বন্যেরা বনে সুন্দর
কথায় আছে `বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।‘ কখনো কখনো এর ব্যত্যয় ঘটে। যেমন বন্য হাতির বনেই থাকার কথা। কিন্তু তারা লোকালয়েও চলে আসছে। শুধু আসছেই না, কোনো কোনো এলাকায় এদের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হচ্ছে লোকজন। ক্ষতি হচ্ছে জান-মালের। এ অবস্থায় বন্য হাতির প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ জন্ম নিচ্ছে। তবে এই বিদ্বেষ যদি হাতির প্রাণহানির কারণ হয় সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার সীমান্তে মাখনের চর গ্রামবাসী হাতির পাল ঠেকাতে বৈদ্যুতিক তার জড়ানো ফাঁদ পাতে। গত শনিবার রাতে এতে আটকা পড়ার পর গ্রামবাসীর হামলায় মারা যায় ভারত থেকে আসা দুটি বন্য হাতি। মৃত হাতির দাঁত, শুঁড় ও কান কেটে নেয় স্থানীয়রা। এটা পশুর প্রতি শুধু চরম নিষ্ঠুরতায়ই নয় আইন-কানুনেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। হাতির উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানা রকম পদ্ধতি আছে। সেটাতে হাতিরও ক্ষতি হবে না- আবার সবকিছু রক্ষাও পাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা অত্যন্ত অমানবিক। এটার ভিন্ন উদ্দেশ্যও হয়তো আছে। শুধু হাতির উপদ্রব বন্ধের জন্যেই যদি ফাঁদ পাতা হবে তাহলে মৃত হাতির দাঁত, শুঁড় ও কান কেটে নেয়া হল কেন? এছাড়া কোন পরিস্থিতি হাতি বন ছেড়ে লোকালয়ে আসে সেই বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। মানুষ বন ধ্বংস করবে আর হাতিরা খাবার, আশ্রয় না পেয়ে লোকালয়ে আসলেই দোষ? বনের প্রাণীদের বনে থাকতে দিলেই তো কোনো সমস্যা হয় না।
দেশের অমূল্য বন্যসম্পদ হাতির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। গত কয়েক বছরে সারাদেশে মারা গেছে অর্ধশতেরও বেশি হাতি। আবাসস্থল হ্রাস, উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে, খাদ্য উপযোগী উদ্ভিদের অভাব, চলাচলের পথে বাধা, কৃষিকাজ, একক প্রজাতির উদ্ভিদ হ্রাস, জুম চাষ, চলাচলের পথে বসতি স্থাপন, সীমান্ত এলাকায় স্থাপিত ভূমি আইন এবং মানুষের পাল্টা আক্রমণে কিংবা অসুস্থ হয়ে মারা পড়ছে হাতি। ফলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে হাতির সংখ্যা। এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, দেশের ১১টি বনবিভাগে ১৯৫ থেকে ২২৭টি হাতির বিচরণ রয়েছে। এ অবস্থায় হাতি সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
হাতির বসবাসউপযোগী আবাসস্থল কমে যাচ্ছে। পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে হাতির জায়গা দখল করছে মানুষ। জুমচাষের কারণে খাদ্য সংকটও দেখা দিয়েছে হাতির। পাহাড় ধ্বংস করায় খাড়া পথে হাঁটতে গিয়েও অনেক হাতি খাদে পড়ে মারা যাচ্ছে। হাতির খাদ্য উপযোগী উদ্ভিদের সংখ্যাও কমছে। সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়ার কারণেও হাতির অবাধ বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে সচরাচর হাতির চলাচল ও বসবাসযোগ্য জায়গা এখন মাত্র ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তার ওপর নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে বনাঞ্চল। পাহাড়ে দুর্লভ হয়ে গেছে হাতির প্রধান খাদ্য কলাগাছ। ফলে খাদ্যের সন্ধানে হাতিগুলো ফসলের মাঠ ও লোকালয়ে হানা দেয়। এতে ফসলের পাশাপাশি ক্ষতি হয় জানমালেরও। প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটলেও এ পর্যন্ত হাতি ও মানুষের জানমাল রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। ফলে হাতি ও মানুষের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের বিস্তার দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর সমানভাবেই মারা পড়ছে হাতি ও মানুষ। এছাড়াও হাতির দাঁত অত্যন্ত মূল্যবান বলে মানুষ কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁদে ফেলে, বিষ প্রয়োগে কিংবা গুলি করে হত্যা করছে হাতি। অভিযোগ রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে হাতি সংরক্ষণের সুস্পষ্ট কোনো উদ্যোগ নেই।
বাংলাদেশ হাতিসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর জন্য অনুকূল বিচরণ এলাকা হলেও বর্তমানে প্রাকৃতিক বনের এ প্রাণীগুলোর সবই দেশ থেকে নিদারুণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে শুরু করেছে। জীববৈচিত্র্যের এ সর্বনাশা বিলুপ্তি আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ ব্যবস্থায় সৃষ্টি হতে চলেছে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির। যে হারে হাতি মারা পড়ছে, সে হারে অচিরেই দেশের হাতিসহ বন্যপ্রাণী বিপুপ্ত হয়ে যাবে। তাই হাতিসহ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন দ্রুত অভয়ারণ্য প্রকল্প বাস্তবায়নসহ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
এইচআর/পিআর