রাবেয়া খাতুন : আলোর শতদল

সাইফুল আলম
সাইফুল আলম সাইফুল আলম , সম্পাদক, যুগান্তর
প্রকাশিত: ০৫:৪৯ পিএম, ০৯ জানুয়ারি ২০২১

প্রিয় বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগরকে আমি কী বলে সান্ত্বনা দেব জানি না। যখন আমি নিজেই নিজেকে কোনো সান্ত্বনা-ভাবনা জোগাতে অপারগ বলে বোধ করছি। এই করোনা মহামারির কালে অনেক অনেক প্রিয়জন, প্রিয় মুখকে আমরা হারিয়েছি। যারা আমাদের জীবনকে নানাভাবে, নানা সূত্রে ছায়া দিয়ে, মায়া দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিলেন। একেকটা মৃত্যু যেন সেই ছায়া আর মায়ার অভাবকে প্রকট করে তোলে।

জন্মের মতোই সত্য মৃত্যু। আমরা ছিলাম না- আমরা আছি- আর আমরা একদিন থাকব না। এ কালচক্রেই আবর্তিত পৃথিবী। তারপরও এই থাকা, না থাকা নিয়েই আমাদের যত আয়োজন। আমিও কিছুদিন আগে আমার পিতাকে হারিয়েছি- অল্প ক’দিনের ব্যবধানে আমার শ্বশুর ও শাশুড়ি মা-কে হারিয়েছি। এই মৃত্যুগুলো যেমন ছায়া-মায়ার শূন্যতা উপলব্ধি করে গেছে, ঠিক একইভাবে উপলব্ধি করেছি- বন্ধু-স্বজন-সুহৃদরা যেন সেই ছায়া ও মায়া হয়ে ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছে আরও বেশি করে। আমার বিশ্বাস, প্রিয় বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগরও আমার মতো সেই উপলব্ধিটা অনুভব করবে- রাবেয়া খালাম্মার এই প্রস্থানে। যদিও তার এ চলে যাওয়াটাকে আমার কাছে চলে যাওয়া বলে বোধ হচ্ছে না। হয়তো বয়সের জ্যেষ্ঠতায় তিনি একটু এগিয়ে থাকলেন।

অন্যদিকে তিনি কিন্তু রয়েই গেছেন আমাদের মাঝে- তার কাজ, তার অতুলনীয় সাহচর্যের মাধুর্য কি আমাদের মন থেকে, হৃদয় থেকে মুছে যাবে? না, মুছে যাওয়ার উপায় আছে? অকাতরে অকৃপণভাবে বিলিয়ে যাওয়া ভালোবাসা মুছে যায় না, মিলিয়ে যায় না- থেকে যায়; সৌরভে গৌরবে, স্মরণে তা ফিরে ফিরে আসে- থেকে যায় হৃদয়ের মণিকোঠায়।

২.

আমরা যারা সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী এই ঢাকায় কৈশোর ও তারুণ্যে বেড়ে উঠেছি- তারা এক নিঃস্ব সময় থেকে ধীরে ধীরে আজকের এ আলো ঝলমল শহরের আলোকচ্ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে ধন্দে পড়ি- এমনটা হওয়ার নয়।

১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের পূর্ব প্রদেশের রাজধানী ঢাকা ছিল বাংলাদেশের আর দশটা মফস্বল অনুজ্জ্বল শহরের মতোই একটি শহর। দেশের অন্য কোনো জেলা শহরের কিশোর-তরুণদের মতোই আমাদের বেড়ে ওঠা, সাদামাটা। ঢাকায় আমরা এসেছিলাম পিতার পেশা সূত্রে- কেউ চাঁদপুর, কেউ বগুড়া, কেউ রংপুর, কেউ নোয়াখালী কিংবা যশোর থেকে। এখনো ঢাকা এমন করেই জনস্ফীতি বাড়িয়ে চলেছে।

ঢাকা শহরে আমরা স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম প্রজন্ম। আমরা পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের ঢাকাকে দেখিনি; যারা পঞ্চাশের দশকের প্রজন্ম তাদের অন্যতম পথিকৃৎ পরম শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রাবেয়া খালাম্মার মৃত্যুকে নিয়ে তার লেখার শিরোনাম দিয়েছেন- ‘পঞ্চাশের আরেক নক্ষত্রের বিদায়’- খুবই সত্যি তার এ শিরোনাম, তার অনুভূতি। আমরা এ নক্ষত্রের সুতীব্র দ্যুতি দেখিনি, কিন্তু তার স্নিগ্ধতার আলোয় পথ চলেছি। পেয়েছি জীবন গড়ার প্রেরণা। তার কাছ থেকে পেয়েছি তার সন্তানের মতোই স্নেহ, ভালোবাসা, প্রশ্রয়।

৩.

উনিশ শতকের সাত দশকের মধ্যভাগে অর্থাৎ, ’৭৭-৭৮ সাল থেকে আমরা যারা সদ্য তরুণ- বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কেউ কেউ বা পড়তে পড়তেই- জীবনের প্রয়োজনে পেশাগত জীবনে পা রেখেছি, সেই যাত্রায় বন্ধু সুহৃদরূপে যে পরিমণ্ডল নিজেদের জানার ভেতর গড়ে উঠেছে, সেই বন্ধুদের অন্যতম একজন ফরিদুর রেজা সাগর। অন্যদের মধ্যে লেখক ইমদাদুল হক মিলন, শিল্পী আফজাল হোসেন, সতীর্থ প্রয়াত শাহ আলমগীর, শাইখ সিরাজ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

শুধু তার ‘ছেলের বন্ধু’ এ অধিকারেই নয়, লেখালেখি, শিশু সংগঠন চাঁদের হাটের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, যে কোনো সাংস্কৃতিক উদ্যোগ-আয়োজনে, পেশাগত সম্পাদনার কাজে; যখনই যে প্রয়োজনে রাবেয়া খালাম্মার শরণাপন্ন হয়েছি; সহযোগিতা, সমর্থন চেয়েছি- আন্তরিকতার সঙ্গে তার পক্ষ থেকে সাড়া পেয়েছি।

যুগান্তরের ঈদ সংখ্যার জন্য তার লেখা উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি, গল্প চাইলে কখনো বিমুখ করেননি। যে কথা না বললেই নয়- এত পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন পাণ্ডুলিপি তিনি পাঠাতেন যে তার লেখা নিয়ে কখনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি আমাদের। লেখার বিষয়বস্তু কিংবা তার লেখার পরিসর- সব কিছুই থাকত পরিমিত। কোনোরকম অস্বস্তি কিংবা বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি তার লেখা ছাপতে গিয়ে। এমনকি ঈদ সংখ্যার উপন্যাসের জন্য যে ‘স্পন্সর’ সেটাও লক্ষ করেছি খুব সহজেই মিলে যেত খালাম্মার লেখার জন্য।

যারা সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশনার কাজে সংশ্লিষ্ট নন, তারা উপলব্ধি করতে পারবেন না আমার উপর্যুক্ত অভিজ্ঞতার বিষয়টি।

অনেক লেখকেরই বিভিন্ন ধরনের ‘ইগো’, অস্বস্তিকর আবদার এবং বিরক্তিকর বিড়ম্বনার সমস্যা সামাল দিতে হয় আমাদের। সেদিক থেকে রাবেয়া খালাম্মা ছিলেন একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট। একটা বিশাল স্বস্তিকর আশ্রয় আমাদের জন্য। খুব সম্ভবত তিনি নিজে পত্রিকা প্রকাশনার কাজটি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাতে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ ছিলেন বলেই এমনটা পারতেন।

৪.

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এক অবরুদ্ধ সমাজ, অবরুদ্ধ সময় এবং অবরুদ্ধ দেশে বৈরী বাস্তবতায় তাদের পথ চলতে হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে হাতেগোনা দু-তিনজন মুসলিম নারী সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে নিজেদের সম্পৃক্ত করার মতো সাহস দেখাতে পেরেছেন। রাবেয়া খালাম্মা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি যেমন কলম হাতে লিখেছেন, তেমনি নিবিড় নৈপুণ্যে সামলেছেন তার সংসারও। কোথাও ফাঁকি দেননি। না তার লেখালেখিতে, না তার সংসারের খাতায়। এখন যারা নারী স্বাধীনতার কথা ব্যক্ত করেন উচ্চ কণ্ঠে, তখন তারা সেই স্বাধীনতাকে অর্জনের জন্য দ্বিগুণ কর্ম ও উদ্যমে পরিশ্রম করেই কেবল তা পেতেন।

বাংলা ভাষায় একটা বহুল প্রচলিত প্রবাদ আছে- ‘যে মেয়ে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’- অর্থাৎ সুগৃহিণীকে সুসংস্কৃতও হতে হয়। তিনি শুধু নিজের গৃহই সাজিয়ে রাখেননি- পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্রতে সুসংস্কৃত হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও ছড়িয়ে দিয়েছেন তার পরিমণ্ডলে। যাকে বলে যথার্থ জীবন সংগ্রাম, সেই সংগ্রামটি কড়ায়গণ্ডায় করতে হয়েছে তাদের প্রজন্মকে।

আজ সার্বভৌম দেশে- মুক্ত সমাজে অনেক নারীই সেই কঠোর সংগ্রামটি কেমন ছিল তা ভাবতেও পারবেন না বলেই আমার ধারণা। আজ দেশে নারীরা সমাজের সর্বস্তরে, এমনকি সাংবাদিকতার মতো কঠিন পেশায় দুরন্ত দুঃসাহস নিয়ে কাজ করছেন। এ পরিবেশ তৈরির নেপথ্যেও তারা কাজ করেছেন- তাদের দেখেই সাহস সঞ্চারিত হয়েছে মেয়েদের মনে। আজ সমাজে নারীর যে মর্যাদা, অধিকার তার নেপথ্যে ছিল তাদের শ্রম, মেধা ও আত্মত্যাগ।

৫.

বলা চলে একটা পর্দানশিন সমাজ ও সময় থেকে তারা তাদের জীবন ও পথচলার শুরু করেছিলেন- অনেকটা অন্ধকার যুগও অতিবাহিত হয়েছে তাদের জীবনে। আমরা যদি তার পুরো জীবনটা দেখি- তাহলে দেখব সত্যিই তারা নক্ষত্রের মতোই অন্ধকারে দিগন্তে উঠেছিলেন- একই সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মকেও দিয়েছেন পথের দিশা। তাদের দেখানো সেই মিটিমিটি আলো তার পরবর্তী প্রজন্মকে অনেক সাহস ভরে পথ চলতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

নারীর ক্ষমতায়নকে তারা স্লোগানে স্লোগানে ব্যক্ত করেননি, উচ্চকিত করেননি। নারীর ক্ষমতায়নকে তারা নীরবে নিভৃতে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কাজে ব্রতী ছিলেন। কলমকে তিনি ডানায় পরিণত করেছিলেন। আর সেই ডানায় ভর করে অধিকারে নিয়েছিলেন অসীম অন্তরীক্ষ।

৬.

রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির গীত নৈবেদ্যে তাকে বলা যায়-

‘আকাশতলে উঠল ফুটে

আলোর শতদল।

পাপড়িগুলি থরে থরে

ছড়ালো দিক্-দিগন্তরে,

ঢেকে গেল অন্ধকারের

নিবিড় কালো জল।

মাঝখানেতে সোনার কোষে

আনন্দে, ভাই, আছি বসে-

আমায় ঘিরে ছড়ায় ধীরে

আলোর শতদল।’ ...

[গীতাঞ্জলি। গান : ৪৮। পৃ-৬৯]

রাবেয়া খালাম্মা আমাদের মাঝে আজ নেই, কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে-স্মরণে থাকবেন চির দেদীপ্যমান নক্ষত্রের আলোর শতদলরূপে।

ঢাকা, ৭ জানুয়ারি ২০২১

লেখক : সম্পাদক, যুগান্তর; সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব।

এইচআর/এমকেএইচ

আজ সার্বভৌম দেশে- মুক্ত সমাজে অনেক নারীই সেই কঠোর সংগ্রামটি কেমন ছিল তা ভাবতেও পারবেন না বলেই আমার ধারণা। আজ দেশে নারীরা সমাজের সর্বস্তরে, এমনকি সাংবাদিকতার মতো কঠিন পেশায় দুরন্ত দুঃসাহস নিয়ে কাজ করছেন। এ পরিবেশ তৈরির নেপথ্যেও তারা কাজ করেছেন- তাদের দেখেই সাহস সঞ্চারিত হয়েছে মেয়েদের মনে। আজ সমাজে নারীর যে মর্যাদা, অধিকার তার নেপথ্যে ছিল তাদের শ্রম, মেধা ও আত্মত্যাগ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।