খবর শুনবেন ভালো খবর?

শাম্মী আক্তার
শাম্মী আক্তার শাম্মী আক্তার
প্রকাশিত: ১০:২৯ এএম, ০৮ অক্টোবর ২০২০

যেকোনো পণ্যের মিস ব্রান্ডিং বা মিস লেবেলিং ভোক্তার জন্য ক্ষতিকর কারণ এর মাধ্যমে ভালো লেবেলিং এর আড়ালে ভোক্তাকে নিম্ন মানের পণ্য দেয়া হয়।

তেমনি প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় কোন রাজনৈতিক দলের লেবেল ব্যবহার করে যখন কেউ নিজের অপকর্ম, কুকর্ম আড়াল বা জায়েজ করতে চায় তখন সেটা সাধারণ মানুষের জন্য অস্বস্তি বা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্যে ভেজাল বা মিস ব্রান্ডিং রোধে যেমন বিভিন্ন রকমের কার্যক্রম পরিচালিত হয় তেমনি বর্তমান পেক্ষাপটে মানুষের মধ্যে ভেজাল মানুষ, দূষিত মানুষ খুঁজে বের করার জন্য আরও সূক্ষ্ম পুঙ্খানুপুঙ্খ অভিযান চলমান থাকা প্রয়োজন।

বিশেষভাবে অভিশপ্ত ধর্ষণ যে এলাকায় সংঘটিত হবে সেই এলাকার প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও ধর্ষণ প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে। ধর্ষক নির্মূলকারী সেল গঠন করতে হবে। কোন পাপীষ্ঠ ধর্ষক কোনভাবেই যেন রাজনৈতিক পরিচয়ের বদৌলতে পরিত্রাণ পেয়ে না যায়। ইদানিং মনে হয় কিছু অমানুষ রাজনীতির সৌন্দর্য, রাজনীতির সংজ্ঞা, রাজনীতির মূল মন্ত্রটাই পাল্টে দিতে চাচ্ছে। মানুষের জন্য রাজনীতি, মানুষের কল্যাণে রাজনীতি এটাই তো মূল নীতি। এর থেকে বিচ্যুতি মানে তো মানুষের দুর্ভোগ।

ছোটবেলায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে বাবাকে দেখেছি আমাদেরকে কম সুযোগ দিয়ে বাড়ি থেকে টাকা পয়সা নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে। তখন থেকেই জেনেছি একজন রাজনীতিবিদ, একজন জনপ্রতিনিধির কাজ কী, তারা কেমন। যে নিজের ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে জনমানুষের কল্যাণে কাজ করে তাকেই তো রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধি বলে।

যাই হোক, কিছু মানুষের অপকর্মের জন্য আসলে রাজনীতি না জনপ্রতিনিধির সংজ্ঞা বা আদর্শ পাল্টে যাবে তা ঠিক নয় বরং আরও জোরালোভাবে মূল আদর্শ কে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যেতে হবে। ছোটবেলায় ভাবতাম রাজনীতিবিদেরা সব সময় সাদা পোশাক পড়ে কারণ তারা আলাদা অন্যদের থেকে, তারা ভালো। কিন্তু কই সেই সাদা পোশাক? আর কত দাগ, কতো কাদামাটি লাগলে সেটা ফেলে নতুনভাবে নতুন সাদা জামা পরবে তারা?

এইসব নোংরা দাগ পরিষ্কার করার জন্য প্রয়োজন বেশি বেশি শুদ্ধি অভিযান। পাশাপাশি বেশি বেশি করে যারা রাজনীতি বা জনপ্রতিনিধির প্রকৃত আদর্শ ধারণ করে বা সে অনুযায়ী কাজ করে তাদেরকে যথাযথভাবে সামনে তুলে ধরতে হবে যাতে করে অন্যরা আলোড়িত হয়, উদ্বুদ্ধ হয়। দূষিত ভেজাল মানুষের ভিড়ে যেন চিরাচরিত মূলনীতি হারিয়ে না যায়। এটা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে নইলে বিশেষভাবে "জেড জেনারেশন" এর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরা খারাপ বা ভুল পথ বা পন্থাকেই সঠিক মনে করবে।

অন্যদিকে গন্ধযুক্ত রাজনীতিবিদ নামধারী মানুষের এই রাজনীতিবিদ লেবেল নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে রাজনীতির প্রকৃত সৌন্দর্য , প্রকৃত মর্মার্থ রক্ষা পাবে। জনকল্যাণের পরিবর্তে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের রাজনীতির ছায়া তলে স্থান দেয়া যাবে না। রাজনীতির প্রকৃত আদর্শ সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়োজন সুন্দর মনের জনহিতৈষী মানুষ।

আমার মেয়ের দাদা, নানা, বাবা সবাই যেহেতু এই পথের ফেরিওয়ালা তাই মাঝে মাঝে মেয়েকে রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এই যেমন রাজনীতিবিদ মানে কী, তারা কী করে, সংসদ ভবনে হাসিনা দিদারা (সে এভাবে সম্মোধন করতেই পছন্দ করে) কী করে ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মানে, রাজনীতিবিদের দ্বারা সমাজে যখন ভালো ভালো গল্প তৈরি হবে, তাদের দ্বারা ভালো ভালো কাজ হবে তখন শিশুদের মনে এগুলো ভালো প্রভাব ফেলবে কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমান পরিবেশ কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।

ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়াতে শুধু মন খারাপ করা খবর, দুশ্চিন্তার খবর! কেমন যেন একটা অস্থির উদ্বেগপূর্ণ সময়! কিছু মানুষের মনে হচ্ছে মানুষ পরিচয় ভালো লাগছে না। তারা একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে খারাপের প্রতিযোগিতা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা! বিষয়টা অনেকটা এরকম। অমুক অমুককে ঠকিয়ে ১০ লাখ টাকা লোপাট করেছে তো আমি কম যাবো কেন আমার তো আরো বেশি ক্ষমতা আমি তো বিশাল কিছু আমি করবো ২০ লাখ টাকা লোপাট। একটা খারাপ বাজে গল্প আরেকটা খারাপ ঘটনার ইন্ধন দিচ্ছে। এ যেন খারাপের দুষ্টচক্র। কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির বিধানই এই দুষ্টচক্র কে ভাঙতে পারে। তবে অবশ্যই তা হতে হবে খুব তড়িৎ।

অন্যদিকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যেটা তা হচ্ছে যৌন নির্যাতন। এটা মনে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ছোঁয়াচে হয়ে যাচ্ছে। যেমন আজ গণমাধ্যম যদি খবরে দেখায় অমুক মেয়ে বা শিশুকে ঘরের মধ্যে অমুক ধর্ষণ করেছে ব্যাস তাতেই শুরু হয়ে যায় আর এক জঘন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ব্যাপারটা অনেকটা এমন। ধুর! ওই ছোকরা ওকে একা ঘরের মধ্যে ধর্ষণ করেছে ব্যাপার না। আমাকে চেনো? আমি অমুকের অমুক! আমার কত দলবল! কত ক্ষমতা! আমি করবো খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায় ! গনধর্ষণ! ((উহ! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে! আমি তো মেয়ে, মেয়ের মা!))

মানুষ অবাক হয়ে দেখবে আর বলবে ওরে বাপরে ছেলেটার কত সাহস রে বাবা ! এটাই তো চাই। আমি তো বীর। তারপর গনমাধ্যম ফলাও করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আমাকে দেখাবে মানুষ দেখবে আমার ক্ষমতা। আমি তো হিরো। সেক্সুয়াল বস! ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হতে পারলেই পরবর্তীতে ক্ষমতাধর পরীক্ষায় পাস কৃত লাইসেন্স ওয়ালা ধর্ষক!

কী হচ্ছে এসব! সৃষ্টির সেরা জীব "আশরাফুল মাখলুকাত" আজ যেন সৃষ্টির সবচেয়ে "ভয়ঙ্কর নিকৃষ্টতম প্রাণি" তে রুপান্তরিত হচ্ছে। কী অশুভ! আচ্ছা আমরা তো প৺চনশীল জিনিস বিভিন্ন উপায়ে সংরক্ষণ করি আবার কোনটা বেশি পঁচে গেলে সেটা ফেলে দেই। মানুষের পচন রোধের ফর্মুলা ঠিক আছে তো? নাকি আরো ডোজ বাড়ানো প্রয়োজন? একেবারে নষ্ট হয়ে যাওয়া, পঁচে যাওয়া মানুষের ক্ষেত্রে কি করা উচিত? তাদেরকে সমাজে বাঁচিয়ে রাখা কি নিরাপদ হবে? ক্রস কন্টামিনেশন বলেতো একটা ব্যাপার আছে।

আচ্ছা গণমাধ্যম যদি এইসব সমাজ বিনষ্টকারী ঘটনা না দেখায় তাহলে কি তাদের টিআরপি অনেক কমে যাবে? যদি এমন হয় গণমাধ্যম এইসব অমানুষদের নোংরামি, বিকৃত কর্মকাণ্ড দেখাবে না তাতে তো বিকৃত মানুষের বিকৃত মনবাসনা অনেকাংশে পূর্ণ হবে না (প্রয়োজনে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোকে সহায়তা দিবে সরকার)। এতে করে ধর্ষণের শিকার হওয়া মানুষটা মানুষের কটূক্তি থেকে রক্ষা পাবে এবং স্টিগমাটাইজেশন একটু হলেও কম বোধ হবে। কারণ এই পৈশাচিক বিষয় যত সামনে আসবে অন্যান্য দূষিত মস্তিষ্ক ততবেশি উজ্জীবিত হবে, প্রলুব্ধ হবে ভাববে এই সমাজে এসব হরহামেশাই হয় (একমাত্র অন স্পট সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানই এই চক্র বন্ধ করতে পারে)

মনে হতে পারে তাহলে গনমাধ্যমের কাজ কী হবে? গণমাধ্যম পর্দার বাইরে থেকে গোপন উইং বা সোর্স হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সহায়তা করবে। প্রয়োজনে আলাদা ইউনিট থাকবে তাদের যেটাকে বলা যেতে পারে "গোয়েন্দা গণমাধ্যম"। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা গণমাধ্যমের ত্বরিৎ কার্যক্রমের ফলাফল হেডলাইন আকারে মানুষ জানবে এবং সতর্ক হবে।

এই সকল বিষাদময় খবরের পরিবর্তে আমরা দেখতে চাই মন ভালো করা খবর, আশা জাগানিয়া খবর, উৎসাহব্যঞ্জক খবর। আমার মাথায় আসেনা ২৪ ঘন্টা গণমাধ্যমকে কেন চলমান থাকতে হবে? এর কি কোনো বাধ্যবাধকতা আছে? প্রতিটা দিন সকাল সকাল শুরু হয়ে যায় ব্রেকিং নিউজ! (মনে হয় ঘরের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে)। এই ধর্ষণ, এই চুরি ডাকাতি, এই মারামারি, এই পুলিশের তাড়া, ইত্যাদি। এভাবেই দিনের শুরু! এভাবেই দিনের শেষ। একেবারে মনের মধ্যে গেঁথে না দেওয়া পর্যন্ত চলতেই থাকে চলতেই থাকে।

অবাক লাগে কারণ ভালো কাজ তো অনেক হচ্ছে, অনেক। ভালো খবর, ভালো গল্পও অনেক আছে। সেসব তো দেখি না বারংবার প্রচার করতে। হৃদয়ে গেঁথে দিতে! এমন কি হতে পারে না? সবার সকাল শুরু হবে সুন্দর সুন্দর অনুপ্রেরণাদায়ী, মানসিক শক্তি জাগানিয়া খবর দিয়ে! বিষয়টা এমন এগুলো দেখে কেউ বলবে দেখো দেখো অমুক কী ভালো কাজ করছে/করেছে। আমিও করতে চাই এমন ভাল কাজ। কী দারুণ দিনের শুরু তাই না?

গণমাধ্যমের কাজ যেমন সমাজের দর্পণ হিসেবে ভূমিকা রাখা তেমনি মানুষের ভাবনার ভিত মজবুত করা, তাদের চিন্তাকে নাড়িয়ে দেয়া। আমরা তো আশা করতে পারি সেটা হবে অবশ্যই ধনাত্মক। মোদ্দা কথা হচ্ছে যে জিনিস ছোট বড় সবাই দেখে সেটার সময় নিয়ে, ধরন নিয়ে, বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক বেশি পর্যালোচনা এবং সঠিক পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।

যাই হোক, ভালোভাবে যেতে হলে বহুদূর, পরিবর্তন প্রয়োজন আমূল। শুরু হক ভালোর চক্র, ধনাত্মক চক্র। ছুঁয়ে যাক সবাইকে। পৃথিবী হোক সবার জন্য নিরাপদ।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[email protected]

এইচআর/এমকেএইচ

অবাক লাগে কারণ ভালো কাজ তো অনেক হচ্ছে, অনেক। ভালো খবর, ভালো গল্পও অনেক আছে। সেসব তো দেখি না বারংবার প্রচার করতে। হৃদয়ে গেঁথে দিতে! এমন কি হতে পারে না? সবার সকাল শুরু হবে সুন্দর সুন্দর অনুপ্রেরণাদায়ী, মানসিক শক্তি জাগানিয়া খবর দিয়ে! বিষয়টা এমন এগুলো দেখে কেউ বলবে দেখো দেখো অমুক কী ভালো কাজ করছে/করেছে। আমিও করতে চাই এমন ভাল কাজ। কী দারুণ দিনের শুরু তাই না?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।