মানবিক আচরণের ঘাটতি বিপজ্জনক হতে পারে
শৈশবের কথা বলি। পাশের গাঁয়ে কলেরার প্রাদুর্ভাব হয়েছিল একবার। বেশ, ওমনি বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ। পুরো গ্রামের কয়েকটি টিউবওয়েলের একটি আমাদের বাড়িতে থাকার পরও পানি ব্যবহারে সতর্কতা বেড়ে গেল। টিউবওয়েলের পানিও সেদ্ধ করে পান করতে হবে। বাড়িতে পাকা পায়খানা থাকলেও সেটাও ছিল খোলা। সতর্কতা হিসেবে সেখানে চুন ছিটানো হলো। তারপর একসময় স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়া হলো আমাদের। এমন সতর্কতামূলক অবস্থাগুলো আমাদের শিশুমনে মারাত্মক প্রভাব ফেলত। ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতাম। বাড়ির দক্ষিণে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, পথচারীদের মধ্যে কোনো কলেরারোগী থাকে কি না দেখার জন্য।
সবচেয়ে বড় প্রতিক্রিয়াটা হতো কলেরা সম্পর্কে আশপাশের মুরুব্বিদের মন্তব্য শোনার পর। তারা বলতেন, কলেরা হচ্ছে আল্লাহর গজব। আর সেই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি পাপী না হয়ে পারে না। বলতে দ্বিধা নেই, ভাবতাম এই পাপীগুলোর শাস্তি হওয়া উচতি, এমনও ভাবতাম ওদের মেরে ফেলে দিলেইতো হয়। এই যে অমানবিক ও অযৌক্তিক ভাবনা, তা বোঝার মতো ক্ষমতা ছিল না তখন। কিন্তু যাদের প্ররোচনায় এই ভাবনা হতো তাদেরও দোষ দেই কীভাবে, কারণ তাদের শিক্ষা এবং জীবনাচারই ছিল ওরকম ভাবনার অনুকূলে।
আমাদের সৌভাগ্য আমরা সেই কলেরার যুগ, বসন্তের যুগ, ম্যালেরিয়ার যুগও পেরিয়ে এসেছি। শিক্ষাক্ষেত্রেও আমাদের অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। দেশও এগিয়ে গেছে। প্রতিটি বাড়িতে এখন স্যানিটারি পায়খানাসহ স্বাস্থ্যসচেতনতাও অনেকদূর অগ্রসর। অর্থনৈতিক উন্নয়নও তো বিশ্বস্বীকৃত। কিন্তু এত অগ্রসর সমাজেও যখন দেখি চট্টগ্রামে এক ভাড়াটিয়ার করোনা পজেটিভ চিহ্নিত হওয়ার পর বাড়িওয়ালা দরজায় তালা লাগিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। তখন ভাবতেই হয় আমাদের এগিয়ে যাওয়াটা কোন দিকে আসলে। ওই ভাড়াটিয়া শেষ পর্যন্ত বাসা ছেড়ে রওনা হন চাঁদপুরের উদ্দেশে। চালের ট্রাকে করে লাকসাম পর্যন্ত এসে নেমে পড়েন। জ্বর নিয়ে লাঙ্গলকোট স্টেশন পর্যন্ত আসার পর আর তিনি চলতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত কুমিল্লার এসপি ও ডিসির হস্তক্ষেপে তাকে স্থানীয় চিকিৎসাকেন্দ্রে আইসোলেশনে রাখা হয়।
একইরকম আরেকটি চিত্র দেখলাম একটি দৈনিকের সংবাদ বিশ্লেষণে। বাড়িতে রক্ত সংগ্রহকারী গাড়ির উপস্থিতির পরই বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার ওপর প্রায় চড়াও হওয়ার অবস্থা। ভাড়াটিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে আক্রান্ত এবং প্রবীণ হওয়ার পরও মানসিক নির্যাতন থেকে রক্ষা পাননি। ভাড়াটিয়ার উচ্চশিক্ষিতা মেয়েকে ধমক শুনতে হয়েছে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে। অথচ এই মেয়েটির কৈশোর থেকে বর্তমান পর্যন্ত কেটেছে ওই বাড়িতে। ১৩ বছরের জানাশোনা থাকার পরও বাড়িওয়ালার রক্তচক্ষু দেখার পর দিশেহারা ওই ভাড়াটিয়া। কারণ তাদের বলা হয়েছে, বাড়ি ছেড়ে দিতে, না হয় বের করে দেয়ার বিকল্প পথ বেছে নেয়া হবে।
ব্যতিক্রম নেই এমন নয়। আমার নিকটাত্মীয় তার কয়েকটি টিনশেড ভাড়া দিয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে। কয়েকটি পরিবার ছুটি ঘোষণার পরই গ্রামে চলে গিয়েছে। কয়েকটি পরিবার এখনও মিরপুরের ওই বাড়িতে অবস্থান করছে। লকডাউনের কারণে তাদের আয়-রোজগার বন্ধ। স্বাভাবিকভাবেই তাদের এখন মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বাড়িওয়ালা ভাড়া মওকুফ করে দেয়াই শুধু নয় প্রতিটি পরিবারকে চালডাল তেল-নুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন দুর্যোগ কাটানোর সহায়তা হিসেবে। কিন্তু এই চিত্র খুবই কম। বেশিরভাগ মানুষই চেয়ে থাকে ওই বুঝি করোনা রোগী যায়। আর জানা হয়ে গেলে তো গঞ্জনা যে কেমন হতে পারে উপরের দুটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট বলে মনে করি।
সাধারণত মহামারি দেখা দিলে সামাজিক এই দৃশ্য যুগযুগ ধরেই দেখা যায়। আক্রান্তদের ভাবা হয়, পাপী হিসেবে। চিকিৎসা ও সেবায় দুর্ভোগের বিষয়টিতো আছেই। এমন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন সচেতনতা তৈরি প্রয়োজন তেমনি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও দরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তিনি মানুষকে অনুরোধ করেছেন, আক্রান্তদের সঙ্গে যেন সংযত আচরণ করা হয়।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কর্মরত কর্তৃপক্ষ সেদিকে এখনও নজর দিয়েছে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে মানবিক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির জন্য প্রচারমাধ্যমগুলো তেমন তৎপর হয়নি এটা বলা যায় সহজেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও নির্বিকার। বিশেষ করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক সৃষ্টির কোনো সরকারি উদ্যোগের কথাও আমরা জানতে পারিনি।
বলা হয়, দেশে ৩০ হাজারের বেশি চিকিৎসক চাকরিহীন অবস্থায় আছে। যদি তাই হয় তাদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সংগঠিত করাটা অতি জরুরি। তারা অন্তত রোগীদের প্রতি অনাচার না করার ক্ষেত্রে ভূমিকাও পালন করতে পারেন। এক্ষেত্রে তরুণ-যুবকদের কথা গুরুত্বসহ বিবেচনা করা যেতে পারে। করোনা প্রতিরোধ কাজে অন্যতম ভূমিকা পালন করছেন যেসব ডাক্তার তাদের পক্ষে মানুষকে বুঝিয়ে সঠিক পথে আনা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তরুণদের সংগঠিত শক্তি অনেক সফল হতে পারে। সর্বশেষ রাষ্ট্রকেও সরাসরি আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। যেকোনো নাগরিকের আইনগত সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে, এটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
রোগীকে নিগৃহীত করার কারণে সারাদেশেই তথ্য গোপন করার প্রবণতা দেখা যায়। গোপন করার এই প্রবণতা গোটা লড়াইকেই বিঘ্নিত করতে পারে। অন্যদিকে সাধারণ লক্ষণ থাকার পরও মানুষ হাসপাতালে দৌড়ায় সামাজিক নির্যাতনের কারণে। আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করে, পরিবারের সদস্যরাও তার প্রতি সহানুভূতিশীল না-ও হতে পারে।
আক্রান্ত রোগী শুধু যে সামাজিকভাবে নিগৃহীত তা নয়, তাকে হাসপাতালেও নাজেহাল হতে হয়। সংবাদ হয়েছে, করোনা রোগী ভেবে সাধারণ রোগীদেরও অনেক হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। করোনা রোগীর চিকিৎসা না পাওয়ার এই তথ্য অন্যদের আতঙ্কিত করে। এতে করে তথ্য গোপনের যে প্রবণতা তৈরি হয় আর তার পরিণতি যে কী হতে পারে, তাও আমরা জানতে পেরেছি সংবাদ মাধ্যমে।
একজন মাওলানা সাহেব একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিলেও কোথাও তিনি বলেননি তার প্রকৃত সমস্যা কী। শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যাওয়ার পর জানা যায়, তার পরীক্ষায় পজিটিভ রেজাল্ট হয়েছে। তার জানাজার নামাজে দুই শতাধিক মানুষের সমাগম হওয়ার সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, তথ্য গোপন করলে কী পরিণতি হতে পারে। আর তথ্য গোপন করার এই মানসিকতা তৈরি হয় মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি সামাজিক অনাচার চালানো হয় বলেই।
এই মুহূর্তে আক্রান্তদের প্রতি মানবিক আচরণ করার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেটাও করোনা যুদ্ধেরই অংশ বলে মনে করি।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক।
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ