শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২১

ড. মো. হাসিনুর রহমান খান

দীর্ঘ এক বছর ধরে করোনাকালীন সময়ে প্রাণঘাতীর পরে অন্য যে বড় ক্ষতির সম্মুখিন আমরা হয়েছি তা হলো শিক্ষার ক্ষতি| আর্থিক, ব্যবসায়িক ও অন্যান্য ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে, কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি ও শিক্ষাজনিত কিছু কিছু পরোক্ষ ক্ষতি কি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে? কখনোই হয়তো সম্ভব হবে না| যেমন শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শিক্ষকতা পেশা থেকে ঝরে পড়া, শিশুর প্রথম শিক্ষার বিড়ম্বনা, বাল্যবিবাহ, উচ্চশিক্ষা ও চাকরি থেকে বঞ্চিত হওয়া, শিক্ষার প্রতি অনীহা ও অনাস্থা, শিক্ষার মর্যাদার সংকট, সৃজনশীল ও মেধা বিকাশের জট, মানসিক শিক্ষার সংকট, মানবিক শিক্ষার ঘাটতি ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের শিক্ষার অভাব| আবার যদি দীর্ঘমেয়াদি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সঠিক বাস্তবায়ন হয়, হয়তো তাহলে কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে|

সম্মুখসারির যোদ্ধা ও বয়স্কদের টিকা দেওয়ার পর বা পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষকদেরও টিকা দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি

বিজ্ঞাপন

বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদের এসব অপূরণীয় ক্ষতি ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ গঠনের নীরব হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রতিটি দেশের কাছে| এছাড়া কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষার সাথে যুক্ত শিক্ষার্থীদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে| বেসরকারি কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিলেও দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম থেমে আছে| করোনা মহামারি থামার কোনো লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না। টিকা আবিষ্কার হলেও টিকার সংকটের কারণে আগামী এক বছরে নিউ নরমাল বা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশাও কোনো দেশ করতে পারছে? তাহলে আগামী দিনগুলোতে কি শিক্ষার এ অপূরণীয় ক্ষতির কারণে শিক্ষার মহাসংকট আরো গভীর থেকে গভীরতর হবে?

এখনই যদি শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা না হয়, তাহলে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর সবার কাছেই পাওয়া যাবে। শিক্ষা কার্যক্রম চালু না হলে অনলাইন বা দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে যেভাবে আধো আধো শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, আগামী দিনগুলোতে যদি এভাবেই চলতে থাকে তাতে শিক্ষার অপূরণীয় ক্ষতির মহামারি ঠেকানো সম্ভব হবে না| সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে যে সঠিক অবকাঠামোর অভাবে বিদ্যালয়ের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অনলাইন বা দূরশিক্ষণ শিক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না| ফলে অবকাঠামো বা প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা (ডিভাইস এবং ইন্টার্নেট) তৈরি বা বৃদ্ধি না করলে দূরশিক্ষণ শিক্ষা পদ্ধতি তেমন কোনো কাজে আসবে না। অন্য একটি জরিপে দেখা গেছে যে, দেশে দারিদ্র্যের হার অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গেছে| এ দুটো জরিপের ফলাফল যে উদ্বেগের জায়গায় তৈরি করেছে সেটি হলো দরিদ্র ও টানাপোড়েন পরিবারের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার এবং বাল্যবিবাহের ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা তৈরি হওয়া|

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কোমলমতি শিশুরা শিক্ষাজীবনের প্রথম বছর শুরু করতে পারছে না, এ নিয়ে অভিভাবকরা অনেক দুশ্চিন্তায় রয়েছেন| শিক্ষিত অভিভাবকরা নিজেরা এ শিক্ষা চালিয়ে নিলেও প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে দরিদ্র, অশিক্ষিত কিংবা কম শিক্ষিত পরিবারে এটি ঘটছে না একেবারেই| ফলে তাদের জীবন থেকে একটি অথবা দুটি বছর এমনি এমনি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে| এছাড়া খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কার্যক্রম থেমে থাকার কারণে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে| শহরের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ওজন বৃদ্ধি, মানসিক অস্থিরতা, এমনকি নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে| ইন্টারনেট বা অনলাইনে বেশি বেশি সম্পৃক্ত থাকার সুযোগ বেড়েছে, যার অসৎ ব্যবহারে অনেকে নিজের বিপদ নিজেই নিয়ে আসছে|

এসএসসি এবং এইচএসসি চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার মানসিক দৃঢ়তা প্রমাণের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে, যা পরবর্তীতে উচ্চতর পর্যায়ের বিভিন্ন পরীক্ষায় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে অনেকের ক্ষেত্রে| স্কুল থেকে কলেজে বা কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অবতীর্ণ হওয়া নতুন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এর একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়বে। ইতিমধ্যে যারা কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হয়ে শ্রেণিকক্ষের ক্লাসের সুযোগ না পেয়ে অনলাইনে ক্লাস করছে, তাদের পড়াশোনার একটা নেতিবাচক মানদণ্ড তৈরি হচ্ছে। স্কুল-কলেজে বদলি বা নতুনভাবে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বাড়তি অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

সবগুলো সরকারি এবং অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত সেশনজটের তৈরি হয়েছে। এই সেশনজট ইতিমধ্যে ন্যূনতম ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে| কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম ঠিকমতো চালিয়ে নিতে পারছে এবং সম্প্রতি ল্যাবে কার্যক্রমও চালিয়ে নিতে পারছে| কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা এখনো সম্ভব হচ্ছে না| অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিলেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে|

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আগামী এক মাসের মধ্যে পরীক্ষা সংক্রান্ত সব কার্যক্রম চালানোর অনুমতি পেলেও ধারণা করা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যে প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম ৯-১০ মাস সেশনজটে পড়বে| প্রথম থেকে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের এই সেশনজট পরবর্তীতে কমানোর সুযোগ থাকলেও চতুর্থ বর্ষ বা চূড়ান্ত সেমিস্টার এবং মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা করার সুযোগ একেবারেই নেই। ফলে তাদের চাকরি খোঁজার সময়কালের ব্যাপ্তি কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়েছে|

ইউনেস্কোর এক সমীক্ষা মতে, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটি শিক্ষার্থী, যা মোট শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি করোনা মহামারির কারণে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে ৩১টি দেশে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে, যা সর্বোচ্চ ১৯০টি দেশে ছিল গত বছরের এপ্রিল মাসে। অন্যদিকে বর্তমানে আংশিক চালু রয়েছে এমন দেশের সংখ্যা ৪৮। সারাবিশ্বে প্রতিটি দেশে গড়ে চৌদ্দ সপ্তাহ শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ছিল, আংশিক চালুসহ হিসাব করলে যেটি গড়ে ২২ সপ্তাহ যা সারা বিশ্বের দেশগুলোর স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম সময়কালের দুই-তৃতীয়াংশ। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা কার্যক্রম আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ছিল, গড়ে যেটা ২৯ সপ্তাহ, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে গড়ে ২৮ সপ্তাহ উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে, তৃতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে গড়ে ২৭ সপ্তাহ মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। ওশেনিয়া অঞ্চলের দেশ গুলোতে ছিল সবচেয়ে কম যা গড়ে সাত সপ্তাহ।

বর্তমানে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে চালু রয়েছে ১০১ টি দেশে যার অনেকগুলোর করোনা পরিস্থিতি আমাদের দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির চেয়েও খারাপ। আমাদের দেশেও ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হবে বলে অধিকাংশ মানুষই মনে করেন| বাংলাদেশে গত বছর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় খারাপ অবস্থান। ভারতের শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দিন হতে বন্ধ হয়েছে কিন্তু সে দিক থেকে পাকিস্তান অনেকটা এগিয়ে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অতিসত্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে শিক্ষা মহাসংকট সামাল দেওয়া সহজ হবে।

বিজ্ঞাপন

করোনাকালে করোনার ক্ষতি মোকাবিলার জন্য নানা প্রণোদনা প্যাকেজ চালু হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে প্রণোদনার পরিমাণ আশাতীতভাবে কম, যা মোট প্রণোদনার মাত্র দশমিক ৭৮ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক ভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রে সহায়তার পরিমাণ প্রায় ১২ শতাংশ কমে গেছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে শিক্ষা ব্যয় এর ঘাটতি এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে| আমাদের দেশেও যথাযথ শিক্ষা প্রণোদনা প্যাকেজ চালু করা দরকার। যার মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া, আধুনিক শিক্ষা সরঞ্জাম ও শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার, দ্রুত শিক্ষাদানের উপায়, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ইন্টারনেট সেবা ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

সারাবিশ্বে শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ মিলে প্রায় ১০ কোটি মানুষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউনেস্কো। আমেরিকায়ও শিক্ষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দিয়ে বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ব্যাপক আলোচনা চলছে। অভয় ও নিরাপদে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানাবে যেকোনো দেশের প্রতিটি শিক্ষক, এটি আমার বিশ্বাস। সম্মুখসারির যোদ্ধা ও বয়স্কদের টিকা দেওয়ার পর বা পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষকদেরও টিকা দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, আইএসআরটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, আইএসআরটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নির্বাহী কমিটি।

বিজ্ঞাপন

এইচআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।