করোনার টিকা দেওয়ার দৌড়ে কে কোথায়?
ড. মো. হাসিনুর রহমান খান
এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি ৯৪ লক্ষ লোক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, যা বিশ্বের বর্তমান ৭৭৫ কোটি জনসংখ্যার ১.৪১ শতাংশ| মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় ২৪ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার দশমিক ০৩ শতাংশ| যদিও ১৭ ই নভেম্বর ২০১৯ চীনে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি সন্ধান পাওয়া যায় কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে একুশে জানুয়ারি ২০২০ সাল হতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা নিবন্ধিত করতে থাকে দেশগুলি| সে হিসেবে বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ২ লক্ষ ৬০ হাজার আক্রান্ত হয়েছে, আর মৃত্যুবরণ করেছে গড়ে ৬২০০ জন মানুষ! বাংলাদেশে ৮ এবং ১৮ ই মার্চ ২০২০ প্রথম করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়| সে হিসেবে গড়ে প্রতিদিন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৬০০ আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে ২৫ জন|
আজ পর্যন্ত প্রায় ২২১ টি দেশ ও অঞ্চল করোনায় আক্রান্ত হলেও অবিশ্বাস্যভাবে এখনো নয়টি দেশ রয়েছে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়নি বা প্রকাশ করেনি, যেমন উত্তর কোরিয়া, কিরিবাতি, টংগো, তুর্কিমিনিস্তান| এখন পর্যন্ত ২২১ টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে মাত্র ৭৭ টি দেশ ও অঞ্চল করোনার টিকা দিতে শুরু করেছে| যার ৫৩ টি উচ্চ আয়ের, চব্বিশটি মধ্য-নিম্ন আয়ের দেশ ও অঞ্চল যার মধ্যে বাংলাদেশেও রয়েছে| বাংলাদেশ গত ৭ই ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে টিকাদান শুরু করে যা অন্যান্য অনেক সক্ষম দেশের (যেমন অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া মালয়েশিয়া) তুলনায় অনেক আগে শুরু হয়েছে| সেজন্য সরকার সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য|
আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা এর তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে প্রায় ১৭ কোটি টিকার ডোজ দেওয়া হয়েছে| যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে এগিয়ে প্রায় ৫ কোটি ৬৪ লক্ষ, এরপরে চীন ৪ কোটি ৫২ লক্ষ, যুক্তরাজ্য ১ কোটি ৫১ লক্ষ, ভারত ৮২ লক্ষ, ইজরায়েল ৬৩ লক্ষ, ব্রাজিল ৫১ লক্ষ, সংযুক্ত আরব আমিরাত ৫০ লক্ষ ডোজ টিকা দিতে পেরেছে| কিন্তু জনসংখ্যার বিচারে প্রতি ১০০ জন লোকের বিপরীতে টিকার ডোজের হার বিবেচনা করলে সবচেয়ে এগিয়ে ইসরায়েল যারা ৭২.৬, এরপর রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ৫০.৬, যুক্তরাজ্য ২২.১, যুক্তরাষ্ট্র ১৫.১, বাহরাইন ১৪.২, জার্মানি ৪.৭, তুরস্ক ৪.৪, চীন ২.৮, রাশিয়া ২.৭, ব্রাজিল ২.৪ এবং ভারত ০.৬. বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৯ লক্ষ ৬ হাজার এর উপরে টিকার ডোজ দিয়েছে যা প্রতি ১০০ জনে দশমিক ৫৪.
বাংলাদেশ ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে টিকা দেওয়ার পর হতে প্রতিদিন জ্যামিতিক হারে তা বৃদ্ধি পেয়েছিল যা বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে সর্বশেষ ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে ২ লক্ষ অতিক্রম করেছিল| এখন পর্যন্ত প্রতিদিন তিন লক্ষ লোককে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি করে রেখেছে বাংলাদেশ| মানুষের আগ্রহ একই রকম থাকলে আশা করা যায় আগামী দু একদিনের মধ্যে সেই সক্ষমতায় পৌঁছাবে| আমার হিসাব মতে এভাবে এগুলে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ৩০-৩৫ লক্ষ টিকার ডোজ দেয়া সম্ভব হবে| এবং বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন লোকের বিপরীতে টিকার ডোজ এর হারে প্রথম দশটি দেশের কাতারে পৌঁছাবে ফেব্রুয়ারির শেষে|
বর্তমান হিসাব অনুযায়ী দশটি টিকা মানুষের মধ্যে প্রয়োগ করার জন্য বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল অনুমতি দিয়েছে, এরমধ্যে সাতটি টিকা সবচেয়ে বেশি মানুষকে প্রয়োগ করা হচ্ছে| ফাইজারের টিকা সবচেয়ে বেশি ৫৭ টি দেশ ও অঞ্চলে দেয়া হচ্ছে, এর পরে দেওয়া হচ্ছে ৩৪ টি দেশ ও অঞ্চলে অক্সফোর্ডের টিকা, সাতাশটি দেশ ও অঞ্চলে মর্ডান আর টিকা, দশটি দেশ ও অঞ্চলে সিনফার্মের টিকা, পাঁচটি দেশ ও অঞ্চলে স্পুটনিক' ভি এবং শিনোভেক টিকা, এবং কোভ্যাকসিন একটি দেশে| তবে জনসন এন্ড জনসন এর একটি টিকা কিছুদিনের মধ্যেই অনেক দেশ প্রয়োগ করা শুরু করবে| বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র অক্সফোর্ডের টিকাটি প্রয়োগ করছে|
অনেক দেশ টিকা বুকিং এর ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে থাকলেও টিকা প্রাপ্যতা ও প্রদানের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ভাবে পিছিয়ে রয়েছে| যেমন কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি| কানাডা এখন পর্যন্ত মাত্র ৩.২ মিলিয়ন লোককে টিকা দিতে পেরেছে যদিও কানাডা তার লোক সংখ্যার পাঁচগুণ বেশি টিকা বুকিং করেছিল| এ নিয়ে শুরুর দিকে দেশটিকে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক নিন্দার সম্মুখীন হতে হয়েছিল| এর বড় একটা কারণ হলো ক্যানাডা অর্থলগ্নি করেছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ফ্যাক্টরিগুলো থেকে টিকা সংগ্রহের জন্য, যা তাদের জন্য শাপে বর হয় সরবরাহের ঘাটতি বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিধি নিষেধের কারণে|
ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশগুলির অবস্থাও একই রকম,অতিরিক্ত বুকিং দেওয়া সত্ত্বেও আমেরিকার বিধিনিষেধের কারণে আমেরিকার ফাইজার ও মর্ডান আর পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন হাতে পাচ্ছে না| যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এ দিক থেকে অনেক এগিয়ে থাকায় তাদের ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম ভালোভাবে এগিয়ে নিতে পারছে| আবার ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির সুবিধা নিয়ে কিছু দেশ ভালোভাবে ভ্যাকসিনেশন চালিয়ে যাচ্ছে, যেমন সার্বিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত| সার্বিয়া রাশিয়া এবং চীনের কাছ থেকে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পাচ্ছে|
ভ্যাকসিন উৎপাদনের সুপার পাওয়ার হওয়া সত্ত্বেও চীন ও ভারত তাদের সকল জনগণকে ২০২২ সালের আগে টিকা দিতে পারবে না| ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাম্প্রতিক জানুয়ারির এক জরিপে এমনটি বলা হচ্ছে| এর অন্যতম কারণ হলো লোকসংখ্যার আধিক্য এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য কর্মীর সংকট| তবে তা রাশিয়া ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে ভ্যাক্সিনেশন সম্পন্ন করতে পারবে| এই জরিপ অনুযায়ী যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলি এ বছরের মধ্যেই প্রয়োজনীয় টিকা দিতে পারবে, তবে কানাডাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত|
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপীয় এবং ওশেনিয়া অঞ্চলের প্রায় সকল দেশেই ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই পুরোপুরি ভ্যাক্সিনেশন শেষ করতে পারবে| অধিকাংশ এশিয়ার দেশগুলোতে যেটি ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত সময় লাগবে| কিছু কিছু এশিয়ার দেশ এবং আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে তা ২০২৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত লাগতে পারে| ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশকেও অপেক্ষা করতে হবে ২০২৩ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত|
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৭০ লক্ষ অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিন হাতে (ভারতের দেওয়া ২০ লক্ষ উপহারসহ) পেয়েছে| যতদূর জানা যায় তাতে আগামী ৫ মাসের মধ্যে অক্সফোর্ডের বাকি ২.৫ কোটি ভ্যাকসিন এবং কোভাক্স অ্যালায়েন্স এর মাধ্যমে আরও ১.২৫ কোটি ভ্যাকসিন পাবে| মোট প্রায় সাড়ে চার কোটি ভ্যাকসিন ২০২১ এর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই পাওয়া যাবে| মানুষের আগ্রহ ঠিক থাকলে, আমাদের ভ্যাকসিন দেওয়ার সক্ষমতার মাধ্যমে হয়তো খুব সহজেই এই ভ্যাকসিন গুলো হয়তো আগামী ছয় মাসের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দিতে পারব| তাতে হয়তো ২.২৫ কোটি মানুষকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে| অক্সফোর্ড এর ভ্যাকসিন ৬০% কার্যকরী হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে আরো কম মানুষ কে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে| তবে ২০২১ সালের মধ্যে বা ২০২২ সালের মধ্যে একইভাবে কতজন মানুষ কে ভ্যাকসিনেশন এর আওতায় নিয়ে আসা যাবে সেটি এখনো পরিষ্কার হয়নি|
অধিকাংশ দেশ একাধিক টিকার প্রয়োগ করছে তাদের জনগণের মধ্যে| এইসব দেশগুলিতে একের অধিক টিকা ব্যবহারের মাধ্যমে যেমন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার বৈচিত্রতা রক্ষা পাবে ঠিক আবার করোনাভাইরাস এর বিভিন্ন ভেরিয়েন্ট এর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিসরও বাড়বে| তাই একটু সময় লাগলেও আমাদের উচিত একাধিক টিকার সংস্থান নিশ্চিত করা| বিশেষ করে সম্প্রতি আবিষ্কৃত এক-ডোজ সম্বলিত জনসন এন্ড জনসন এর টিকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা| যা সাউথ আফ্রিকার করোনা ভাইরাসের ভেরিয়েন্ট এর বিরুদ্ধেও দারুণভাবে কার্যকরী হবে বলে প্রমাণিত হয়েছে|
অধিকাংশ দেশ ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক লোকজন ও প্রথম সারির কোভিড যোদ্ধাদেরকে প্রথমেই টিকা দিচ্ছে| অপ্রাপ্ত বয়স্ক লোকজন ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য কোন টিকা এখনো আবিষ্কার হয়নি| তবে এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে জনসন এন্ড জনসন শিশুদের জন্য একটি টিকা নিয়ে আসতে পারবে বলে শোনা যাচ্ছে| এটিকা শিশুদের জন্য টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে| আমাদের প্রত্যাশা থাকবে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারবে| প্রয়োজনে অন্যান্য দেশের মতো ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির সুবিধাকে ভাগিয়ে নিয়ে তা করে দেখাবে| যা করে দেখানো যে কোন দেশের পক্ষে অত্যন্ত একটি কঠিন কাজ হলেও বাংলাদেশকে সে পথেই এগোতে হবে|
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, আই এস আর টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, আই এস আর টি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নির্বাহী কমিটি।
এইচআর/এমকেএইচ