পশ্চিমাদের লাল সতর্কতা : ভয়ে নাকি ষড়যন্ত্রে?
বাঙালির কথা বলার অভ্যাসটা অনেক পুরোনো। কথা বলতে পারাটাই যেন কারো কারো জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। তা হোক সে যে কোনো বিষয়েই। জ্ঞান আছে কি নেই, কথা বলার এখতিয়ার থাকুক আর নাই থাকুক- বাঙালিকে কথা বলতেই হবে। এই যেমন খুন হয়েছেন দুই বিদেশি। কথা বলবেন স্বরাষ্ট্র আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। যারা তদন্তের সঙ্গে জড়িত- তারাও। কিন্তু ব্যাপারটা দেখুন। কথা কে বলছে না? এই বিষয়ে সব মন্ত্রীকে, সব নেতাকেই কথা বলতে হবে। কেন বলতে হবে? নিজের মন্ত্রণালয় কিংবা দপ্তর নিয়েই ব্যস্ত থাকুন না। হত্যাকাণ্ড দুইটির তদন্ত অগ্রগতি কি আপনাকে নিয়মিত জানানো হচ্ছে? বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের দায়ভার কি আপনার? তাহলে এই বিষয় দুইটি নিয়ে আপনি কিংবা আপনারা দয়া করে একটু চুপ থাকুন।
অতিসন্ন্যাসীতে নাকি গাজন নষ্ট হয়। দয়া করে গাজন নষ্ট করবেন না। আপনাদের সবার এত এত কথা তদন্তে যে প্রভাব ফেলতে পারে! সেই খেয়াল কি আছে? এত মহোদয়ের এত এত কথার ভীড়ে কোনটা সঠিক আর কোনটা বাখোয়াজ- তাইতো ধরতে পারছে না আম জনতা। মাথার চারপাশে এত কিচিরমিচির শুনে পাবলিকতো ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছে। দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুমিতভাবেই রাজনীতিতে চলছে পুরোনো সেই কাদা ছোঁড়াছুড়ি। কার গায়ে কে কতটা কাদা লাগাতে পারে- এ যেন তারই রেস চলছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু ক্ষমতাসীন জোটের পাতি নেতারাও চোখ বন্ধ করেই বলে দিচ্ছেন এর পেছনে ইন্ধন বিদেশে পালিয়ে থাকা ওই ছোকরার। এইসব পরিকল্পনা করতেই ছোকরার মাও চলে গেছেন সেখানে।
বিরোধী জোটের নেতারাই বা বাদ যাবেন কেন? তারাই বা ঢালাওভাবে সরকারের ব্যর্থতা দেখিয়ে দিতে বিরত থাকবেন কোন যুক্তিতে? তাহলে যে রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজির খেলায় হেরে যেতে হয়! কেউতো বলছে না, তদন্ত চলছে। তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ হোক- তারপরই বোঝা যাবে কে খুনি, কে ইন্ধনদাতা।
একটা কিছু যে হচ্ছে তাতে সন্দেহ একচুল। এমন দুই বিদেশিকে হত্যা করা হলো যাদের সঙ্গে রাজনীতির দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। এমন দুই দেশের নাগরিক তারা- যে দেশ দুইটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বের, আস্থার, সহযোগিতার। তাহলে কেন এই হত্যাকাণ্ড? সঠিক প্রক্রিয়ায় প্রভাবমুক্ত তদন্ত হলেই তা জানা যাবে। বেরিয়ে আসবে কুশীলবদের নাম। তবে একটা বিষয় সম্ভবত বলাই যায়। এই হত্যাকাণ্ড দুইটি দস্যুতা কিংবা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে হয়নি। সেরকম আলামত অন্তত নেই। তাহলে কি ব্যক্তিগত বিরোধ? ব্যক্তিগতভাবে সেই সম্ভাবনাও আমি খুব একটা দেখি না। বিদেশ-বিভূঁইয়ে যে কাজ নিয়ে তারা পড়ে ছিলেন- তাতে এখানে কারো সঙ্গে খুন হয়ে যাওয়ার মতো বিরোধ না হওয়াটাই বরং স্বাভাবিক। তাহলে সত্যিই কি তারা বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার? যে খেলার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ না হয়েও কেবলমাত্র বলির পাঁঠা তারা? মতাদর্শের জায়গা থেকে অভিযোগের তীর ভিন্ন জনের দিক থেকে ভিন্ন ভিন্ন দিকে হতেই পারে। কিন্তু এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না কোনোভাবেই। বরং সম্ভাব্য সব কারণের মধ্যে এটিকে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে বিশেষভাবে।
বাংলা ভাষা, বাঙালি আর বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের ইতিহাস সুদীর্ঘ। পলাশী থেকে ধানমন্ডি- তারই সাক্ষ্য দেয়। প্রাচীন সাম্রাজ্যবাদ থেকে শুরু করে উত্তরাধুনিক যুগের বাজার অর্থনীতিনির্ভর নব্য ঔপনিবেশিক মানসিকতা- বাংলাদেশকে স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি কখনোই। আর এই অভ্যন্তরীণ কিংবা ভূ-রাজনীতির খেলায় চরিত্রগুলো কিন্তু পুরোনো আর একই। খেলার পদ্ধতি পাল্টেছে, নাটকীয়তা এসেছে। কিন্তু খেলোয়াড় বদলায়নি কখনোই।
বাংলাদেশ ভ্রমণে হঠাৎ করেই পশ্চিমা দেশগুলোর লাল সতর্কতা। তারপরই সপ্তাহেরও ব্যবধান হতে পারেনি। খুনের শিকার দুই বিদেশি। কিন্তু সতর্কতা যারা দিলো তারাতো বাংলাদেশ সরকারকে কোনো তথ্য সরবরাহ করছে না। রোববার (১৮ অক্টোবর, ২০১৫) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কিন্তু সাংবাদিকদের স্পষ্টই বিষয়টি জানিয়েছেন। অভিযোগ করে তিনি বরং বলেছেন, এই সতর্কতার পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। থাকতেই পারে। কারণ একাত্তর আর পঁচাত্তর সে রকমই ষড়যন্ত্রের ফল। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীরা এই দেশকে আগেও অস্থিতিশীল করেছে। এখন জীবন বাঁচাতে তারা আরো ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠতেই পারে। সেই খেলায় তাদের দোসরের অভাব ছিলো না কখনোই। এখনো যে নাই- তাতো বোঝাই যায়।
ভূ-রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে সবচেয়ে ক্ষমতাধর না হলেও সব সময়ই সবচেয়ে বেশি সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্র। তাই যেকোনো ঘটনায় দেশটির ভূমিকা, অবস্থান, প্রতিক্রিয়া নিয়ে আগ্রহী থাকে সবাই। জিএসপি সুবিধা, ড. ইউনূস বিতর্ক, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোড়লগিরি- সবমিলিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর ধরেই ঢাকার সম্পর্কটা যে শীতল- তা বোঝাই যায়। এর জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের দরকার পড়ে না।
বিষয়টিতো একেবারেই খোলামেলা বলে ফেললেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনিও রোববার সচিবালয়ে কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনাই করেছেন তিনি। রাখঢাক না করেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পুরোটা সময় যুক্তরাষ্ট্র একই আচরণ করে আসছে। সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে মার্কিন দূতাবাস নিজেদের নাগরিকদের জন্য নতুন করে সতর্কতা জারি করার পর রীতিমতো ক্ষোভ ঝারলেন মুহিত। তাঁর ভাষায়, "এটা তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) পলিসি, আপনারা যতই চেষ্টা করেন না কেন, এটা খুব বেশি পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না।"
অর্থমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ এবং রাশিয়া সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নাকি সব সময় একই। রাশিয়ার প্রসঙ্গ আসাতে পুতিনের প্রসঙ্গ টানছি। সিরিয়ায় আইএসবিরোধী রুশ অভিযান পাল্টে দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতির অনেক হিসেব নিকেশ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর দ্বিমুখী রূপ আরেকবার সবার সামনে উন্মোচন করে দিয়ে অনেকটা হিরো হয়ে গেছেন পুতিন। এই যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া- দুই দেশই কিন্তু পরাশক্তি। দুই দেশের ইতিহাসেই রয়েছে কালো অধ্যায়। তবে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে মৌলিক কিছু বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্র আগাগোড়াই অভিবাসীদের একটি নিবাস। যার বয়স মাত্র ২০০ বছর। অন্যদিকে রাশিয়ার রয়েছে হাজার বছরের নিজস্ব সংস্কৃতি। দুই পরাশক্তির বিচার-বিবেচনা আর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় তাই পার্থক্য দেখা গেছে সব সময়ই। দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বটাও তাই কেবল প্রভাব প্রতিপত্তির নয়, সাংস্কৃতিক এবং চরিত্রগতও।
বাংলাদেশও কিন্তু একটা যুদ্ধের ভেতরেই আছে। জঙ্গি থাকা না থাকা, আইএস থাকা না থাকা নিয়ে সরকারের অবস্থান আর বক্তব্য পাল্টাতেই পারে। সেটা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই ধরে নিচ্ছি। কিন্তু ধর্মকে ঘিরে এক ধরনের যুদ্ধ কিন্তু আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি। সেই যুদ্ধটা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির সাথে ২০০ বছর আগের ওয়াহাবি বেদুইন মতের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কিন্তু মার্কিনীরা সবসময়ই বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা বাঙালির বিরুদ্ধে ছিল এবং এখনও। অর্থমন্ত্রী কিন্তু স্পষ্টই বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পুরোটা সময় যুক্তরাষ্ট্র একই আচরণ করে আসছে। বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির বাহক যে রাজনৈতিক শক্তি, আসাদের মতো তাকেও ফেলে দেয়ার চেষ্টা নিয়তই করছে ২০০ বছরের পুরোনো সেই স্থানীয় সংস্কৃতিবিরোধী শক্তিগুলো। এক হয়ে, জোট বেঁধে।
ওয়াশিংটন অবশ্য দাবি করতেই পারে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহযোগিতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি সেই সাক্ষ্যই দেয়। বাংলাদেশেরও পররাষ্ট্র নীতি, `কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়; সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।` বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান স্পষ্টই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিলো। জীবন মানেই পরিবর্তন। পরিবর্তন ভেতরে-বাইরে যেমন। একইভাবে তা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে জগতজুড়ে। সেই নীতিতেই নানা সময়ে নানা স্বার্থে বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আর নীতির পরিবর্তন কি সত্যিই করেছে দেশটি? সেটা প্রমাণের দায় কিন্তু ওয়াশিংটনেরই। কারণ হাজার বছরের সংস্কৃতিই বাঙালিকে দিয়েছে তার স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য। এ কারণেই অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলক দুর্বল হলেও চোখ রাঙানিতে বাঙালিকে কাবু করা যায় না।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]
এইচআর/পিআর