সামাজিক বিভাজন, বড় ঐক্যের ডাক


প্রকাশিত: ০২:৪৯ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৫

এক ভয়ঙ্কর সময় এখন। রক্ত, অকারণ মৃত্যু। জিহাদের নামে খুন-ঝরানো এই ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে বড় ছোট শহরে, পথ থেকে অলিতে গলিতে, বইয়ের দোকানে, বাড়িতে, অফিসে, মাজারে, বাজারে।    

উগ্রপন্থার ঔদ্ধত্য দিন দিন যখন বাড়ছে তখন সাধারণ মানুষের প্রশ্ন আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতো আগের চেয়ে এখন অনেক আধুনিক, তারপরও কেন তারা এদের সাথে পারছে না? উত্তর অনেকগুলো হতে পারে। হয়তো আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরেই সমস্যা আছে, নয়তো সরকারই সঠিক নির্দেশনা তাদের দিতে পারছে না কিংবা সামগ্রিকভাবে সমাজে এই ধারণাটি স্পষ্ট হয়নি যে, যারা এমন উগ্রপন্থার পথ বেছে নিয়েছে, এরা মুখে ধর্মের কথা বললেও, এরা ধর্ম থেকে আসলে অনেক দূরে।  

বিভাজিত রাজনীতিতে একটি অংশ এমন উগ্রবাদী গোষ্ঠিকে নিজের মিত্র বলে মনে করে। ফলে সব ধরনের সমর্থন, সাহায্য, সহযোগিতা এবং নৈতিক সমর্থন দিয়ে চলেছে এই খুনি চক্রকে। আর যারা এ রাজনীতির ভিকটিম, যারা এর বিরোধিতা করে, তারাও পদে পদে আপোস করছে এই দর্শনের সাথে। ফলে এরা সংখ্যায় বাড়ছে, আক্রমণ করছে মুক্ত চিন্তার মানুষদের। এরা ফিরিয়ে আনতে চায় সেই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে যে রাজনীতি এ দেশটিই চায়নি ১৯৭১ এ।  

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা এদের মোকাবেলা করা। একই পুলিশ কর্মকর্তাকে নানা ধরনের কাজ করতে হয়। সাধারণ অদক্ষতা আর দুর্নীতির পাশাপাশি আছে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো সরঞ্জামের অভাব, জনবলের অভাব, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগের অভাব। আমরা জানি সারা দেশের সব মানুষকে আক্ষরিক-অর্থে নিরাপত্তা দেয়া কোনো দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে তাদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশ সদস্যরাই যদি আক্রান্ত হয় বা আক্রমণে জীবন হারায়, তবে আতঙ্কের বার্তা দ্বিগুণ হয়ে ছুটে দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
সমস্যা অনেক। পুলিশের বড় কর্তারা বলছেন, এজন্য দরকার বিশেষায়িত বাহিনী। সরকার তা বিবেচনা করবে। কিন্তু অনেক সমস্যার একটি বড় সমস্যা মনে হচ্ছে সরকারের রাজনীতি। পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়টি খুব স্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে না। এ দেশকে যারা মৃত্যু উপত্যকা বানাতে চায় তারা যতটা মানসিকভাবে দৃঢ়, ধারণা করা যায় এদের মোকাবেলার শক্তি সংখ্যায় বেশি হয়েও মানসিকভাবে ততটাই দুর্বল। দীর্ঘদিন ধরে কাউন্টার টেররিজম ব্যুরোর একটি প্রস্তাব সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, আলোর মুখ কবে দেখবে, তা কেউ জানে না।

সমাজের বহৎ জনগোষ্ঠিকে সাথে নিয়ে এই উগ্রপন্থাকে মোকাবেলা করার প্রচেষ্টাতেও আছে নানা ধরনের বিভাজন। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নির্লিপ্ততা এবং কখনো কখনো প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ বুঝিয়ে দেয়,  উগ্রতার বিরুদ্ধে উদারতার ঐক্য অনেক সময় সাপেক্ষ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা তথা জাতীয় মূলধারার রাজনীতিতে যত বিভক্তি দেখা দিবে, ততই রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে সাম্প্রদায়িক উগ্র জঙ্গি প্রতিক্রিয়াশীল মহল, যারা বাংলাদেশকে বানাতে চায় ‘মিনি পাকিস্তান’ কিংবা ‘তালেবানি রাষ্ট্র’। কিন্তু বৃহত্তর ঐক্যের যে কথা শুনি তার জন্য বড় ডাক কোথায়?   

ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের এক পতাকাতলে আনতে না পারলে জটিল সমীকরণে পড়বে রাজনীতি। শুধু মুক্তমনা লেখক-প্রকাশ নয়, হত্যা করা হচ্ছে পীর মুর্শিদসহ মাজারের খাদেমকে, বোমা হামলা হলো আশুরার প্রস্তুতি মিছিলে। এসবকিছু ইঙ্গিত দেয় এক বড় ষড়যন্ত্রের পথ ধরে এগুচ্ছে একটি মহল যারা সমর্থন পাচ্ছে দেশীয় আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে।

যারা এসব করছে তাদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে। কিন্তু এদর মোকাবেলা করতে আমাদের বাহিনীগুলো কি সেরকম ভাবে উদ্বুদ্ধ। পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা নিজেরা কতটা বুঝতে সক্ষম হন কোনটা ধর্মীয় বিধান আর কোন কাজটি ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি, বা খুনাখুনি? বলা হয় যখন দু’একজন ধরা পড়ে, তখন এদের প্রতি এক ধরনের কোমল আচরণ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কারণ এরা বারবার বাহিনি সদস্যদের ধর্মের কথা শোনাতে থাকে।  এটি এমন এক স্পর্শকাতর বিষয় যে, বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং উদ্বুদ্ধকরণ ছাড়া এসব আসাসমীকে জেরা করে কিছু বের করা সম্ভব নয়।

সাধারণ অপরাধীদের মতো এদেরকে মেলানোর আর কোনো সুযোগ নেই। মিলিয়ে ফেলা হয় বলেই এরা জামিনও পেয়ে যায় সহজে এবং বেরিয়ে এসে আবার একই ধরনের অপরাধ করে।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা, গোয়েন্দা দক্ষতা বাড়ানো এবং তাদের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চলবে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে এই উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলা। এবং এখানেই সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রশ্ন। বিএনপি-জামাত এসব উগবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, এটা সবাই জানে। কিন্তু আবার আওয়ামীলীগ নিজেও কোথায় যেন একটা দ্বিধা নিয়ে অগ্রসরমান। কতটা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করবে, আর কতটা ইসলামী রাজনীতি হবে, এই ভারসাম্যের রাজনীতিও উগ্রবাদিদের জন্য স্বস্তির জায়গা করে দিচ্ছে।   

আইসিসের মতো সাংগঠনিক কাঠামো না থাকলেও বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গী সংগঠন বা বিভিন্ন রকম গোষ্ঠি আছে যারা এই ধরনের হামলার সুযোগ খোঁজে। এরা যখন দেখে হামলা করে পার পাওয়া সম্ভব তখন তারা বেশি করে করছে। তারা বারবার একটি বার্তা দিতে চায় তারা দুর্বল নয়, সবল। এর বিপরীতে রাষ্ট্র কতটা কঠোর বার্তা দিতে পারছে তার উপর নির্ভর করে জনগণ আস্থা পাবে কতটা। একইসাথে উগ্রবাদীরা ভাববে কতটা কঠিন তাদের পথ চলা। পাকিস্তানে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস এবং সুন্নি গোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বিভিন্ন রকম জঙ্গী গোষ্ঠির উত্থানের পেছনে মূল কারণ ছিল সেসময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা ছিলেন তারা নিজেদের ক্ষমতার ভিত শক্ত করতে এদের নানাভাবে মদদ দিয়েছেন বা ক্ষমতার ভাগাভাগিতে নিজেদের মধ্যে যখন বিরোধে ব্যস্ত ছিলেন  তখন সেই সুযোগে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সহিংসতার বীজ বপন হয়েছে।

বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোর জন্ম ও বৃদ্ধি দেশজ এবং তারা বাংলাদেশের ভেতর যেসব আক্রমণ চালিয়েছে তা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার জন্যই করেছে। এদের পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রমাণও আছে। তবে অদূর ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলগুলোর সাথে এদের সাংগঠনিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে না তা ভাবার কোনো সুযোগ নেই।

ধর্ম নিয়ে যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করে, সামাজিক বিভাজনের সীমানাতেই তারা আঘাত করে। সময় হয়েছে ভাববার সেই সুযোগ তাদের দেয়া হবে কিনা।

syed-Ishtiaque-Reza

এইচআর/এসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।