দুই মাস বন্ধের পর এত টাকা কই?
রেমডিসিভির আসার খবরে যতটা না উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম দাম শুনে ততটাই দমে গেলাম। পুরো কোর্স শেষ করতে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাগবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই তা পারবে না। প্রথমত দারিদ্র্য। দ্বিতীয়ত টানা দুই মাস কেউ সঞ্চয় ভেঙে, কেউ ঋণ করে আর কেউ স্রেফ ত্রাণের ওপর জীবনযাপন করছেন। এই মুহূর্তে টাকা কোত্থেকে বের করবেন?
কিন্তু বাঁচার আকুতি তো সবারই প্রবল। এখন টাকার জোগাড় করতে মধ্যবিত্ত ছেলে বাবার প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বের হবে। স্বজনদের কাছে, প্রতিবেশীর কাছে কিছুটা ভিক্ষাবৃত্তির মতো করবে। যেটা তার আজীবনের দাগ হয়ে থাকবে মাথার মধ্যে। এটা আমাদের নিয়তি নির্ধারিত দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রকাশ। কিন্তু এই দুঃসময়ে এর বিকল্প কি কিছু ভাবা যেত?
এখন আমাদের ওষুধ লাগবে কিন্তু টাকা নেই। তাহলে বাঁচানোর দায়িত্ব তো কাউকে নিতে হবে। কে সে? সরকার তো হাজারটা দায়িত্ব নিচ্ছেই। এটা যদি না দিয়ে ওই কাঁধটা একটু মুক্ত রাখা যায় ক্ষতি কী? তাছাড়া শেষ ভরসা বলে তো একটা টার্ম আছে। কেউ না পারলে সরকার দায়িত্ব নেবেই। মানুষতো আর মেরে ফেলা যাবে না।
আচ্ছা, যে ছয়টি কোম্পানি ওষুধটা বানাচ্ছে আপাতত দায়িত্বটা যদি তাদের দেয়া হয় কেমন হয়? এমনিতেই তো বলা হচ্ছে এটি রোগীর একদম চূড়ান্ত সময়ের চিকিৎসা। সুতরাং ওই পর্যন্ত যেতেই হচ্ছে না বেশিরভাগ রোগীর। তাই যদি এমন হতো, ডাক্তার সাহেব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর রোগীর বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী দাম ধরা হচ্ছে। যার একেবারেই সঙ্গতি নেই তিনি ফ্রি পাবেন।
সবচেয়ে ভালো হয় একটা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সবাইকে বিনামূল্যে দিতে পারলে। কারণ যে মানুষগুলোকে বাঁচানো দরকার, এই মানুষগুলোই তার বাজার। এরাই ওষুধ কিনে তাদের এতদিন টিকিয়ে রেখেছিল। দেশের মানুষের ওষুধ কেনার কারণে, গ্রামের মধ্যে গড়ে উঠে শহরে এসেছে বিশাল বিশাল কারখানা। তারা বাঁচলে না, আবার বাজারও দাঁড়াবে। মনে রাখা দরকার স্প্যানিশ ফ্লু’র পর শুধু ক্রেতার অভাবে বহু কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
অবশ্য এই মুহূর্তে খোলা বাজারে ওষুধটি না দেয়ার সিদ্ধান্ত অনেক বুদ্ধিদীপ্ত হয়েছে। কারণ খোলা বাজারে দিলে, আমাদের অনেক ভাই-ভাবি বাজারের থলে নিয়ে ওষুধ কিনতে বের হতেন। মোটামুটি বোঝা মাথায় করে নিয়ে বাসায় রাখতেন। হোক ইনজেকশন তাতে কী? মনে মনে ভাবতেন দরকারের সময় যদি না পাওয়া যায়। কখনো ভাবতেন না, আরো মানুষের বাঁচার দরকার। তিনি একা বেঁচে খুব লাভ নেই।
খোলাবাজারে না দেয়ার সিদ্ধান্ত আমাদের অনেক ফার্মেসি ভাইয়ের জন্যও ভালো হয়নি। এখন তারাও আর, একটু আগে শেষ হয়ে গেছে-পরে আসেন জোগাড় করে দিতে হবে- একটু দাম বেশি পড়বে । এসব চর্চার সুযোগ পাচ্ছে না। তবে মানুষের বিপদ কেটে গেছে এ রকম ভাবার সুযোগ এখনও আসেনি।
পর্যাপ্ত থাকার পরও হাসপাতাল থেকে ওষুধ উধাও হয়ে যেতে পারে। তারপর একে ওকে ধরে দ্বিগুণ দামে ওষুধ পাওয়া যাবে হয়তো। সঙ্গে হুমকি ফ্রি। কাউকে বললে কিন্তু খবর আছে। আমাদের হাসপাতালগুলো এখনও এ রকম অব্যবস্থাপনায় আছে। এখনও বহু জায়গায় হাসপাতাল প্রধানের চেয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়ন সভাপতির ক্ষমতা বেশি। ধান ভাণতে শিবের গীত মনে হচ্ছে হয়তো। আসলে মানুষ বাঁচাতে এসব সতর্কতার কথা আসছে। কারণ মানুষ প্রতিটি হাসপাতালে এই শ্রেণির মানুষের হাতে আসলেই নির্যাতিত হয় দিনের পর দিন।
কথা শুরু করেছিলাম রেমডিসিভির দাম নিয়ে। শুধু বাঁচার জন্য কী না করছে মানুষ। চিন্তাই করা যায় না। যার প্রেক্ষাপটে যেটা দরকার তিনি সেটা করছেন। দরকার হলে ছেড়ে যাচ্ছেন, আবার দরকার হলে আটকে থাকছেন। মানুষ নামের মহাশক্তিধর জাতটা আজ মহা অসহায়। অথচ সমাজ সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের লাগবে। তাই জাতটাকে বাঁচাতে হবে। যেকোনো মূল্যে।
আমিতো শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলোর কথা বললাম। লেখার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তাই বলে ফেললাম। অনেকে আরও নানা মেধাবী উপায় খুঁজে বের করতে পারেন। নিশ্চয়ই করবেন। তবে দ্রুত শক্ত হাতে করুন, সময় কিন্তু নেই।
শেষমেষ সরকার দায়িত্ব নিয়ে নেবে। তখন আর ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পাবেন না। আমার অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। আমার মানুষের বাঁচা নিয়ে কথা।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ