একাত্তরের বিক্ষুব্ধ মার্চের স্মৃতি
মার্চ মাস এলেই আমার একাত্তরের মার্চের কথা মনে পড়ে যায়। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠীর সব হিসাবনিকাশ বদলে দিয়েছিল। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ছিল, তাকে দাবিয়ে রাখার, তাকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার কম অপতৎপরতা পাকিস্তানিরা চালায়নি।
গত শতকের ষাটের দশকের শেষ দিকে এসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে শেখ মুজিবকে জনবিচ্ছিন্ন, এমনকি হত্যার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। বাঁধন শক্ত করতে গিয়ে তা আরো বেশি আলগা হয়েছে। বাঙালির কাছে শেখ মুজিব হয়ে উঠেছেন মুক্তির প্রতীক। প্রবল গণতআন্দোলনের মুখে আগরতলা মামলা বাতিল হয়েছে, শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। আইযুব খান বিদায় নিয়েছেন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করেছেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভালো করবে কিন্তু তারা সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে– এটা ছিল তাদের ধারণার বাইরে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। নতুন স্বাধীন দেশে মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা দূর হবে– এটা ছিল সাধারণ প্রত্যাশা। তরুণ নেতা শেখ মুজিবও ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে। কিন্ত পূর্ব ও পাকিস্তান– এই দদুই বাহু নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর মুহূর্তেই এটা বোঝা গেলো যে, পশ্চিম অংশ আর পূর্ব অংশের মধ্যে মিলের চাইতে অমিলই বেশি পূর্বের বাংলা ভাষাভাষীদের প্রতি পশ্চিমের রয়েছে প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষ। বাঙালিদের মুসলমানিত্ব নিয়েও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্য ছিল সংশয়। পূর্ব অংশকে বঞ্চিত করে, শোষণ-বঞ্চনার শিকারে পরিণত করে পশ্চিম এগিয়ে থাকার নীতি নিয়ে কার্যত পূর্ণ অংশে যে বিভেদের বীজ বপন করে তার পরিণতি লক্ষ করা যায় সত্তরের নির্বাচনে। বাঙালি একাট্টা হয় শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের পতাকা তলে। ভোটেট বাক্সে উজাড় করে দিয়ে শেখ মুজিবের প্রতি একচেটিয়া সমর্থন প্রকাশ জানায় বাঙালি জাতি।
ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবের হাতে, বাঙালির হাতে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। সামরিক ডিকটেটর আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার সঙ্গে হাত মেলান আরেক ক্ষমতালোভী জুলফিকার আলী ভুট্টো। মুজিবকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ফন্দিফিকির করতে লাগে তারা। এদিকে বাঙালিও ততোদিনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়।
আমার মনে আছে, ভাষা সংগ্রামী মোহাম্মদ সুলতানের একটি আশঙ্কার কথা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পঞ্চগড়ে আমাদের এলাকা থেকে অ্যাডভোকেট গোলাম রহমান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে ন্যাপ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তিনি ভাসানী ন্যাপ করতেন। কিন্তু নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে তিনি ওয়ালী ন্যাপে (পরে মোজাফফর ন্যাপ) যোগ দিয়েছিলেন। আমরা তার নির্বাচনে প্রচারকর্মী ছিলাম। গোলাম রহমানের ছোটভাই, ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলনের প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান ঢাকা থেকে আমাদের এলাকায় গিয়েছিলেন তার বড়ভাইয়ের নির্বাচনী প্রচারকাজে অংশ নিতে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক বিজয়ের পর মোহাম্মাদ সুলতান বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের এই ফল পাকিস্তানিরা মানবে না। আমি সামনে রক্তের বন্যা দেখতে পারছি। শেখ মুজিবকে অস্ত্রের পথেই হাঁটতে হবে'। তার কথা তখনই আমরা হয়তো বুঝতে পারিনি। তবে তার আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। এক নদী রক্ত সাঁতরে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। পাকিস্তান না ভেঙ্গে ইয়াহিয়া ও তার পরামর্শকরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা দেননি।
১৯৭১ সালের মার্চের এক তারিখ পাকিস্তানের সেনাশাসক দুপুরে ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণ দিয়ে ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল তা আকস্মিকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা সারা বাংলায় অগ্নি স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি করে। মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শুরু হয় প্রতিবাদ আন্দোলন। তখন আমি দিনাজপুর সরকারি কলেজের ছাত্র। ২৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন মনোনীত প্যানেল হেরে যায়। স্বভাবতই আমাদের মন খারাপ ছিল। পরের দিন সকালে হোস্টেল থেকে বের হলাম। কিন্তু কলেজে না গিয়ে ঢুকলাম চৌরঙ্গী সিনেমা হলে, মর্নিং শো দেখতে। 'রোড টু সোয়াত' নামের একটি উর্দু সিনেমা চলছিল। বেলা একটার পর সিনেমা শেষে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি খণ্ড খণ্ড মিছিল। কি ব্যাপার? হঠাৎ মিছিল কিসের, কেন?
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো পরিচিত কাউকে না পেয়ে মিছিলে সামিল হলাম। মিছিলে শুনি নতুন স্লোগান। 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'ইয়াহিয়ার মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো', 'ভুট্টোর মাথায় লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো'। ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা'। বুঝলাম, মারাত্মক কিছু ঘটেছে। তবে কি ঘটেছে সেটা জানার জন্য আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। মিছিল সামনে অগ্রসর হচ্ছে আর তাতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। কাউকে ডাকতে হচ্ছে না। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিচ্ছেন।
মিছিল গিয়ে জমায়েত হলো দিনাজপুর ইন্সটিটিউটের সামনের খোলা মাঠে। সেখানে গিয়ে জানলাম মিছিলের কারণ। ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণের মাধ্যমে সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে বাঙালি রাস্তায় নেমে এসেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা ছাড়তে না চাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। ২৪ বছরের বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিক নির্দেশ দেওয়ার আগেই, ইয়াহিয়ার বেতারভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা সিদ্ধান্ত নেয়, আর গোলামি নয়, এবার এক দফা– স্বাধীনতা। স্বতঃস্ফুর্তভাবে মানুষ রাস্তায় নেমে পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। নেতার নির্দেশের অপেক্ষা না করে অস্ত্র হাতে নেওয়ার স্লোগান উচ্চারণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন করার কথা বলে।
কী আশ্চর্য ঘটনা। এই ঘটনা কেবল ঢাকায় ঘটেনি, ঘটেছিল সারাদেশে শহরে-বন্দরে-গ্রামে, এক যোগে। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল? মানুষকে আসলে প্রস্তুত করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে অধিকার বোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন, সেই বোধই মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করেছিল। পাকিস্তানিদের মতলব ভালো না- এটা বুঝতে সেদিন কারো অসুবিধা হয়নি। বাঙালি জাতি যে স্বাধীনতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিল, তার প্রমাণ পহেলা মার্চের বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশ এবং জনতার স্বতঃস্ফূর্ত স্লোগান। সেদিনই এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে পাকিস্তানের কবরে অভ্যুদয় ঘটতে চলেছে এক স্বাধীন ভূখন্ডের, নাম তার বাংলাদেশ।
এরপরের ঘটনা আজ সবারই জানা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো– এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ।
এগুলো কথার কথা ছিল না। ছিল এক আত্মপ্রত্যয়ী নেতার দৃঢ় অঙ্গীকার। আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি– বলে বঙ্গবন্ধু আসলে অনেক কিছুই বলেছিলেন ৭ মার্চ। তারপর শাসকগোষ্ঠী কালক্ষেপ করেছে। আলোচনার নামে বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নিয়ে ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিতে শুরু করেছে বাঙালি নিধনপর্ব। কিন্তু তার আগেই নির্ধারিত হয়ে গেছে ইতিহাসের গতিপথ।
আজ যারা স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অহপতুক বিতর্ক করে আমোদ পান, তারা আসলে জানেন না হুকুম দিয়ে ইতিহাস তৈরি করা যায় না। কোনো মেজরের কণ্ঠে কোনো ঘোষণা শোনার অপেক্ষা না করেই জনতা একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম দিন কণ্ঠে যে স্লোগান তুলেছিল তা বাস্তবে রূপ দিতে ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরেই শুরু করেছিল প্রতিরোধ যুদ্ধ। ডিসেম্বরের ষোলো তারিখ পাকিস্তানের ভোমা ভোমা মোছুয়া সোলজারদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন হয়। ভেতো বাঙালি বলে যাদের উপহাস করা হতো তারা ঠিকই প্রয়োজনের সময় অস্ত্র ধরলো। লড়লো। মরলো। মরার দেশে বরাভয় আনলো এবং বাংলাদেশ স্বাধীন করলো।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' - এটা শুধু একটি সঙ্গীত নয়, এটা আসলে বাঙালির প্রেরণা, শত্রু মোকাবিলার অভয় মন্ত্র। এটা আগে শুধু শুনতে ভালো লাগতো বলে শিল্পীর কণ্ঠে গীত হতো, একাত্তরে এটা হয়ে উঠলো একটি জাতির উত্থানের সমবেত কণ্ঠধ্বনি। একাত্তরের বিক্ষুব্ধ মার্চ যারা দেখেননি কিংবা যারা তখনও মগ্ন ছিলেন পাকিস্তান প্রেমে তারা এখন নানা ছলে ইতিহাস থেকে চোখ সরিয়ে নতুন গল্প ফাঁদতে চাইলেও সেটা সম্ভব হবে না। ইতিহাসই ইতিহাসের বড় প্রহরী।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/এমকেএইচ