পাবলিক ফিগার বিলাস যখন ফলোয়ারের নাভিশ্বাস

রাজীব কুমার দাশ
রাজীব কুমার দাশ রাজীব কুমার দাশ , পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ
প্রকাশিত: ০৪:১৮ পিএম, ২০ জুন ২০২০

আমার চাকরির প্রায় একযুগ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে। সে নিরিখে সরকারি-বেসরকারি, দরকারি-বেদরকারি, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সরল-গরল, পাবলিক ফিগার, ত্যাগী-ভোগীদের সাথে চলতে বলতে উঠতে বসতে হয়েছে। প্রথম সারির এক চলচ্চিত্র পরিচালক ভদ্রলোকের সাথে অনেকদিন পর কুশল বিনিময় হয়েছে। মানে অ্যানালগ সময়ে পরিচয়- ডিজিটালে সবিশেষ। অ্যানালগ ব্যক্তিটি এখন ডিজিটাল পাবলিক ফিগার! মানে জনগণের ব্যক্তিত্ব। লাখের ওপর ফলোয়ার, আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে বলেন। সেরেফ এটুকু পর্যন্ত! মাসখানেক পর পরিচালক ভদ্রলোক একটা স্ট্যাটাস দেন এভাবে- অসংখ্য লেখক-কবি যারা আমাকে ফলো করেন: তাদের বলছি- ‘‘আমি প্রায় সপ্তাহখানেক ‘প্রেমের ডুব সাঁতারু’ ছবির স্যুটিং নিয়ে থাইল্যান্ড থাকব, এ সময়ে আপনাদের কোনো পরামর্শ দিতে পারবনা।’’ পরিচালক সাহেবের স্ট্যাটাস দেখে চেক করে দেখি, আমি ভদ্রলোকের ফলোয়ার।

বেশ কিছুদিন পর জানতে পারি- এ ধরনের স্ট্যাটাস ফলোয়ার বাড়ানোর কৌশল! অর্থাৎ উনি লেখক-কবিদেরও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব! এ-সিনেমা মাস্টার ভদ্রলোকের কাফরুল থানা এলাকায় বাড়ি করার সময় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে মোটা অংকের চাঁদা না দিয়ে বাড়ি নির্মাণে সহায়তা করেছিলাম। সিনেমা মাস্টার অনুতাপ নিয়ে বলেন- ‘ভাই ডিজিটাল যুগে সবাই পাবলিক ফিগার হতে চান’। কেউ শরীর দেখিয়ে- কেউ বেসুরো গান শুনিয়ে- কেউ- ‘জোছনা রাতে উড়ে যায় একঝাঁক হাতি কবিতা শুনিয়ে’। আমার দোষটা কোথায়?

পাবলিক ফিগারের সংজ্ঞা প্রশ্নে আসি- ‘পাবলিক ফিগার হলো যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তাঁরা আদর্শবান রাজনীতিবিদ, গুণীশিল্পী, ব্যবসায়ী, কবি-সাহিত্যিক, লেখক-গুণীজন। যাঁদের জ্ঞানের সৌকর্য-প্রজ্ঞা-মেধা-মনন-নন্দনের বারতায় ফলোয়ার নিজে শিখবে, অন্যদের শেখাবে। যাদের কোনো ভালো বিশেষণ নেই, ব্যক্তিত্ব নেই, যারা অসৎ, ভণ্ড তাদে ফলোয়ার কেন ফলো করবে?’

এখন অমোঘ নির্মম সত্য যে, গুণী ফলোয়ারের তালিকা নাতিদীর্ঘ! চরম ভণ্ড-মিথ্যুক-চরম ঘুষখোর-মাদকের অর্থলগ্নিকারী ডিলার-ধান্ধাবাজ-ছদ্মবেশী সমাজকর্মী-সম্ভ্রান্ত পতিতাদের লক্ষের ওপর ফলোয়ার! সহজ-সরল ফলোয়ার আস্তে আস্তে মনের অজান্তে হয়ে যাচ্ছে অবিমৃষ্য। সহজ-সরল ‘অনুসরণকারী’ ভণ্ড ধান্ধাবাজের চোরাবালির পাতানো ডিজিটাল ফাঁদে পা দিয়ে বিনাশ্রমে বড়লোক হবার স্বপ্নে বিভোর। ছাত্র-অছাত্র, যুবক-যুবতী কেউই পিছিয়ে নেই। ছাত্ররা পড়াশোনা বাদ দিয়ে দামি ব্র্যান্ড গাড়ি, টাকা, বয়-গার্লফ্রেন্ড, অর্থবিত্তের দিকে ঝুঁকে চলেছে। তাদের চোখের সামনেই পড়াশোনা না করে চোর-ছিনতাইকারী ভবঘুরে মাস্তানি করে পাড়ার বড় ভাইদের পেছনে থেকে হয়ে গেছে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক।

তারা দেখছে- মেধাবী ছাত্রটি টিউশনি গার্মেন্টস হেলপার হয়ে কাকডাকা ভোর হতে রাত পর্যন্ত কষ্ট করতে! ফলোয়ারদের আলোচনায় উঠে আসে- অমুক তমুক ভাই, অমুক তমুক বোন পড়াশোনা না করেই ব্র্যান্ড গাড়ি-হেলিকপ্টার হাঁকায়! থাইল্যান্ড, দুবাই বেড়াতে যায়! এ ভাবনা এখন সিংহভাগ ফলোয়ারের।

আমার দেখামতে সৎ নির্লোভ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পাবলিক ফিগার এবং অসৎ ধুরন্ধর বর্ণচোরাদের পেজ পার্থক্য দিনেরাতে তফাত! এসব লোভ-লালসা নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম ফলোয়ারদের চিন্তাগুলো বিকৃত-কুৎসিত রুচিতে রূপ নেয়। আস্তে-আস্তে মননসমৃদ্ধ রুচিতে অনীহা আসে! ঘুমের ঘোরো চেপে ধরা বোবার মতো ঘোরে নিজের বিবেকের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মনের অজান্তে মাদক ব্যবসায়ী, ভণ্ড, কথিত বড় ভাই, সম্ভ্রান্ত পতিতাদের উদ্বাহু হাসি, নেট পিনপিনে ব্লাউজের ভেতরে লাল মকমলে পীনোন্নত বুকের কথিত মডেলের স্বালোক শেয়ারে পেজের ফলোয়ার হয়ে একলাফে নেট পর্যন্ত জ্যাম করে রাখে! সবাই লিখে চলেন- আপু আপনার আমি অন্ধ ভক্ত। আপনার এটা-ওটা দেখতে ভালো লাগে, রাতে ঘুম আসে না, বিছানা নষ্ট করে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছি। সবাই ফলোয়ার হয়ে জেঁকে বসে ধান্ধাবাজের পেজে !আশা বড়লোক! গাড়ি-বাড়ি।

অপরদিকে সৎ রাজনীতিবিদ, কবি-সাহিত্যিক-লেখক-গুণীজন, চাকরিজীবী, জাতীয় কল্যাণে চাকচিক্যময় পাঞ্জাবি, ব্র্যান্ড গাড়ি, বাড়ি, বাহারি ব্র্যান্ড ফোনের সমাহার, ব্যতিরেকে সাদাসিধে উপমা ছাড়াই সৎ জীবন-যাপন করেই জাতীয় কল্যাণে কাজ করে চলেছেন; তাদের নেই লোভ-ধান্ধা। তাঁরা বিবেকের কাছে স্বচ্ছ। তাঁদের পরামর্শ-প্রজন্মান্তর পড়াশোনা ও সৎ জীবন-যাপন। জাতীয় সমৃদ্ধি চিন্তাতে যা কিছু সৎ পরামর্শ পেজে শেয়ার করেন, তা তেমন একটা কেউ পড়েন না- যারা অনুসরণ করেন, তারা হাতেগোনা।

এটাই নির্মম বাস্তবতা! এ ভয়ানক সংস্কৃতি হতে আমাদের বের হতে হবে। ফলোয়ারের জানতে হবে, বুঝতে হবে, ভাবতে হবে, শিখতে হবে- সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তাঁরা এসপি শামসুন্নাহার, পিপিএম, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, নির্মলেন্দু গুণ, আখতারুজ্জামান আজাদকে ফলো করে কিছু শিখবে? না রঙ্গে ভরা বঙ্গের তেলবাজ হতে শিখবে?

আজ ঘরে ঘরে যে প্রজন্ম রাতারাতি পড়াশোনা, কাজ ছাড়া বাড়ি-গাড়ির আশায় অসৎপথে সমৃদ্ধ হবার যে ভয়ানক বাসনা নিয়ে পেছনে না তাকিয়ে ফলোয়ার হয়ে এগিয়ে চলেছে! সে মিথ্যা স্বপ্নের চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে আমাদের আগামীর স্বপ্নবাজ প্রজন্ম। সবার নিজ নিজ অবস্থান হতে জাতীয় স্বার্থে আগামীর উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে প্রবেশের প্রাক্কালে মিথ্যা স্বপ্নের চোরাবালিতে হারিয়ে যাবার আগেই ধান্ধাবাজ পাবলিক ফিগার ফলোয়ার বিলাসের ভয়াবহ থাবা হতে প্রজন্মান্তর রক্ষার জন্য সচেতনতায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কবি; পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।

এইচআর/বিএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।