‘আব্বা গো তোর আল্লাহর দোহাই ছাড়ি দে’
রোববার রাতে এটিএন নিউজে নিয়মিত টক শো ‘নিউজ আওয়ার এক্সট্রা’য় আমি কথা বলেছি নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে। সম্প্রতি দেশজুড়ে ধর্ষণ, হত্যা, নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটই আলোচনার বিষয়। অতিথিরা নারীর প্রতি সমাজের মনোভাব, সমাজ নারীর জন্য আরও অনিরাপদ হয়ে ওঠা, ধর্ষণের দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া, বিচারহীনতা, ভিক্টিম ব্লেমিং, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত দায় নিয়ে কথা বলেছেন। কথা হয়েছে ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিক ধর্ষণকামী মানসিকতা, অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি বিষয় নিয়েও।
সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু পুলিশের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে দাবি করেছেন, দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন নারী ধর্ষিত হয়। আমরা জানি, ধর্ষণের সব ঘটনা থানা-পুলিশ পর্যন্ত যায় না। তারপরও এই পরিসংখ্যান ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্করতা এখানেই শেষ নয়। যারা সাহস করে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে থানা পর্যন্ত আসতে পারে, তাদের বেশিরভাগই আদালত পর্যন্ত বিচারপ্রক্রিয়া টেনে নিতে পারে না। অথবা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ধর্ষক খালাস পেয়ে যায়।
একই ঘটনায় ধর্ষক বুক ফুলিয়ে হাঁটে আর ধর্ষিতা, যার বিন্দুমাত্র দোষ নেই, সে লজ্জায় মুখ লুকায়। সমাজের এই মানসিকতা বদলাতে না পারলে, ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে; ধর্ষণকে লঘুপাপ, বয়সের দোষ মনে করা বন্ধ না করলে, ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দেয়াকেই ভালো বিচার মনে করার প্রবণতা থেকে বেরুতে না পারলে এ রাষ্ট্র কারও জন্যই নিরাপদ থাকবে না। তবুও অনুষ্ঠান শেষ করেছিলাম, নারীদের জন্য একটি মর্যাদার, ন্যায্যতার নিরাপদ সমাজের প্রত্যাশা দিয়ে।
তখনও আমি জানতাম না সামনে কী ভয়ঙ্কর এক রাত অপেক্ষা করছে আমার জন্য। অফিস থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে দেখি ফেসবুকে ঝড়। তখনও আমি পুরো ঘটনা জানি না। বিভিন্ন নিউজ পোর্টালে খবরটি দেখে আমি স্তম্ভিত। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম, ‘আমি ভাগ্যবান, নোয়াখালীর ভাইরাল ভিডিওটি আমাকে দেখতে হয়নি। ইউটিউব সম্ভবত সরিয়ে নিয়েছে। আমি দুর্ভাগা, এই দেশে একজন নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেও দিনের পর দিন আটকে রাখা যায়। থানা-পুলিশ-প্রশাসনের টনক নড়তে ৩২ দিন লাগে। ভিডিওটি ভাইরাল না হলে হয়তো এই দুর্বৃত্তরা আড়ালেই থেকে যেত। গণ্ডার প্রশাসন ৩২ দিন পর হলেও মাঠে নেমেছে, একটা পশুকে গ্রেফতার করেছে, বাকিগুলোকে খুঁজছে। আপাতত এটুকুই স্বস্তি।
তবে এই পশুগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া স্বস্তি আসবে না।’
তখনও জানতাম না, আমার জন্য কী ভয়ঙ্কর রাত অপেক্ষা করছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার পর কয়েকজন আমার ইনবক্সে ভিডিওটির লিঙ্ক পাঠান। আমার কাছে ইনবক্সে পাঠানো ভিডিওটির দৈর্ঘ্য এক মিনিট ৩৮ সেকেন্ড। টানা এই ভিডিও দেখা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষেই সম্ভব না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা দেখার পর মনে হচ্ছে, কেন দেখলাম, কেন দেখলাম। আমার মাথার ভেতরে যে একটা অন্ধকার স্মৃতি চিরদিনের জন্য গেঁথে গেল, তার প্রতিকার কোথায় পাব? এই ভিডিওটিকে অনেকে ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’, ‘পাশবিক’ বলছেন। আমার ধারণা মধ্যযুগেও মানুষ এত নির্মম ছিল না। আমি নিশ্চিত, পশুদের সমাজেও এমন নৃশংসতা নেই। এমন নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, বিকৃতি শুধু মানুষের পক্ষেই সম্ভব। সিনেমাতেও আমি কখনো এমন বিকৃত নিষ্ঠুরতা দেখিনি।
ঘটনাটি ২ সেপ্টেম্বরের। নির্যাতিত গৃহবধূর বিয়ে হয় বছর তিনেক আগে। স্বামী তাকে রেখে অন্যত্র দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দীর্ঘদিন তার সঙ্গে স্বামীর কোনো যোগাযোগ ছিল না। ঘটনার রাতে স্বামী ওই গৃহবধূর ঘরে ঢোকেন। স্থানীয় মাদক চোরাকারবারী দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ওই ঘরে প্রবেশ করে গৃহবধূকে মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে ওই গৃহবধূকে পিটিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে তার ভিডিওধারণ করে। বিবস্ত্র নারীর গলায় পা দিয়ে চেপে ধরে একজন। তার যৌনাঙ্গে টর্চলাইট ও লাঠি ঢুকিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়। আমার সেই বোনটি যখন বারবার হাত দিয়ে নিজের উন্মুক্ত শরীরের আবরু ঢাকার চেষ্টা করছিল, তখন আসলে গোটা জাতি বেআবরু হয়ে যায়, লজ্জায় সবার মাথা হেঁট হয়ে যায়। দেলোয়ারসহ যে পাঁচজন একজন বিবস্ত্র নারীকে ঘিড়ে উল্লাস করছিল, তারা দেখতে মানুষের মতো; তাই একজন মানুষ হিসেবে আমি বিব্রত। লিঙ্গ বিবেচনায় তারা পুরুষ, একজন পুরুষ হিসেবে আমি লজ্জিত।
ঘটনাটি ঘটেছে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বড়খাল এর পাশে নূর ইসলাম মিয়ার বাড়িতে। দেলোয়ার ছাড়াও এই ঘটনায় জড়িত বাদল, কালাম, সুমন ও রহিম। এদের মধ্যে পুলিশ প্রধান আসামি বাদলসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। বাকিদের ধরতে পুলিশের পাঁচটি টিম মাঠে নেমেছে।
মানুষ নামের কলঙ্ক ওই পাঁচজন শুধু গৃহবধূকে বিবস্ত্র করেই ক্ষান্ত হয়নি, গত ৩২ দিন ধরে ওই পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, বেগমগঞ্জ কি বাংলাদেশের বাইরে? সেখানে কি দেলোয়ার বাহিনীর ক্ষমতা পুলিশ বাহিনীর চেয়ে বেশি? নইলে ৩২ দিন ধরে এই দেলোয়ার বাহিনী কীভাবে একটি পরিবারকে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারল? বেগমগঞ্জে কি কোনো মানুষ থাকে না? কেউ কেন গত ৩২ দিন প্রতিবাদ করল না, কেন চুপ করে থাকল? পুলিশ এবং এই চুপ হয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য লজ্জা, লজ্জা এবং লজ্জা; ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা।
ভিডিওটি নিশ্চয়ই ওই মানুষদেরই কেউ না কেউ ফেসবুকে দিয়েছে। ৩২ দিন যেহেতু তারা রাজত্ব করছে, তাই ভেবেছিল তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ভিডিও ভাইরাল হওয়াতেই ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, গণমাধ্যমে। তারপরই কেবল টনক নড়ে। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাদের বোকা বানিয়ে ফেলেছিল। একবার ভাবুন, তারা যদি ভিডিওটি ফাঁস না করত তাহলে ৩২ দিন কেন, ৩২ মাসেও গণ্ডার প্রশাসন টের পেত না।
ফেসবুকে দেখলাম অনেকেই দেলোয়ার গংয়ের বিচার চাইছে। আমি বুঝতে পারছি না, আমি কী চাইব। কীসের বিচার, কার বিচার, সাক্ষী কই, প্রমাণ কই, আলামত কই? ৩২ দিন আগের আলামত তো আর নেই। বিচারের নামে এখন প্রহসন চলবে। মামলা আদালত পর্যন্ত গেলে সেখানে দেলোয়ারদের আইনজীবী খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নির্যাতিতার বিবস্ত্র শরীরে বর্ণনা, হাজারটা ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্ন করবে। ভরা কোর্টে বারবার লাঞ্ছিত হবে আমাদের এই বোনটি। হয়তো সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে দেলোয়াররা মুক্তি পেয়ে যাবে।
কিন্তু আমি মুক্তি পাব না, কিছুতেই মুক্তি পাব না। আমার মাথায় ভাঙারেকর্ডের মতো বাজতে থাকবে আমার সেই বোনটির আহাজারি। আমার মাথায় আরেকটি প্রশ্ন গেঁথে গেছে স্থায়ীভাবে। বছর দুয়েক আগে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হককে ক্রসফায়ারের নামে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার সময় একরামুল তার মেয়ের সাথে টেলিফোনে ছিলেন। নিজের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ায় একরামুল কাঁদছিলেন। বাবার কান্না শুনে মেয়ে প্রশ্ন করেছিল, আব্বু তুমি কান্না করতেছো যে? জবাব এসেছিল একটি গুলির শব্দ। সেই থেকে একরামুলের মেয়ের প্রশ্নটি আমার মাথায় গেঁথে আছে। দুই বছর পর আবার বেগমগঞ্জের সেই বোনটির আহাজারি আমার মাথায় চিরদিনের জন্য গেঁথে গেল, ‘আব্বা গো তোর আল্লাহর দোহাই ছাড়ি দে।’
টেকনাফের একরামুল হত্যার বিচার হয়নি। বেগমগঞ্জের এই বর্বরতার কি বিচার হবে?
পুনশ্চ : যারা ভিডিওটি দেখেননি। অনুরোধ করছি, প্লিজ আপনারা ভালো আছেন, ভালো থাকুন; ভিডিওটি দেখবেন না।
৪ অক্টোবর, ২০২০
এইচআর/এমকেএইচ