটকানোর মতোই আদর্শে-উদ্দেশ্যে বিজেপিকে আটকানোটাও কম গুরুতর কাজ নয়! বিজেপি মানে তো কেবল মোদি-শাহের ভোটের অঙ্ক নয়, বিজেপি মানে একটা রাজনৈতিক ধারা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক সত্তার ভিত্তিতে দেশের জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করার রাজনীতি। বিজেপি-আরএসএসের দক্ষিণপন্থী ধর্মসত্তাবাদী রাজনীতি ভালো করেই জানে, তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য দোসর— বিপরীত ধর্মের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তাই, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বাড়া মানেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা বাড়া, দুই পক্ষ দুই পক্ষকে সেই জন্যই তোয়াজ করে চলে, এমনকি হাতও মেলায়।’

কেউ কেউ মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে কূটকৌশল ও বিভাজনের রাজনীতি শুরু করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তার শেখানো পথে হেঁটে সিপিএম আব্বাস সিদ্দিকীর হাত ধরে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পিঠেই সওয়ার হলো। এতে আব্বাসের হারানোর কিছু নেই, পাওয়ার আছে অনেক কিছু। কিন্তু সিপিএম তথা বামেরা কী পাবে? এই প্রশ্নের জবাব পেতে ভোটের ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এইচআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।