ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নতুন সংকট
ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা কার্যক্রম দেখার ক্ষেত্রে সরকারের এত অনাগ্রহ কেন বুঝি না! সারাদেশের শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ডের বই পায় আর ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বোর্ডের বই কিনতে হয় কালো বাজার থেকে। সরকার তাদের জন্য বোর্ডের কিছু বই বিশেষ করে বাংলা এবং সমাজবিজ্ঞান পড়া বাধ্যতামূলক করেছে কিন্তু ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে তাদের বই পাওয়ার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।
ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীদের এই বই কালো বাজার থেকে কিনছে উচ্চমূল্যে। এটা দেখেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লোকেরা বইগুলো দিচ্ছে না। আবার আমরা অনেকে ভন্ডামি করে অভিযোগ করি যে, বিজাতীয় কালচারে মানুষ হচ্ছে ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা। সরকার যদি তাই মনে করে, সমাজপতিরা যদি তাই ভেবে থাকে, তাহলে তো বাংলাদেশে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়া উচিত। আর যদি চালু থাকে তাহলে এই শিক্ষার ওপর নজর দেয়া উচিত।
ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ছে আরেক বিপাকে। তারা দেশের ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহজে ভর্তি হতে পারে না। মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি তাদের জন্য জটিল করে রাখা হয়েছে। সহজে যে ছেলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যলয়ে ভর্তি হতে পারে, মেধার গুণে স্কলারশিপ পেতে পারে- একই ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলে টিকবে না। মেধা যাচাইয়ের নামে এই সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের তথাকথিত সিস্টেমকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। যে বিষয়ে একজন শিক্ষার্থী পড়তে আগ্রহী সে বিষয়ে তার পড়ার যোগ্যতা আছে কিনা তা দেখা হয় না। ফলে ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের যাদের বাবার অর্থ আছে তারা বিদেশে পড়তে যাচ্ছে, যাদের বাবার বিদেশে পাঠানোর টাকা নেই তারা দেশি কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ টাকায় পড়তে বাধ্য হচ্ছে।
ঢাকা-চট্টগ্রামের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো তাদের তথাকথিত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী তিন হাজার থেকে ৩০ হাজার পর্যন্ত মাসিক বেতন আদায় করছে শিক্ষার্থীদের থেকে। সেটা মনিটর করার কেউ নেই। ক্লাস ওয়ানে আসতে লাগে চার বছর। বছর বছর স্কুল ফি বৃদ্ধি। আগে প্রতি বছর নতুন ক্লাসে উঠলে নতুন করে ভর্তি ফি দিতে হতো। হাইকোর্ট সেটা বন্ধ করেছে আর স্কুল কর্তৃপক্ষ সেটাকে ১২ ভাগ করে মাসিক ফিতে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছি। যেই লাউ সেই কদু।
খুব লজ্জার বিষয় যে, এইসব স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের কাছে বই-খাতা বিক্রেতাদের থেকে কমিশন খায়, টেইলার্স থেকে কমিশন খায়, বাংলা ভাষা নিয়ে বইয়ের নামে কিছু আবর্জনা লেখকের বই পাঠ্যভুক্ত করার বিনিময় কমিশন খায়, স্টেশনারি বিক্রেতাদের থেকে কমিশন খায়, যত প্রকার অসৎ শিক্ষা বাণিজ্য আছে তারা সবই করে। তারা এসব করতে পারে কারণ শিক্ষার্থীকে তারা বাধ্য করে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে এসব সামগ্রী কেনাকাটা করতে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কোনো সুযোগ নেই। এত স্টেশনারি সামগ্রী বাচ্চারা কীভাবে ১২ মাসের ক্লাসের নামে ৬-৭ মাসে ব্যবহার করে, কোথায় যায় এসব সামগ্রী- সেটা একটি অনুসন্ধানের বিষয় বটে।
গত মধ্য মার্চ থেকে করোনার কারণে দেশের কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস হয়নি। কিছু স্কুল জগাখিচুরি টাইপ অনলাইন ক্লাস চালু করেছে সীমিত আকারে। করোনাতে দেশের প্রায় কিছু স্থবির হয়ে গেলেও, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হলেও, এদের শিক্ষা বাণিজ্য স্থবির হয়নি। সবাইকে গড়ে পাস দিয়ে জুলাই মাসে নতুন শিক্ষাবর্ষে অনলাইনের নামে সীমিত আকারে ক্লাস চালু করেছে এখন। কিন্তু আদায় করছে পূর্ণ মাসিক বেতন। স্কুলের ব্যয় কমে এলেও বেতন ছাড় দেয়াতে ওরা রাজি না। এমনকি স্কুলে না গেলেও স্কুলের ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস বিলও কেটে নিচ্ছে কোনো কোনো স্কুল।
করোনাভাইরাস পরবর্তী অর্থনৈতিক দুরবস্থায় নানা ঝামেলায় বিধ্বস্ত অভিভাবকরা যতদিন স্কুল না খুলবে ততদিন ছাত্রদের মাসিক টিউশন ফি ৫০ শতাংশ করার দাবি করে আসছেন। সেই দাবি নিয়ে রাজধানীর মাস্টারমাইন্ড স্কুলসহ কয়েকটি স্কুলের অভিভাবকরা গত প্রায় এক মাস ধরে রাজপথে মানববন্ধন করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব আছেন। কিন্তু তাদের দাবি না শুনছে স্কুল কর্তৃপক্ষ, না যাচ্ছে সরকারের কানে। শুধু তাই নয় নতুন শিক্ষাবর্ষের জুলাই মাস যারা টিউশন ফি দিতে পারছে না তাদের সন্তানকে অনলাইনে পড়তে দিচ্ছে না এসব স্কুল কর্তৃপক্ষ।। জুম ক্লাস রুমে বসার জন্য তারা নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড দিচ্ছে না।
কয়েকজনের সন্তান পড়ছে, কেউ পড়তে পারছে না, কোনো শিক্ষার্থী পড়ছে আর তার বন্ধুরা পড়া থেকে বঞ্চিত- এমন একটি অমানবিক ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগটা উঠেছে রাজধানীর সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে। স্কলাসটিকা বলছে তারা অভিভাবকের আর্থিক অবস্থা বেদে ৫০ শতাংশ বা কম বেশি ফি মওকুফ করছে তবে গড়ে করবে না। জুলাইতে বেতন দিতে হবে নইলে ক্লাস করতে পারবে না, এমন আইন বিগত বছরগুলোতে ছিল না। পাস করার পর শিক্ষার্থীরা সুবিধাজনক সময়ে টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারতো। অভিভাবকরা এখন খুব চিন্তিত যে, তাদের সন্তানদের শিক্ষা বঞ্চিত করার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা কোথায় নালিশ করবে! অনেক স্কুলমালিক আবার বিদেশে অবস্থান করছেন, তাদের সঙ্গে অভিভাবকদের যোগাযোগের সুযোগ নেই। আবার তারা যাদের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন সেসব ব্যক্তির টিউশন ফি কামানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা নেই।
বেশির ভাগ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল একক ব্যক্তির মালিকানা। মালিকের কথাই আইন। ম্যানেজিং বোর্ড বলে কিছু জিনিস হয়তো আছে কিন্তু তারা কখনো অভিভাবকদের কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেন না। অভিভাবরা চাইলেও তাদের দেখা পান না। সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব না দেখলে তবে কি অভিভাবকরা এখানেও কি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করবেন?
ইংলিশ মিডিয়াম এসব স্কুলের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ যে, যারা তাদের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করবে তাদের সন্তানদের তারা টিসি দেয়ার হুমকি দিয়ে রাখে। এক একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক যেন কথায়-আচরণকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান। আবার এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা প্রচুর আয় করলেও শিক্ষকদের বেতন দেন অত্যন্ত কম। ফলে শিক্ষকরা লিপ্ত হয় কোচিং বাণিজ্যে। ক্লাসে পড়ানোর পাশে তারা কোচিং নিয়ে বেশি আগ্রহী।
সরকারের শিক্ষানীতি ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে সেটা প্রকাশ্যে তারা বলছে না। কিন্তু কার্যকলাপে দেখাচ্ছে ইংরেজি যেন একটি বৈরি ভাষা এবং আমাদের এটা থেকে বিরত থাকা দরকার। প্রতি বছর ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বিদেশি বই আমদানির ওপর, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের ফি এবং সার্ভিসের ওপর ট্যাক্স বাড়ায় সরকার। এর আগে একবার ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের বেতন এবং সার্ভিস ফির ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছিল। সেটা রুখে দিতে হাইকোর্টে যেতে হয়েছে অভিভাবকদের।
এদেশের অনেকের বিশ্বাস যে যারা বিদেশি ক্যারিকুলামে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে- তাদের অভিভাবকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল।
যেমন করে সরকার একসময় ভেবেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ধনীর দুলাল, এই ধারণায় তাদের ওপরও ভ্যাট প্রয়োগ করা হয়েছিল। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা নিজেদের সব অর্থ- সময় বিসর্জন দিয়ে কীভাবে সন্তানের পেছনে নিজের জীবন উৎসর্গ করছে- তারা ছাড়া কেউ বোধহয় এ খবর রাখেন না! স্কুল, প্রাইভেট টিউটর, কোচিং- সবকিছুতে উচ্চহারে খরচ। দ্রব্যমূল্য, বাড়িভাড়ার পাগলা ঘোড়া ওদের জন্যও প্রযোজ্য।
আবার এই প্রশ্নও উঠছে নিজেদের সামর্থ্য না থাকলে ইংরেজি মাধ্যমের দিকে ঝুকছে কেন! তারা পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন তাদের জন্য বিকল্প কী রেখেছে সরকার? রাজধানী ঢাকায় হাতে গোনা কয়েকটি বাংলা মাধ্যমের স্কুল আছে- সেখানে সন্তানের জন্য একটি সিট পাওয়া রীতিমতো যুদ্ধ করা। ফলে নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতার কারণে নয় শুধু, একদিকে দেশীয় শিক্ষার মান দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া অন্যদিকে বেসরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হতে না পেরে ইংরেজি শিক্ষার দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ছে মানুষ। সন্তানকে ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ড শিক্ষা দেয়ার জন্য ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। অনেক মধ্যবিত্তের সন্তান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট না পেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে- এটাও সেই রকম ঘটনা।
সরকার ডিজটাল বাংলাদেশ গড়ার ওপর জোর দিলে ইংরেজি শিক্ষাকে অবহেলার সুযোগ নেই। অংক, বিজ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করা আজ দেশি-বিদেশি সব প্রেক্ষাপটে শুধু জরুরি নয়, আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ইংরেজি এখন আর ব্রিটিশ প্রভুদের ঔপনিবেশিক ভাষা নয়। এটা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত ও দামি কমিউনিকেশন মাধ্যম। মাতৃভাষা জানার পাশাপাশি এই ভাষা জানা যে কারো জন্য আশীর্বাদ। যে কারো জন্য এটি একটি বড় ব্যক্তিগত সম্পদ।
শিক্ষামন্ত্রী সম্প্রতি কোভিড পরিস্থিতিতে অনলাইনে শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মোটামুটি সবাই অনলাইনে ক্লাস শুরু করেছে। যতদিন পর্যন্ত অনলাইনে ক্লাস চালু থাকবে ততদিন পর্যন্ত অভিভাবকরা যে ৫০ শতাংশ ফি দেয়ার দাবি করছে- সে বিষয়ে সরকার যেন দুপক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে একটা সিদ্ধান্ত দেয়- এটা কামনা করছি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/পিআর