ভিকটিম ব্লেইমিং : এই হীনম্মন্যতার শেষ কোথায়?

লীনা পারভীন
লীনা পারভীন লীনা পারভীন , কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১২:৫৩ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২১

ভিকটিম ব্লেইমিং বা আক্রান্ত ব্যক্তিকে দোষারোপ করা একটি মনঃস্তাত্ত্বিক বিষয়। বিষয়টি নতুন না হলেও আমাদের দেশে বেশিমাত্রায় আলোচনায় এসেছে অতি সম্প্রতি। বিশেষ করে নারী নির্যাতন বা নারী ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বিষয়টি সামনে এসেছে।

ভিকটিম ব্লেইমিং বিষয়টিকে খুব সাধারণ ভাষায় ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায় যেখানে কোনো দুর্ঘটনা বা ঘটে যাওয়া কোনো অপরাধের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত ব্যক্তিকেই দায়ী করা হয় বা ঘটনার পেছনে সেই ব্যক্তির কোন ভূমিকা আছে কি না সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ ঘটনাকে প্রাধান্য না দিয়ে ঘটনার কারণকে প্রাধান্য দেয়া হয়। ভিকটিমের ঘাড়ে সামান্যতম দোষ চাপানোর প্রবণতাও ভিকটিম ব্লেইমিং হিসেবে পরিচিত। এই ভিকটিম ব্লেইমিং অতি পুরোনো একটি বিষয়। মানুষ তার স্বভাবগতভাবেই অন্যের দোষ খুঁজে বের করতে পছন্দ করে। কারও ঘাড়ে দোষ চাপানো মানেই নিজের সম্পৃক্ততার জায়গাটিকে মওকুফ করতে চাওয়া।

ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি সমাজে কোনো অঘটন ঘটলেই সেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে কেন সেই ব্যক্তিটির সাথেই এমন ঘটনা ঘটলো? বিশেষ করে নারীকেন্দ্রিক কোনো ঘটনা ঘটলে তো কথাই নেই। রাস্তায় ছেলেরা কোন মেয়েকে টিজ করলে বা উত্ত্যক্ত করলেও পরিবার থেকে সমাজ সবাই ব্যস্ত হয়ে যায় কেন মেয়েটিকে ছেলেরা উত্ত্যক্ত করলো সেই কারণ খুঁজতে। ব্যাপারটা এমন যে উত্ত্যক্ত করাটা অন্যায় নয় বরং কোনো মেয়ের রাস্তায় বের হওয়াটাই অন্যায়।

বলছিলাম এই ভিকটিম ব্লেইমিং বিষয়টি অতি সম্প্রতি বেশি করে আলোচনা হচ্ছে কারণ ধর্ষণের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে নারীর পোশাক বা তার চালচলন দায়ী। অথচ ধর্ষণ একটি অপরাধ আর এর জন্য নির্দিষ্ট আইন ও বিধিও আছে। ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে আইনি স্বীকৃতিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরও থামছে না ভিকটিমকে হেয় করার প্রবণতা। প্রতিটা ঘটনার পেছনেই আলোচনায় সামনে চলে আসে নারীরা কেন ধর্ষিত হচ্ছে। কেউ বলছে নারীর উন্মুক্ত চলাফেরাই এর জন্য দায়ী, কেউ বলছে নারী কেন ছেলেদের সাথে মিশবে, কেউ বা আবার বলছে নারীরা এমন সব পোশাক পরে যার কারণে পুরুষের মধ্যে যৌন উত্তেজনা তৈরি হয়। কেউ কেউ আবার দেখা যায় নিজেকে আলাদা প্রমাণ করার জন্য বলে থাকে যে তিনি এমন ঘটনাকে সমর্থন করেন না কিন্তু…। এই যে ‘যদি’ ‘কিন্তু’র খেলা এর মাঝ দিয়েই বেরিয়ে আসে আক্রান্তকে দোষী করার প্রবণতা।

মনোবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই আরও ভালো বলতে পারবেন কেন এই ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের চর্চা তবে আমার সাধারণ বুদ্ধি বলে এখানে দুটি গ্রুপের মধ্যে এই চর্চাটা বেশি দেখা যায়। একটা গ্রুপ হচ্ছে যারা অপরাধ বা অপরাধীকে আড়াল করতে চায় আর আরেকটা গ্রুপ হচ্ছে যারা অপরাধ কর্মটি কখনও নিজের সাথে ঘটেনি বা ঘটবে না এমন একটি ‘নিরাপদ’ সান্ত্বনা খুঁজতে চায়। অর্থাৎ আমি পবিত্র এমন একটি ধারণার জন্ম দিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগতে চায় তারা।

অতি সম্প্রতি কলাবাগানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের যে কিশোরিটিকে ধর্ষণ ও হত্যা করা হলো সেখানেও একই কাণ্ড দেখলাম আমরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এই ব্লেইম গেইমের খেলা আরও বেশি করে সামনে আসছে। একটি কিশোরী ধর্ষিত হলো এবং নির্মমভাবে অত্যাচারিত হয়ে মারা গেল এ ঘটনার চেয়েও বড় হয়ে আলোচনায় এলো কেন মেয়েটি একজন ছেলের বাসায় গেল? তার মানে কী? আমাদের সমাজে কি ছেলেমেয়ে মেলামেশা নিষিদ্ধ? ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক করা নিষিদ্ধ? যদি তা না হয়, তাহলে একজন বন্ধুর বাসায় আরেকজন বন্ধু যেতে পারবে না কেন? আর গেলেই কি তাকে ধর্ষণ করা বা হত্যা করা জায়েজ হয়ে যায়? নারী বলে কি তার জীবনের কোনো মূল্য নেই?

একজন মানুষের জীবনের চেয়েও তার চরিত্র বড় হয়ে গেল? অথচ ছেলেটির চরিত্র বা তার অপরাধ নিয়ে কোনো আলোচনা বা সমালোচনা সামনে এলো না। কতটা নির্মম এই মানসিকতা। আমাদের সমাজে আইন আছে, অপরাধ অনুযায়ী শাস্তির বিধান আছে অথচ কিছু মানুষ অপরাধকে অপরাধ হিসেবে মানতে নারাজ। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছি আমরা। একটি উন্নত দেশ মানে উন্নত সংস্কৃতি। উন্নত সংস্কৃতির একটি অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।

একটি সমাজ কতটা শিক্ষিত বা তার সাংস্কৃতিক চর্চা কতটা উচ্চতায় আছে সেটি বোঝা যায় সেই সমাজের নারীরা কতটা মর্যাদার আসনে আসীন আছে। এ বিবেচনায় আমরা কি আসলেই বলতে পারি যে আমরা উন্নত একটি দেশের দিকে হাঁটছি? কেবল অর্থনৈতিক সূচকে এগুলোই কি উন্নত বলা যায়? মানবিক সূচকে আগাচ্ছি আমরা কিন্তু সেখানে কতটা রুচির ছোঁয়া আছে সে হিসাবটি কি করছি?

ভিকটিম ব্লেইমিংয়ের ফলে একজন নারী যে কতটা হেয় হয়, কতটা মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে জীবন কাটায় সে বিষয়টিকে একেবারেই গ্রাহ্য করি না আমরা। ধর্ষণের মতো একটি ঘটনা যার জীবনে ঘটে তার মানসিক বিষয়টিকে আমরা ভাবতেই চাই না। যেন ধর্ষিত হওয়াটা সেই মেয়েটি বা নারীটিরই অপরাধ। ধর্ষকের কোনো অপরাধ নেই। লজ্জিত হয় নারীটি। অথচ লজ্জা পাওয়ার কথা ছিল ধর্ষকের, ধর্ষিত নারীর নয়।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি যে নেতিবাচক মনোভাব এরই এক নিকৃষ্ট প্রতিফলন হচ্ছে ভিকটিম ব্লেইমিং। নারীবিদ্বেষী মনোভাব তাদের যৌক্তিকভাবে ভাবতে দেয় না। ঘটনা যাই ঘটুক বা যেই ঘটাক তারা মুখস্থ ধরেই নেয় এর জন্য নারীটিই দায়ী। একবিংশ শতকের শেষ দিকে এসেও আমরা একটি সুস্থ মননের সমাজ পাইনি। বিজ্ঞান এগিয়েছে, আধুনিক বলে দাবি করি নিজেদের। অথচ মনন ও মানসিকতার দিক থেকে পড়ে আছি এখনও প্রস্তর যুগে যখন একজন ব্যক্তিকে অপরাধ প্রমাণের আগেই দোষী করে শাস্তি দেয়া হতো। যুগের পরিবর্তন হলেও মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াতে শিখছি না আমরা। এখনও একজন মাকে ছেলে ধরা সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। একজন ব্যক্তিকে কোরআন অবমাননার ধোয়া তুলে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়।

সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দাবি করি অথচ নিজের মগজকে কাজে লাগাই না। ধর্মের দোহাই দেই কিন্তু প্রকৃত ধর্ম কী শিক্ষা দেয় সেটি জানার চেষ্টা করি না। যে কেউ চাইলেই বিচারকের আসনে বসে যেতে পারছেন। এ বিচারক আদালতের নন, সমাজের বিচারক হয়ে যাচ্ছেন। একদল মানুষ আবার অন্ধের মতো সেই বিচারকদের মেনেও নিচ্ছে। ভিকটিম ব্লেইমিং একধরনের হীন মানসিকতার পরিচয় দেয়। নারীবিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ। এই নোংরা খেলা বন্ধ করা উচিত। একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ যার ন্যূনতম বিবেক বা বিবেচনাবোধ আছে তিনি এমন হীন চর্চা করতে পারে না। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার। এই পরিত্রাণের জন্য কেবল দরকার আপনার একটি সহমর্মী মন, যা দিয়ে আপনি নিজেকে সেই ক্ষতির স্থানে বসিয়ে উপলব্ধি করতে পারবেন কতটা নির্মম এই কর্মটি।

লেখক : কলামিস্ট, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।

এইচআর/এমকেএইচ

ভিকটিম ব্লেইমিং একধরনের হীন মানসিকতার পরিচয় দেয়। নারী বিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ। এই নোংরা খেলা বন্ধ করা উচিত। একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মস্তিষ্কের মানুষ যার ন্যূনতম বিবেক বা বিবেচনাবোধ আছে তিনি এমন হীন চর্চা করতে পারেনা। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার। আর এই পরিত্রাণের জন্য কেবল দরকার আপনার একটি সহমর্মী মন যা দিয়ে আপনি নিজেকে সেই ক্ষতির স্থানে বসিয়ে উপলব্ধি করতে পারবেন কতটা নির্মম এই কর্মটি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।