বিপদগামীরা সংকট কত গভীর করবে?
আইএস, আল কায়েদা বা তালিবান নামে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্যে মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য দেশে যে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে তাতে কি ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী ফুটে ওঠে? এবং এতে কি ইসলামের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়? একই প্রশ্নগুলো তোলা যায় একই উদ্দেশ্যে এ দেশে যেসব সংগঠন জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে এবং নিরস্ত্র মানুষ খুন করে চলেছে তার ফলাফল সম্পর্কে।
হিংসাত্মক ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে ইসলামের নামে। তাদের আক্রমণের শতকরা নব্বই ভাগ ঘটছে প্রতিপক্ষ মুসলমানের ওপর। এটা ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির চেহারা নিয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একতরফা আক্রমণের শিকার হচ্ছে মুক্তচিন্তার মানুষ এবং মানবিক তথা প্রকৃত ইসলামে বিশ্বাসীরা। যে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিতর এভাবে নৃশংস হানাহানি চলে তার সম্পর্কে অন্য ধর্মের মানুষের মনে শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। ইসলামকে একটি যুদ্ধবাজ জঙ্গি ধর্মের ছাপ লাগিয়ে দিচ্ছে তারা। অথচ ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। এ ধর্মের মূল শক্তিই শান্তি ও সাম্যের বারতায়।
ইসলামের বিজয় ঠিক তলোয়ারের সাহায্যে হয় নি। সে যুগের যুদ্ধের মাধ্যমে কাউকে পরাজিত করা গেছে, পদানত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পরাজিত পদানত মানুষ ধর্মান্তরিত হয় বাধ্য হয়ে, অবস্থার গতিকে। কিন্তু যারা স্বেচ্ছায় সাগ্রহে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তারা তা করেছে এর সাম্য ও শান্তির বাণী শুনে, বিশেষভাবে নানা তরিকার সাধকদের সান্নিধ্যে এসে, কথা শুনে।
আজকের এই বিশ্বায়নের এবং বাজার অর্থনীতির ভোগবাদী পণ্য-সর্বস্ব জীবনে সব দেশে প্রায় সব মানুষের অন্তরে গভীর সংকট বিরাজ করছে। এ এক ধরনের আধ্যাত্মিক সংকট। শতাব্দীকাল আগে ব্রিটিশ দার্শনিক এএন হোয়াইটহেড আধুনিক কালের ঘনায়মান এই সংকটটি শনাক্ত করে বলেছিলেন চলমান ব্যবস্থার যে প্রবণতা তাতে মানুষ ক্রমেই নিজের অন্তরের শূন্যতায় গভীর সংকটে পড়বে। মানুষ তো সবসময় বিষয়-আশয় নিয়ে মগ্ন থেকে তার মনুষ্য জীবনের সার্থকতা ও চরিতার্থতা খুঁজে পায় না।
আজ এই দার্শনিকের আশংকা সত্যে পরিণত হয়েছে। এ সময়ে এ সংকটগ্রস্ত মানুষকে ইসলাম নিশ্চয় সেবা দিতে পারত। কিন্তু জঙ্গি সংগঠনগুলো ইসলামের নামে সন্ত্রাসের পথে চলে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ হত্যার যে ঘৃণ্য পথ ধরেছে তাতে সেই সুযোগ গভীর চ্যালঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এদের অমানবিক তৎপরতাই যদি ইসলামের নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে থাকে তাহলে অমুসলিমের মনে ইসলাম সম্পর্কে কী ধারণা হবে? শান্তিকামী নিরীহ সাধারণ মুসলমান, যাদের সংখ্যা সারা বিশ্বে কোটি কোটি- তারাই বা এর কী ব্যাখ্যা খুঁজবে?
জঙ্গি সন্ত্রাসের কারণে পাকিস্তান, আফগানিস্তান উঠে দাঁড়াতে পারছে না।
জঙ্গি হানাহানির কবলে পড়ে ইরাক, লিবিয়া বিপর্যস্ত। সিরিয়ায় সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। এসবের পেছনে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমের স্বার্থবুদ্ধির চাল আছে। তারাই তালেবান, আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট সৃষ্টি করেছে, এদের অস্ত্র সরবরাহের পিছনেও তারাই রয়েছে। কারণ আমরা দেখছি গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে সেসব দেশে সরাসরি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় আধিপত্য বিস্তারের হাত বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে পশ্চিমের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পক্ষে। বিপর্যস্ত দেশগুলোর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ার পর একদিকে তারাই তাঁবেদার শাসক সৃষ্টি করে পুরো অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে আর অন্যদিকে এক সময় তৈরি করা জঙ্গি সংগঠনগুলো সভ্যতা বিনাশের কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এই সুযোগে পশ্চিমা শক্তি নিজেদের অবস্থান সংহত করার জন্যে তাদের ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় র্শীষে রেখেছে আল কায়েদা, তালিবান বা আইএস প্রভৃতি সংগঠনকে।
বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার ইতিহাস হাজার বছরের বেশি। এখানে মূলত সুফি সাধকরাই ইসলাম প্রচার করেছেন, ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন। তাঁদের শিক্ষা এবং এদেশের ঐতিহ্যের মিশ্রণে এখানে মাবতাবাদী ধারায় ইসলামের চর্চা হয়েছে ও বিকাশ ঘটেছে। বাংলার মানবতাবাদ অত্যন্ত শক্তিশালী, বিশেষত ইসলামের প্রভাবে এই মানবতাবাদে সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুুক্তি ঘটেছে ও সাম্য মৈত্রীর চেতনা পুরিপুষ্ট হয়েছে যা পশ্চিমের মানবতাবাদে আমরা দেখি না। ইসলাম এভাবে জীবনের নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এখানে এবং বিশ্বের নানা দেশে। এটাই ইসলামের শক্তিশালী মূলধারা।
আজ পশ্চিমের চালে এবং অশিক্ষা ও ধর্মের ভ্রান্ত ধারণা ও ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে কিছু বিপথগামী মানুষ ভ্রাতৃঘাতী সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়ে মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে নেমেছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি কোনো ধর্মেই স্বীকৃত নয়, ইসলামে তো নয়ই। তারা যা করছে তাকে কোরানের আলোকে জেহাদ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এই সংকটের সময় মুসলিম সমাজ ও ইসলামের এবং মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা উচিত প্রকৃত আলেম ওলেমাদের। সাম্য এবং ঐক্য ও শান্তির বাণী আজ জরুরি যা ইসলামের জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে তারা দিতে পারেন।
লেখক : সাংবাদিক, কবি ও চিন্তাবিদ
এইচআর/এমএস