একটা শব্দ এবং লুণ্ঠিত মানবতা
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনার ভিডিও আমি ১০ সেকেন্ডের উপর দেখি নি, দেখতে পারি নি। আমার বিশ্বাস যারা দেখেছেন, তাদের অনেকেই হয়ত ভালো করে ঘুমোতে পারবেন না। অন্তত একটা মানসিক ডিসট্রেস তাকে কয়েকদিন জাগিয়ে রাখবে কিংবা দুঃস্বপ্নে কেঁপে কেঁপে উঠবে অন্তরাত্না।
সিলেট জেলায় আমার বাড়ি, স্বাভাবিকভাবেই সিলেটের ভালো খবর যে কোন সিলেটবাসীকে আনন্দিত করে। যে কোন উজ্জ্বল সংবাদে আমরা গর্বিত হই। এই-ই মানুষের স্বাভাবিকত্ব।কিন্তু এই জায়গায় সিলেট যেখানে সারা পৃথিবীতে ছড়িযে পড়ে দুঃসহ নাম হয়ে, তা-ও শতাধিক বছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষাঙ্গনের ছাত্রাবাসে যখন ঘটে একালের এক নিকৃষ্ট পৈশাচিক বর্বরতা, তখন স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।
এ কদিনে সিলেটের এই ঘটনার পর 'গ্যাং' 'সংঘবদ্ধ' 'গণ' শব্দগুলো পরে যে শব্দটি বার বার ব্যবহৃত হচ্ছে, তাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা সারা মিডিয়াই যেন এই শব্দে সয়লাব হয়ে গছে। দেশজুড়ে একই শব্দ। মিছিলে একই শব্দ, টিভি টক শোতে একই শব্দ। শব্দটা যেন গোটা সমাজকে ধিক্কার দিচ্ছে। আর মানুষের মুখ থেকে এই শব্দটা উচ্চারণ করে যে কোন মানুষকেই বার বার লজ্জিত করছে। কারণ এই শব্দে লুণ্ঠিত হচ্ছে সমাজ-সভ্যতা।
শুধু লজ্জা বললে একটা দায় মুক্তি মেলানো যায়। ‘সরি’ কিংবা দুঃখিত বলে নিজেকে দায়হীন আঁতেল বানানো যায়। কিন্তু এ দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি কি মেলে ? এক বন্ধু সেদিন সিলেট-বেগমগঞ্জ কিংবা আরও ভিন্ন জেলার ঘটনাগুলোর জন্য ঘৃণা প্রকাশ করে আলাপচারিতায় বলছিলেন, এরকম নৃশংসতা আগেও ছিল, কিন্তু এত হৈ চৈ ছিল না। আমি তাকে অন্য কিছু না বলে শুধু বলি, এ দেশে কি মেয়েগুলো ঘোমটা দিয়ে হাঁটে, হাঁটে না। একটা প্রচণ্ড রকম খোলামেলা সমাজে এ মানুষগুলোর বসবাস । কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাগুলোর সাথে মিলালে এ দেশগুলোতে তা যে নিতান্তই অনুল্লেখযোগ্য, তাতো স্বীকার করতেই হবে। আর তার একমাত্র কারণ হল, সমাজ এভাবেই এগুচ্ছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণেই নাগরিকদের পারস্পরিক সম্মানবোধ, কিংবা ভয় কতিপয় অপরাধীদের এজাতীয় অপরাধে নিরুৎসাহিত করে।
আগের আমলে 'বিএনপি'র আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব অপকর্ম হয়েছে' এ কথাগুলো বলে কি ঐ নারীদের কালিমা থেকে মুক্ত করা যাবে ? অন্য সরকারের 'আশ্রয়-প্রশ্রয়ের' কথা বলে 'দায়মুক্ত' করার আত্ন সন্তুষ্টি আসতেই পারে, কিংবা ভক্ত কর্মীরা হয়ত 'বিএনপি'র আশ্রয়-প্রশ্রয়ে'র কথায় বাহবা দিতেই পারেন কিন্তু এসব উক্তি দিয়ে ব্যাপক মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিংবা 'ষড়যন্ত্র' বলে এসব ঘটনাগুলো থেকে কি আমরা রেহাই পাচ্ছি। বক্তৃতায় নিরাপত্তা দেয়া যায় না। সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীরা একজন নারীকে বিবস্ত্র করছে, মারছে আর নিজেকে বাঁচাতে সম্ভ্রম বাঁচাতে মিনিটের পর মিনিট ঐ নারী জাহান্নামের আগুনে জ্বলছে, এই নরকে জ্বলা পাষণ্ডরা ভিডিওতে ধারণ করছে, সেখানে কিসের ষড়যন্ত্র। তাহলে ঐ নারী কি নিজেকে জ্বালিয়ে এখানে একটা ষড়যন্ত্র তৈরি করছেন। কি বিস্ময়কর শব্দ মাননীয় আইন মন্ত্রী! ষড়যন্ত্রের সংঘাটা কি আবার আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে ।
প্রধানমন্ত্রীর ভবনের দিকে দাবি নিয়ে মিছিল করেছে ছাত্রীরা, ছাত্ররা।'ধর্ষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশণ্ড সয়লাব হয়ে গেছে চারপাশ। মিছিলের শব্দগুলো জানান দিচ্ছে, কিভাবে একটা সমাজে ক্রমশ ধস নামছে। কেনইবা এ ধস। একটা সমাজ সহসাই ধস নামে না। এ ধসের প্রেক্ষিত থাকে। নেতা কিংবা জনপ্রতিনিধিদের কথা বাদই দিলাম, একজন বিসিএস ক্যাডার যদি চাকুরীশেষে কোটি কোটি টাকা খরছ করে নির্বাচন করতে পারেন, একজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যান, প্রেসের মেশিনম্যান যদি কোটি কোটি টাকা বানিয়ে ফেলেন শুধু প্রশ্ন বিক্রি করে,ক্রেয় করা প্রশ্নের উত্তর লিখে যদি শত শত ছাত্র ডাক্তার হয়ে সমাজে চিকিৎসা দিতে থাকেন, প্রদীপদের মত ওসিরা খুন-চাঁদবাজি করে যদি শত সহস্র কোটি টাকার মালিক হয়ে যান, তখন সমাজে আর সুশাসন থাকে না। কাণ সুশাসন যারা প্রণয়ন করবে, জনগণকে যারা সুরক্ষা দেবে, তাদের অর্থের উৎসতে যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রভাবক হয়ে যায়, তাহলে এ সমাজের তরুণরা ঐ পথেই এগুবে। আদর্শ এখানে কাজ করবে না।
আমার তিনটি মেয়ে স্কুল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। বড় মেয়েটা তার ক্লাশ থেকে ফিরতে তার বেঁধে দেয়া সময় থেকে যদি একটু দেরি করে, আমি টেক্সট করি। মেয়েটাই বলে, আমি যে অনেক বড় হয়েছি আব্বু। তাকে নিয়ে আমার প্রতিদিনের শংকা তাঁর ভালো লাগে না। সে হাসে, তার মা-ও বলে এত আতংকগ্রস্ত হই কেন। অথচ দুর্ঘটনা যে এই ব্রিটেনে নেই তাতো নয়। গ্যাংগ ফাইট, বর্ণবিদ্বেষ, মাদক সব কিছুই আছে। তবুও বেড়ে উঠা প্রজন্ম থাকে নির্বার। কারণ তারা জানে, সামগ্রিকভাবে দেশটা তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। এ তাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসটাই প্রধান। তারা এভাবেই বেড়ে উঠছে।
আমি লিঙ্গ বৈষম্যের কথা বলছি না, তবে বর্তমান বাস্তবতায় নারী শব্দটিই উঠে আসছে। একদল পুরুষের কাছে এসব নারীরাই পিষ্ট হচ্ছে, আমরা দেখছি প্রতিদিন নতুন নতুন নৃশংসতা। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রীর অফিস মুখী যাত্রা। আমরাও চাই না , প্রধানমন্ত্রীর ভবনের দিকে মিছিল যাক, কিন্তু নাগরিক নিরাপত্তা চায়। নির্ভর করতে চায় কারো উপর। আর এ নির্ভরতা দিতে পারে শুধুমাত্র রাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রীইতো এ রাষ্ট্রের শেষ আশ্রয়স্থল।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমকেএইচ