এমন মৃত্যু চাই না, এমন জীবনও না

মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম
মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম মো. সাইফুল ইসলাম মাসুম , ব্যাংকার
প্রকাশিত: ০১:৩০ পিএম, ১৬ মে ২০২০

পৃথিবীর শত শত বছরের পুরোনো ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় প্রতি শতাব্দীতেই এ রকম কোনো না কোনো মহামারিতে অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এভাবেই শতবর্ষ পরপর পৃথিবীতে মহামারির আঘাত হানা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক নিয়ম করে করে প্রকৃতি হানা দিয়েছে পৃথিবীর বুকে প্রতি একশ বছর পরপর এবং কখনও কখনও একশ বছরের ভেতরও কয়েকবার। কিন্তু এইবার এই করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে প্রকৃতি পৃথিবীকে দেখিয়েছে তার নতুন খেলা। মানুষের অমানবিকতার চরম বিস্ফোরণ দেখেছি পৃথিবী। কত অজানারে জানাইলো করোনা, কত অদেখারে দেখাইলো করোনা। করোনার কারণে জানতে পারলাম মানুষ কতটা নির্মম হতে পারে, কতটা স্বার্থপর হতে পারে।

গত ৮ মার্চের পর থেকে টেলিভিশন দেখলে আর মানুষের এই নির্মমতার ঘটনাগুলো দেখতে দেখতে কেমন যেন হয়ে গেছি আমরা। একটু পেছনে ফিরে যাওয়া যাক। একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যুগে যুগে মানবকল্যাণে নিরলস পরিশ্রম করেছেন পৃথিবীর হাজার হাজার বিজ্ঞানী। তেমনি একজন অ্যান্থনি ভন লিউয়েনহুক একজন ওলন্দাজ বিজ্ঞানী। তিনি প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র তৈরি করেন এবং ব্যাকটেরিয়া, স্নায়ুকোষ, হাইড্রা, ভলভক্স ইত্যাদির অত্যন্ত সঠিক বর্ণনা দেন। লিউয়েনহুকের উল্লেখযোগ্য কিছু অবদান- তিনি ১৬৮০ সালে অণুজীবের অবাতবৃদ্ধি আবিষ্কার করেন (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া)।

জগৎবিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যান্থনি ফন লিউয়েনহুক যখন আজ থেকে সাড়ে তিনশ বছর আগে আতশী কাঁচের নিচে কিলবিল করা প্রাণগুলোকে দেখতে পেলেন, দীর্ঘ সাধনায় লিওয়েনহুক খুঁজে পেলেন অদেখা প্রাণের অস্তিত্ব, তখনও তিনি জানেন না যে তিনি এক নতুন দুনিয়ার সন্ধান পেয়ে গেছেন এই আবিস্কারের মধ্য দিয়ে। এই অণুজীববিজ্ঞানীই প্রথম মাইক্রোস্কোপিক সোল বা আণুবীক্ষণিক প্রাণের দুনিয়াকে মানুষের সামনে অত্যন্ত সফলতার সাথে উন্মোচিত করেন। তিনি এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণগুলোর নাম দেন ‘এনিম্যালকুলস’। এভাবেই ভাইরাসের আবিস্কার।

জগতের ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ ক্রমান্বয়ে এইসব ভয়ংকর অদেখা অণুজীবদের আক্রমণের শিকার হয়েছে কালে কালে, কখনও অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবেও। প্রাণ গেছে কোটিতে কোটিতে, অথচ এই প্রাণহানির নেপথ্যের কারণ জানতে মানুষের সময় লেগেছে শত শত বছর। অদেখা ও অতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারেরও যথেষ্ট সময় পর, মরণঘাতী রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস সম্পর্কে মাত্র মানুষ ওয়াকিবহাল হতে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে।

ঠিক গত বছরের শেষভাগে চীনের উহান প্রদেশে আঘাত হানা করোনাভাইরাস মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষকে আক্রান্ত করেছে, প্রাণ নিয়েছে প্রায় তিন লাখ ১০ হাজার মানুষের (তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ডওমিটার)। মৃত্যুর মিছিল যেন কোনোভাবেই থামছে না, শুধু দীর্ঘতর হচ্ছে।

প্রসঙ্গ মৃত্যু। করোনায় মৃত্যু অথবা করোনাকালে অন্য কোনো কারণে মৃত্য। ছোটবেলায় মায়ের মুখে সবসময় ঘুম পাড়ানির গান হিসেবে শুনতাম যে- ‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন’। কিন্তু এখন তো দেখছি কান্নাতো দূরের কথা, কেউ কাছেও যায় না, ছুঁয়েও দেখে না, কবর দিতেও যায় না, লাশ পড়ে থাকে হাসপাতালের মেঝেতে, কোনো আপনজন খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ লাশ নিতে আসে না। লাশের কোনো খাটিয়া থাকে না। ক্রেনে করে গাড়ি থেকে লাশ নামানো হয় কবরে, দড়ি দিয়ে বেঁধে মরদেহ মাটির প্রকোষ্ঠে কোনোরকমে নিক্ষিপ্ত করতেও দেখা গেছে।

বাংলাদেশে যেমন দেখা গেছে, অমানবিকতার চরম চেহারা, তেমনি দেখা মিলছে মানবতাও। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের স্বেচ্ছাসেবী দল গিয়ে মরদেহ সৎকার কাজ করছে। আত্মীয়-স্বজন সবাই প্রিয়জনের লাশ ফেলে পালিয়েছে অথবা কাছে থেকেও ধরেনি, ধরতে আসেনি। এমন অমানবিকতা দেখেছে মানুষ। এমনও দেখা গেছে মায়ের লাশ জঙ্গলে ফেলে দিতে। পৃথিবীর মানুষ এত বদলে গেল কবে? এতটা অমানবিক তো আমরা ছিলাম না। আমাদের হাত-পা এখন আর নিষ্ঠুরতা দেখলে কাঁপে না। এতটুকু প্রকম্পিত হই না আমরা এখন আর।

সেদিন ইউটিউবে দেখলাম রাজপথে একটা কুকুর মরে পড়ে আছে কোনোভাবে হয়তো। আরেকটা জীবিত কুকুর এত ব্যস্ত একটা রাস্তার মাঝখানে একবার যায়, আবার ফিরে আসে, গাড়ি চেক দেয়, আর কামড়ে ধরে মৃত কুকুরটাকে রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। এভাবে বারবার চেষ্টা করতে করতে একটা সময় কুকুরটাও তার স্বজাত কুকুরকে টেনে নিয়ে এলো। এই ভিডিও ক্লিপটি আমার হৃদয়ে প্রকম্পণের ঝড় তুলল। আমি ভাবতে লাগলাম একটা কুকুরও তার বিবেকের সর্বোচ্চ রূপ দেখাল। আর আমরা? আমরা এখন কী করছি?

মানবিকতা শব্দটি বোধহয় মানুষদের জন্যই। আর পাশবিকতা শব্দটি পশুদের জন্য। এই উল্লেখ্য এই কুকুরটি যে মায়া, ভালোবাসা, বিবেক আর ভ্রাতৃত্ববোধ দেখিয়েছে- সে বোধটুকু কে আমরা কোন শব্দে আখ্যায়িত করব? এটাকে যদি মানবিকতা বলি তবে কি খুব বেশি অত্যুক্তি হবে? আর ইদানীং মানুষরূপী আমরা যে অমানুষিক, অমানবিক, স্বার্থপরতা ও পাশবিকতার ফানুস উড়াচ্ছি- সেটাকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য কি কোনো শব্দ আছে মানবসভ্যতার অভিধানে? বিশ্বের বহু জায়গায় এমনকি মানবিকতার দেশ খোদ আমেরিকায়ও দেখেছি অমানবিকতার ভয়াল চিত্র।

আমেরিকায় অনেক লাশের কফিনকে ক্রেনে করে কবরে নামাতে দেখা গেছে। প্রিয় স্ত্রী-স্বামী, বাবা-মায়ের লাশও কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় কবরস্থ করতে দেখা গেছে। বাংলাদেশেও এ ঘটনা কম নয়। হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায় মারা গেছে এমন অনেকেই। করোনা সন্দেহে হাসপাতালে রাখেনি, ভর্তি করায়নি এমন মর্মান্তিক ঘটনা একাধিক ঘটেছে যা আমরা টেলিভিশনে দেখেছি, পত্রপত্রিকায় এসেছে। যেমন রয়েছে মানবিকতার ফেরিওয়ালা চিকিৎসকের আত্মত্যাগ, সম্মুখ সমরে যুদ্ধ, তেমন রয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়া, ঢুকতে না দেয়া, ভর্তি না করানোর অভিযোগও। যেমন রয়েছে ডা. মঈনের আত্মত্যাগ ও অসংখ্য চিকিৎসকের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া, তেমনি রয়েছে বিনাচিকিৎসায়, চিকিৎসাবিহীন কিংবা হাসপাতালে ডাক্তার না থাকায় সঠিক চিকিৎসার অভাবে সকরুণ মৃত্যু। এভাবেই নির্মম মৃত্যু হয়েছে অনেকেরই যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের এমন হৃদয়বিদারক মৃত্যুু জাতির হৃদয়ে এভাবেই তোলপাড় করে তুলেছে। সেদিন টিভিতে দেখলাম ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে একজন মৃতের লাশ ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না, গ্রামবাসীর বাধা। এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে। এমন অনেক ঘটনাই দেখেছে দেশবাসী। মৃতের পরিবার, বাড়িঘর ও আত্মীয়-স্বজনই সবচেয়ে বেশি বাধা দেয় লাশ সৎকারে। গোরস্তানে লাশ নিয়ে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। ঢাকা থেকে অথবা শহর থেকে অথবা হাসপাতাল থেকে করোনায় মৃতের লাশ নিয়ে গ্রামেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না- এমন দৃশ্য এখন নৈমিত্তিক।

এমনকি এমনও দেখা গেছে- করোনায় মারা যায়নি অথচ করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে মৃতদেহের সাথে করা হয়েছে অবিচার। লাশ নিয়ে সারাদিন ঘুরে অবশেষে পুলিশের সহযোগিতায় অথবা উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কবরস্থ করা হয়। কী নির্মম অমানবিকতা শুরু হয়েছে মনুষ্য স্বভাবে চরিত্রে- একটা মৃতদেহ, দুনিয়া থেকে চিরবিদায়, না ফেরার দেশে চলে যাওয়ায় কোনো শেষকৃত্য তো নয়ই, শুধু মাটির নিচে চাপা দেয়াতেই আমাদের কত কৃপণতা, কত আপত্তি। প্রতিটা প্রপঞ্চের দুটো দিক থাকে, এখানে একটা দিক হলো নিজেকে নির্লিপ্ত রাখা, প্রিয়জনের লাশ সৎকারে বা শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ না করা, আরেকটা বিষয় হলো গ্রামবাসী সবাই অথবা আংশিক মিলে বাধা দেয়া এবং লাশ গ্রামে ঢুকতে না দেয়া। কোনটা মানবিক, কোনটা অমানবিক? কোনটা কম, কোনটা বেশি অমানবিক? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। আসলে শূন্যকে যত দিয়েই গুণ করা হয়, অর্থাৎ শূন্যের গুণীতক যতই হোক ফলাফল শূন্যই হবে।

এমন মৃত্যু চাই না যে মৃত্যুতে প্রিয়জন শেষ দেখাটা দেখতে আসবে না। এমন মৃত্যু চাই না যে মৃত্যুতে কাঁদবে না প্রিয়তমা স্ত্রী, প্রিয় স্বজন, প্রিয় খেলার সাথী, প্রিয় পাঠশালার প্রিয় সহপাঠীরা। যে স্ত্রী একদিন গেঁথেছিল চিরস্থায়ী নির্ভরতার বাঁধন, সে স্ত্রী আজ ভয়ে পালায়, মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর মুখে এক গ্লাস পানি তুলে দেয়ার সাহস পায় না। এ কেমন মৃত্যু? এমন অশুভ মৃত্যু চাই না যখন আমার মৃত্যুর পর ফেলে পালাবে প্রিয়জন। এমন মৃত্যু চাই না যেখানে আমার মৃত্যুর পর সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

যে মায়ের মুখখানি না দেখলে পেটের ভাত হজম হতো না, রাতের ঘুম হতো না, সে মায়ের মরা মুখখানি দেখতে যাবে না ছেলে- এ কেমন কথা? যে মা মাথায় হাত না বুলালে শরীরের অসুখ ভালো হয় না, ডাক্তার-কবিরাজ সব শেষ করে জন্মদাত্রী মা বুকে হাত বুলালে, মায়ের কলবে সুরা ফাতিহা, সুরা ইয়াসিন, আয়াতুল কুরসি, সুরা ইনশিরাহ পড়ে ফুঁ দিলে বুকের ব্যথা সেরে যায়, সে মায়ের লাশ আমি কাঁধে নেব না, খাটিয়াবিহীন কাগজের ঠোঙ্গার মতো করে, কাপড়ের টুকরায় বহন করে বয়ে নিয়ে যাবে গোরস্তানপানে একদল স্বেচ্ছাসেবক, অথবা পুলিশ বাহিনী- এ কেমন সন্তান আমি? এ কেমন মানবিকতার বিপর্যয়? কতটা অমানবিক মানুষ হতে পারে?

যে বাবার আঙুল ধরে পৃথিবীতে পথ চলতে শিখেছি, যে বাবার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি, তিরিশ বছর ধরে যে বাবা একজীবনে পড়তে বসার জন্য, আরেক জীবনে স্কুলে যাওয়ার জন্য, আরেক জীবনে অফিসে যাওয়ার জন্য রোজ সকালে নিয়ম করে ডেকে দিতেন, যে বাবা ক্লান্তিহীন একাগ্রতায় দিয়ে আসছে ভালোবাসার শক্তিশালী বাঁধন- সে বাবা আমার চলে যাবে পুত্রের শেষ শ্রদ্ধাটুকু ছাড়াই, মায়াময় এ পৃথিবীর বাঁধন ছিন্ন করে শেষযাত্রায় রওনা হবে অশ্রুসিক্ত আহাজারি ছাড়াই- এমন মৃত্যু চাই না। যে বোনেরা তাদের ভালোবাসার সবটুকুই বিসর্জন দিত ভাইয়ের সন্তুষ্টির জন্য আর সে বোনটি একা চলে যাবে কবরে- আমি ভাই তাকে শেষবিদায়টা দিতে যাব না, কেমন ভাই আমি? এমন মৃত্যু চাই না।

কেন আমরা এত অমানবিক হলাম! কেন আমার হৃদয় এত পাথর হয়ে গেল? কেন আমাদের মন ইস্পাতের মতো কঠোর হয়ে গেল? কেন প্রিয়জনের শেষবিদায়ে আজ আমাদের অন্তর এতটুকু দ্রবীভূত হয় না? এতটা পাষাণ তো আমরা ছিলাম না? এ কেমন কঠিন পরীক্ষায় ফেললে হে বিধাতা? আমার কোলের সন্তানটি ঘরে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদবে তার প্রয়াত বাবার জন্য, অথচ তার বাবার লাশটি তাকে ছুঁয়ে দেখতে দেয়া হবে না। এ কেমন মৃত্যু? এমন মৃত্যু চাই না। এমন জীবনও চাই না, যে জীবনে বেঁচে থেকে দেখতে হবে এমন অমানবিক দৃশ্য।

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট

এইচআর/বিএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।