ফৌজদারি অপরাধ নিয়ে দোষারোপের রাজনীতি বন্ধ হোক
যেকোনো ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের পরই রাজনৈতিক বক্তৃতা বিবৃতির মধ্য দিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া উচিত। একটি ঘটনার নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করতে, প্রকৃত অপরাধীকে সনাক্ত করতে এবং তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে এই সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যতদিন আমরা এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারব ততদিন দেশে আইনের শাসন অধরাই থেকে যাবে।
আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্য করছি দেশে কোনো একটি ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই রাজনৈতিক পারস্পরিক দোষারোপ শুরু হয়ে যায়। আর এতে করে তদন্তকারিরা আর এগুতে পারে না। তারা রাজনীতির প্রভাবের বাইরে গিয়ে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করার সাহস হারিয়ে ফেলে। অতীতের এমন বহু নজির স্থাপন করেছেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। তাদের কথাবার্তার কারণে আসল অপরাধীরা থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সবচে বড় নজির ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে ঘিরে জজ মিয়া নাটক। যা শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যম আসল কাহিনী ফাঁস করে দেওয়ার পর পরিষ্কার হয়েছে।
বর্তমান সরকার যেহেতু জজ মিয়া নাটকের শিকার তাই তাদের এটা বোঝা উচিত, অপরাধমূলক কোনো কর্মকাণ্ডকে চিরতরে চাপা দিয়ে রাখা যায় না, সত্য কোনো না কোনোভাবে বের হয়ে আসবেই। আমরা লক্ষ্য করছি সম্প্রতি বিদেশি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপি জামাতকে দায়ী করে বারবার বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। বিএনপিও পাল্টা অভিযোগ তুলে বলছে, সরকার বিদেশিদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়ে এর দায়ভার চাপাচ্ছে বিএনপির ওপর।
বিএনপি জামাতের কেউ যদি আসলেই ওই ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত থাকে, তাহলে সেগুলো তদন্তকারি কর্মকর্তা বা পুলিশের মুখপাত্রকে দিয়েই বলানো যেতে পারে। যখনই কোনো রাজনীতিবিদ বা মন্ত্রী তার আওতার বাইরে গিয়ে রাজনৈতিক মন্তব্য করেন তখনই জনমনে সন্দেহ দেখা দেয় যে তারা সত্যি বলছেন না, তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এমন কথা বলছেন। যেমনটি ২১ আগস্টের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন সবাই বলছিলেন- আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে ওই হামলা হয়েছে। যার প্রভাব বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টেও পড়েছিল। ওই একটি ঘটনা দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও তদন্ত প্রক্রিয়া মোদ্দাকথা ফৌজদারি অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই আজও যখন বিদেশি হত্যাকারী সন্দেহে কয়েকজনকে আটক করা হয় তখন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, জজ মিয়া নাটক সাজানো হচ্ছে না তো?
আমরা যদি এর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেই, দেখতে পাই বিদেশি হত্যার শুরুতেই বিএনপিকে দায়ী করে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ আনা হয়েছে। এমনকি অক্টোবরের সাত তারিখ প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একটা খুব নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আমি জেনেছি যে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বিদেশি হত্যাকাণ্ডে বিএনপি-জামায়াত জড়িত’। তিনি আরো বলেছেন, ‘লন্ডন বিএনপির ভেতর থেকেই এ তথ্য এসেছে।’
এরপর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বিএনপিকে দায়ী করে বলেছেন, বিএনপির কোন নেতা ইতালির নাগরিক হত্যায় জড়িত তা অচিরেই তদন্তে বের হয়ে আসবে। ইতোমধ্যেই গোয়েন্দারা কিছু ক্লু খুঁজে পেয়েছে।
এ জাতীয় কথা আরো অনেক মন্ত্রীই বলেছেন। সর্বশেষ স্বরাস্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “ইতালির নাগরিক তাবেল্লা হত্যাকাণ্ডে শুধু বড় ভাই আসল নয়, তার পেছনে রাজনীতিবিদরাও রয়েছেন। তিনি বলেন, “সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতা (খুনের সঙ্গে) পাওয়া গেছে। তারা গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন। তথ্য-প্রমাণ, বিচার-বিশ্লেষণ করে দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।” দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দুই-একদিনের মধ্যেই বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে বলেও জানান মন্ত্রী। “গোয়েন্দারা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে। তা মিলিয়ে দেখার জন্য বিলম্ব হচ্ছে।”
পুলিশমন্ত্রী যখন এই কথা বলেন তখন তা গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করতে হয়। সরকারি দলের সবাই বিএনপির নাম বললেও পুলিশমন্ত্রী রাজনীতিক কারা, তা প্রকাশ করেননি। এক্ষেত্রে তিনি একটু সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রকৃত তথ্য দিয়ে থাকলেও সেটিরও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠার সুযোগ তার দল আগেই করে দিয়েছে। কারণ বিষয়টির মধ্যে রাজনীতি ঢুকানো হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো রাজনৈতিক নেতার সম্পৃক্ততা হয়তো অস্বাভাবিক না, হয়তো কোনো নেতার ইন্ধনেই এটি ঘটেছে। যদি তদন্তকারিদের বাইরে সরকারের আর কেউ এ নিয়ে কোনো কথা না বলতেন তাহলে হয়তো জনমনে সন্দেহ দেখা দিত না। জানি না আমাদের রাজনীতিবিদরা কবে থেকে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক ব্লেম গেম বন্ধ করবেন।
এইচআর/এমএস