স্বাস্থ্যখাতের ‘চিকিৎসা’র এখনই সময়
‘বিতর্কের মুখে বিদায় স্বাস্থ্যের ডিজি’—প্রায় সকল পত্রিকার ২২ জুলাইয়ের শিরোনাম ছিল এমন। এর আগে করোনাকালে অনিয়মের দায়ে স্বাস্থ্য সচিব এবং অতিরিক্ত সচিবকেও সরে যেতে হয়েছে। এটা জাতির জন্য বিশেষ করে এই সময়ের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দুর্বলতা, চেইন অব কমান্ডের সংকট এবং চরম সমন্বহীনতা লক্ষ্য করা গেছে। প্রথম থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গণমাধ্যম এবং দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে আসছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরকে মনে হয়েছে, বাস্তবতা থেকে তারা বহু দূরে। করোনার বিরুদ্ধে প্রধান সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসকদের সহযোগিতার পরিবর্তে তাদের বিরুদ্ধে অযাচিত ব্যবস্থা নেয়াই যেন ছিল অধিদফতরের প্রধান কাজ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক যেখানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা বাদ দিয়ে নিজেরাই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন, নিতে লাগলেন প্রতিনিয়ত ভুল সিদ্ধান্ত, ভুল পদক্ষেপ। আবদ্ধ হলেন অমানবিক জীবননাশের দুর্নীতির বেড়াজালে। গণমাধ্যম এবং জনসম্পৃক্ততার কোনো মূল্যই দেয়নি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, কেবল একটি দায়সারা বুলেটিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। তাদের বেশিরভাগ কাজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই করতে হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতর একটি সরকারি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান, যাদের দায়িত্ব সরকার ও জাতিকে সব স্বাস্থ্য বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেয়া, ব্যবস্থা নেয়া এবং প্রয়োজনে অন্য সংস্থার সাহায্য নেয়া। কিন্তু এর তেমন কিছুই দেশবাসী লক্ষ্য করেনি বরং প্রতিনিয়ত দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতার চিত্রই উঠে এসেছে।
কী লক্ষ্য ছিলো—১) যত সম্ভব পরীক্ষা বাড়ানো; ২) জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতন করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উৎসাহিত করা; ৩) সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করা; ৪) সরকারকে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপের পরামর্শ দেয়া এবং ৫) পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে জীবিকার পদক্ষেপের পরিকল্পনা দেয়া।
২৫ জুলাই বাংলাদেশ করোনা সংক্রমণের ১৪০তম দিন অতিবাহিত করেছে। এর মধ্যে সংক্রমণের সংখ্যা দুই লাখ ২১ হাজার ১৭৮, মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ৮৭৪ জনের। আর করোনা পরীক্ষা করার সংখ্যা মাত্র ১১ লাখ এক হাজার ৪৮০টি। প্রতিটি জীবন আমাদের কাছে মূল্যবান, প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক।
এতো অব্যবস্থাপনার মধ্যেও বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। আমরা তো আশা করতেই পারি, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশও ভারতের কেরালার মতো বিশ্বে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারতো। থাকতে পারতো ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ আর শ্রীলংকার সারিতে, হয়তো রক্ষা করতে পারতাম অসংখ্য মূল্যবান জীবন। চারটি ‘টি’ অনুসরণ করেই সফলতা পেয়েছে চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ অসংখ্য দেশ। Test, Treatment, Tracking and Tracing—যা ছিল তাদের সফলতার চাবিকাঠি। আর আমরা এর ধারে-কাছেই থাকতে পারলাম না। অথচ সরকার উজাড় করে বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। হতে পারতো বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের অন্যতম অনুকরণীয় দেশ।
বিপরীতে দেখতে হলো, ‘করোনা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যর্থতার পাশাপাশি কেনাকাটায় নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে ডিজি সমালোচিত হচ্ছিলেন। এসব নিয়ে তীব্র বিতর্ক ও বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পদত্যাগ করলেন তিনি।’
গোটা বিশ্বে করোনার সংক্রমণ বেড়েই চলেছে, বেড়ে চলেছে মৃত্যুর মিছিল। অনেক দেশে নতুন করে সংক্রমণ ঘটছে। ভয়ংকর এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছে আমাদের প্রিয় পৃথিবী। বিশ্ব-অর্থনীতি, সভ্যতা, জীবন-যাপন, সবই হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশে আম্ফানের পরে দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পূর্বাভাস। এ সমস্ত লড়াইয়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে সঠিক পথে সততার সাথে মোকাবিলা করতে হবে। তাই সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে সঠিক ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পত্রিকার সংবাদে দেখা গেছে, ‘সরকারের হাইকমান্ড মনে করে, করোনা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।’
করোনা পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে যে বিষয়গুলো পীড়া দিয়েছে—১) করোনা পরীক্ষা নিয়ে অধিদফতরের আগাগোড়া অনাগ্রহ; ২) প্রায় তিন মাস সময় পেয়েও কোনো ধরনের প্রস্তুতি বা কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে জনগণকে প্রস্তুতির মিথ্যা আশ্বাস দেয়া; ৩) সরকারকে সময়মতো সঠিক পরামর্শ না দেয়া; ৪) পর্যাপ্ত সংখ্যক আইসোলেশন ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের শয্যা নিশ্চিত করার ব্যর্থতা; ৫) নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে হয়রানি; ৫) কেনাকাটায় দুর্নীতি : মানহীন পিপিই- মাস্ক সরবরাহ করে চিকিৎসক- স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া; ৬) রিজেন্ট-জেকেজির সাথে চুক্তি করে মিথ্যা রিপোর্ট দেয়ার সুযোগ করে দেয়া; ৭) করোনা পরিস্থিতির সঠিক চিত্র আড়াল করার প্রচেষ্টা ইত্যাদি।
বিগত ১২ বছরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এক প্রশংসনীয় স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, গোটা দেশে রয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক চমৎকার নেটওয়ার্ক। পুরোপুরি ব্যবহার করলে আজকে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ এমডিজিতে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছে, অর্জন করেছে স্বাস্থ্য খাতে দেশের জন্য সম্মান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন সফলতার স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা স্বীকার করেছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে গেছে। অথচ কিছু কিছু অযোগ্য-দুর্নীতিবাজ লোকের জন্য করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিপর্যয় নেমে এলো।
সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর গভীর আস্থা আছে দেশবাসীর। পদত্যাগ বা অপসারণই শেষ কথা নয়, যারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যে সিন্ডিকেট স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল অর্জন ধ্বংস করে চলেছে, তাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। যারা আড়ালে থেকে সাহেদ-সাবরিনাদের সৃষ্টি করেছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
অধিদফতরের চেয়ে মন্ত্রণালয়ের দায় কিন্তু কম নয়। মন্ত্রণালয় হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, অধিদফতরের ওপর সকল দায় চাপিয়ে তারা পার পেতে পারে না। দোষীদের নিরপেক্ষ কমিশনের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সকল নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নির্মোহভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। অনুপ্রবেশকারীরা যেন কৌশলে আর সুযোগ করে নিতে না পারে।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের উচ্চপদে আইনগতভাবে সরকারি দলের সমমনা কর্মকর্তাদের বসানো হয়, যাতে সরকারি দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন সহজ হয় (Spoil System)। সময় এসেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর, ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (NHS) আদলের ব্যবস্থাই উপযোগী হবে—এ নিয়ে পরে আলোচনার ইচ্ছা রইলো।
লেখক
সাবেক উপাচার্য,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
এইচএ/এমকেএইচ