দুর্যোগ-মহামারিতে ব্রিটেনের ভ্যাকসিন চ্যালেঞ্জ
ব্রিটেনে প্রতিদিনের মৃত্যুমিছিল বড়ই কষ্টের, নিদারুণ বেদনার। স্বজন বিয়োগের ব্যথা যতটুকু না একজন মানুষকে ব্যথিত করছে, তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত করে তুলছে। কারণ প্রতিদিনের মৃত্যু একেকজন মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে কত নিকটে আসছে মুত্যু। কিন্তু মৃত্যুরমিছিল কি আমাদের পথরোধ করতে পারছে?
করোনা সারা পৃথিবীতেই একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে সামনে। উন্নত দেশগুলো গত বছরের প্রথম থেকেই এই চ্যালেঞ্জে নিজেদের বিজয়ী করতে চাইছে। আমেরিকা-ইটালি-ফ্রান্স-জার্মান-স্পেন করোনার প্রথমে ঢেউয়ে পর্যুদস্থ হয়েছে। হাজারো-লাখো মানুষ মারা গেছে এসময়ে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এবার ব্রিটেনে এসেছে যেন 'প্লাবন' হয়ে। এ প্লাবনে মানুষের মৃত্যু এমনকি একটা দিনে ১৮ শত পেরিয়েছে।
আক্রান্ত হওয়া কিংবা মৃত্যু আতঙ্কে লকডাউনে ঘরে বন্দী কিংবা সীমিত চলাফেরায় প্রায় এক বছর থেকে অনেকের সাথেই দেখা নেই স্বজন কিংবা বন্ধুদের সাথে। তারপর হঠাৎ হয়তো শোনা গেল স্বজন-সজ্জনদের কেউ একজন হাসপাতালে, তারপর মাস কি দুমাস তিনি হেরে গেলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই তিনি একসময় ইতিহাসের শেষ অধ্যায় হয়ে যান। এবং এভাবেই ব্রিটেনে এখন কঠিন সময় পার করছে, যেখানে চারদিকে শুধুই উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।
দেশ কিংবা জাতির জীবনে সংকট আসে। একটা দেশের সবচেয়ে বড় সংকটময় সময় হলো, যদি এই দেশটা যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা অংশ ছিল। কিন্তু ব্রিটেন কিংবা মিত্রশক্তিগুলো হিটলারের বিরুদ্ধে জিতেছিল। ক্ষয় ছিল মানুষের, অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে হয়েছিল সেই প্রান্তিক সময়টাতে। কিন্তু সেই যুদ্ধেও তারা এত লোক হারায়নি, যেভাবে হারাচ্ছে মাত্র এই ক'মাসে।এবার সারা পৃথিবীর অনেক দেশই বিপর্যস্ত; পৃথিবীটাই যেন এক অঘোষিত যুদ্ধ ক্ষেত্র। অদৃশ্য কাঁটার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ। এ লড়াইয়ে জীবনের স্পন্দন আগের মত না থাকলেও কিন্তু থেমে নেই পৃথিবী। অন্যান্য দেশগুলোর মত ব্রিটেনও থেমে নেই। গত বারের চেয়ে এবারে জীবনক্ষয় বেশি হলেও জীবনের গতি তুলনামূলক এগিয়ে। রাষ্ট্র মানুষকে ঘরে থাকতে বলছে। কিন্তু মানুষ তবুও লড়ছে।
রাষ্ট্রও ভুল করে। এই ভুলের মাশুল দিচ্ছে হয়ত দেশটা। স্কুল খোলা ছিল। ফ্লাইট বন্ধ হয়নি। সেজন্যই সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না প্রধানমন্ত্রীর। টিভি'র পর্দায় যখন বরিস লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কথা বললেন সেদিন, তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তবুও আশা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নাগরিকদের সমালোচনা মেনে নিয়েছেন, এখন আর স্কুল খোলার কোন তাগিদ নেই। স্কুল খোলতে দেরি হবে, ঘোষণাই দিয়েছেন। নতুন প্রজাতির ভাইরাসের দেশ থেকে কেউ আসলে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে।
হাজার হাজার পাউন্ড জরিমানা হচ্ছে বিধি ভঙ্গকারীর। আর এরকম বিধি-নিষেধ দিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা আছে সরকারের। মৃত্যু এখনও কমছে না, কিন্তু যেভাবে লন্ডনে আক্রান্ত হয়েছিলেন মানুষ, সে হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা অধিক নয়। লন্ডন শহরের সংখ্যা গরিষ্ঠ পরিবার আক্রান্ত হয়েছেন, তবে মানুষ সচেতন আগের চেয়ে। অনেক বেশি। ফার্মেসির ওষুধের নির্ভরতার চেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারকেই গুরুত্ব দিয়েছে আক্রান্তরা। সেজন্য সুস্থ হয়ে উঠছেন মানুষ। এগুলো আমাদের আশাবাদী করে তুলছে। আক্রান্তের সংখ্যা আমাদেরকে আশান্বিত করে তুলছে। প্রতিদিন হাজার হাজার করে এ সংখ্যা কমছে। ৭০ হাজার থেকে এখন বিশের কোটায় এসেছে।
যারা অতি বাস্তববাদী, তারা হয়তো বাস্তবতার কাছেই সঁপে দিচ্ছে নিজেদের। নিজেদের ইমিউন সিস্টেম যতক্ষণ তাকে সাপোর্ট করবে, ততক্ষণ করোনার কাছে তিনি হারবেন না, এটিই তার বিশ্বাস। এই বিশ্বাস থেকে তারা মনে করছে, ভ্যাকসিন না নিলেও ক্ষতি নেই। ধর্মীয় একটা গ্রুপ ধর্মের দোহাই দিচ্ছে, প্রসঙ্গ টেনে আনছে হারাম-হালালের। কিন্তু অত্যন্ত ক্ষুদ্র এ গ্রুপটাকেই ফোকাস করছে ঐ ধর্মের প্রতি বিরাগ ভাজন গোষ্ঠি এবং মূলধারার কিছু কিছু সোশ্যাল মিডিয়াও এগুলো ফোকাস করছে।
তারা এটাকে ফোকাস করছে গোটা ধর্মকে নেতিবাচক ইমেজ দেয়ার জন্য। অথচ শুধু কি ভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষ, শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠির একটা অংশও মনে করছে, এই ভ্যাকসিন তাদের জন্য নিরাপদ নয়। এদের সংখ্যা আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ এমনকি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আছে। ব্রিটেনেও আছে এদের একটা অংশ । অন্যদিকে একটা বিশাল জনগোষ্ঠি এই পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে, যারা ঐ বিশ্বাসের সাথে সৃষ্টিকর্তার কাছেও ক্ষমা চাইছে। বেঁচে থাকার অভিপ্সায় প্রার্থনায় আছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই মানবজাতি বিজ্ঞানের এই বিজয়কে আশীর্বাদ হিসেবেই নিচ্ছে।
তবে একটা ব্যাপার উল্লেখ করা যায়, ব্রিটেনে ছোট-খাটো জিনিস নিয়েও সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। কিছু কিছু উদাহরণ আনতেই পারি। তরুণদের ক্রীড়ামুখী করতে, ড্রাগ থেকে মুক্তি দিতে, সন্ত্রাসবাদের প্রতি ঘৃণা জাগাতে, এথনিক কমিউনিটির ঘরমুখী নারীদের আরও জীবনমুখী করে তুলতে এরকম অনেক অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়। ভ্যাকসিন নিয়েও এরকম উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। শুধুমাত্র বাংলা মিডিয়ায় বড় অংকের বিজ্ঞাপন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এসময়ে বাংলা নিউজ পেপারগুলো মানুষ খুব একটা দেখার সুযোগ পাচ্ছে না।
সুতরাং সচেতনতার জন্য স্পর্শকাতর এরিয়াগুলো উপাসনালয়, কমিউনিটি বেইজড সংগঠন প্রভৃতিতে সরকারকে আরও বেশি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। কারণ একটা মসজিদের ইমাম যে প্রভাব রাখতে পারেন বিশেষত ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়সীদের একটা বড় অংশের মানুষের ক্ষেত্রে, তা হয়তো কোন সামাজিক সংগঠনের নেতা কিংবা একজন সংবাদকর্মী পারবেন না। অন্যদিকে একটা কমিউনিটি সংগঠনের একটিভিস্ট যেভাবে একটা বড় গ্রুপ কে প্রভাবিত করতে পারবেন, তা হয়তো একজন ইমাম না-ও করতে পারেন। অর্থাত ভ্যাকসিন প্রয়োগ (বিতর্ক) নিয়ে একজন মসজিদের ইমামের ইতিবাচক কথা এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং এটাই বাস্তবতা।
একজন সাদা চামড়ার মানুষকে মঞ্চে এনে বক্তৃতা করালে খুব একটা রকমফের হয় না। সুতরাং ভ্যাকসিন নিয়ে বিতর্ক এড়াতে বাস্তবতার নিরীখেই সবকিছু ভাবতে হবে সরকারকে কিংবা স্থানীয় প্রশাসনকে। বিশেষত যে বাঙালিরা কিংবা মূলধারার রাজনীতিতে যারা সক্রিয় তারাই এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারেন। কারণ ভ্যাকসিন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে শুধু ব্যক্তি হিসেবে একজন মানুষই নিজেকে বাঁচার উপযোগী করছেন না, প্রকারান্তরে সারা দেশ তথা মানব জাতিরই প্রয়োজেনে এটা প্রয়োগ জরুরি।
ভ্যাকসিন আশাবাদী করে তুলছে ব্রিটেনকে। ইসরাইল, সৌদিআরবের পর ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মাঝে ব্রিটেনই একমাত্র দেশ, যেটিতে ভ্যাকসিন প্রয়োগ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আরও দু'তিন দিনের মধ্যেই তারা এক কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে এবং দ্রুততার সাথেই এ কার্যক্রম চলতে থাকবে। স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ করতে দুর্বল কিংবা বৃদ্ধ মানুষদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শেষ করতে তারা বদ্ধ পরিকর, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তারা তা শেষ করতে পারবে বলেই ঘোষণা দিয়েছে। ব্রিটেনের মানুষ আশাবাদী এপ্রিলের মধ্যেই হয়তো নতুন প্রাণ আসবে দেশটিতে। তবুও সমালোচনার পাহাড় নিয়েই প্রায় প্রতিদিন মুখোমুখি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের মাঝে।
মাত্র ক'দিন আগে নর্থওয়েস্ট ইংল্যান্ডে দেখা দিল বন্যা। হাজার হাজার পরিবারকে নিরাপদ জায়গায় সরাতে হয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর। দেখা গেছে হঠাৎ করেই বরিস ছুটে এসেছেন কোন এক শহরে। আমার বাসার মাত্র মাইল তিনেক দূরে বন্যা কবলিত এলাকা দেখতে এলেন বরিস। নেই গাড়ির হর্ন, নেই যানজট। মানুষ জানেই না। দুপুরে আর বিকেলে আমরা এক ঝলক দেখলাম তাকে সাংবাদিকের মুখোমুখি, টিভিতে।
বন্যা প্রতিরোধে স্থানীয় কাউন্সিলগুলোর বিরোধিতা করেননি তিনি, যদিও নর্থ ওয়েস্টের প্রায় সবকটা বন্যা কবলিত এলাকা (স্থানীয় প্রশাসন) তার পার্টির নেতৃত্বে নেই। বরং প্রশংসা করলেন। দুর্যোগ মোকাবেলায় ব্যর্থ হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, এ অভিযোগ সাধারণ মানুষের আছে, বিরোধীদলও সমালোচনা করছে সরকারের। কিন্তু এই সমালোচনার মাঝে তিনি পাল্টা অভিযোগের তীর ছুড়ছেন না। শুধুমাত্র এড়িয়ে যাচ্ছেন অনেক প্রশ্নের উত্তর। কারণ দেশটাই প্রধান, দুর্যোগ-মহামারিতে নাগরিকদের প্রাধান্য দেয়াই একটা রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই ব্রিটেন এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/এমকেএইচ