সংবাদমাধ্যমে প্রণোদনা : কেন, কাদের জন্য, কীভাবে
অভিধানে ’প্রণোদনা’ শব্দের অর্থ দেখতে পাচ্ছি : উদ্দীপনা, কর্মপ্রেরণা, কোনো কাজ করার উৎসাহ, অনুপ্রেরণা। ব্যবসার মন্দা বা সংকটকালে সরকার সুদের হার কমিয়ে বা ভর্তুকি দিয়ে বা সরকারি অনুদানের মাধ্যমে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। বিষয়টি এত স্পষ্ট যে, বিশদ বলার প্রয়োজন নেই।
দেশে-বিদেশে নানা বড় সংকটের সময় এই নিয়ে উথাল-পাতাল দেখি। আমাদের দেশে বছর কয়েক আগে হাওরে ফসলহানির সময়ে সে অঞ্চলের কৃষকদের জন্য ’প্রণোদনা’ নিয়ে বেশ সরব আলোচনা শুনেছিলাম। এর বাইরে ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা ছাড়া তেমন আলোচনা বা উদ্যোগ দেখা যায়নি। ব্যাংক ডুবে গেছে বাঁচানোর প্রণোদনা চাই। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে শোধ করা যাচ্ছে না, প্রণোদনা চাই। ঋণখেলাপি হয়ে গেছে, প্রণোদনা চাই। এসব ছাপিয়ে প্রণোদনা নিয়ে সবচাইতে উঁচুকণ্ঠ হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পমালিকরা। কোনো দুর্যোগ এলেই ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার। ৪২ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে, এদের আবার অধিকাংশ নারী- নারীর ক্ষমতায়ন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, দেশের সবচাইতে বড় রফতানি খাত ধ্বংসের মুখে, কাজেই প্রণোদনা চাই। শ্রমিক নেত্রী নাজমা যখন প্রশ্ন করেন, ৪০ বছরের এই শিল্পের মালিকরা এই ব্যবসা থেকে কত কী-ই না পেয়েছেন! কোনো সংকটকালে শ্রমিকদের তিন মাস বেতন দিয়ে পোষার সামর্থ্য তাদের নেই? মেলে না জবাব। নাজমার চিৎকার হারিয়ে যায়, প্রণোদনা চাই, প্রণোদনা চাই উচ্চকণ্ঠের আওয়াজে।
এবার করোনা দুর্যোগেও ব্যতিক্রম নেই। উদ্বোধনী লগ্নেই সুযোগটি নিলেন ঋণখেলাপিরা। তাদের কিস্তির সময় বাড়ল। এরপর যথারীতি সেই গার্মেন্টস শিল্পমালিকরা। এ নিয়ে নাটকের নানা দৃশ্য আমরা এখনও দেখে চলেছি। অস্বীকার করার জো নেই এবারের সংকটটি সর্বব্যাপী ও দীর্ঘমেয়াদি। কমবেশি সবাই এতে আক্রান্ত। সে কারণে এবার প্রণোদনার দাবিটি আসছে সব মহল থেকে। সংবাদমাধ্যমও সঙ্গত কারণেই এর বাইরে নয়। ইচ্ছে করেই গণমাধ্যম না বলে সংবাদমাধ্যম বললাম। কারণ সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা এই যুদ্ধের মাঠে সম্মুখ সারিতে থেকে মানুষকে তথ্য জানানোর দায়িত্ব পালন করছেন। সামাজিক মাধ্যম, ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউবওয়ালারা নিরাপদ অবস্থানে বসে, কেউ কেউ মনের মাধুরী মিশিয়ে তাদের ’কাজ’ করছেন।
দীর্ঘমেয়াদি লকডাউনে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমগুলোর অবস্থা আমরা কমবেশি জানি। সংবাদপত্রগুলোর সার্কুলেশন ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। প্রতিষ্ঠিত দুটি কাগজ প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হযেছে। টেলিভিশনগুলো চলছে স্বল্পসংখ্যক কর্মী দিয়ে।
পাশের দেশ ভারতের এক সাংবাদিক জানান, চব্বিশ বছর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন একটি সর্বভারতীয় দৈনিকের সানডে ম্যাগাজিন বিভাগে। পরিচিত লেখনী, সাংবাদিক মহলে, পাঠকদের কাছেও স্বীকৃত। কদিন আগে একটি ফেসবুক পোস্টে জানালেন, আমার আর চাকরি নেই। শুধু আমার নয়, ম্যাগাজিন বিভাগের সবার চাকরি গেছে। চব্বিশ বছর কাগজকে ভালোবেসে কাজ করেছিলাম। একটা ফোনে সব শেষ হয়ে গেল। অনিশ্চিত হলো জীবন। বেতন অর্ধেক করা হয়েছে একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্মীদের। মাইনে কমেছে বাণিজ্য সম্পর্কিত একটি সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের। একটি টেলিভিশিন চ্যানেলের ডিজিটাল বিভাগের ১৬ জন কর্মীকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। একটি ডিজিটাল সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম কর্মীসংখ্যা অর্ধেক করে দিয়েছে। একটি টেলিভিশন চ্যানেল ৪৬ জন রিপোর্টার, ছয়জন ক্যামেরাপারসন, সতেরো জন প্রডিউসারকে আপাতত ছুটি দিয়েছে। একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক মুদ্রণ বন্ধ করে ডিজিটাল ফর্মে গেছে। কলকাতার খবরের কাগজগুলো কলেবরেও সংক্ষিপ্ত হয়ে ডিজিটাল সংস্করণে জোর দিয়েছে বেশি। সব মিলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
এই সংকট শুধু সাংবাদিক শ্রমিক-কর্মচারীদের সংকট নয়, গোটা শিল্পেরই সংকট। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে সেভাবেই। দাবি উঠেছে সংবাদমাধ্যমের জন্য প্রণোদনার। সরকার ইতোমধ্যে বিশাল অংকের প্রণোদনা ঘোষণা করেছে বিভিন্ন খাতের জন্য। কিন্তু স্পষ্টভাবে সেখানে সংবাদমাধ্যমের জন্য কিছু নেই। সংবাদমাধ্যমও কী চায় তা স্পষ্ট নয়। কেউ চায় থোক বরাদ্দ, কেউ চায় তহবিল, কেউ চায় সহজশর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা। যদি আমাদের সংবাদমাধ্যম সম্পর্কিত সংগঠনগুলোর নিজস্ব তহবিল থাকত তাহলে চিন্তার কারণ ছিল না। নিজেরাই নিজেদের দুর্গত বন্ধুদের জন্য হাত বাড়াতে পারত। যেমন আইনজীবীরা পেরেছেন। অসচ্ছল আইনজীবীদের বিনা সুদে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন। করোনাভাইরাসের কারণে আদালত বন্ধ থাকায় অসচ্ছল আইনজীবীরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। তাদের জন্য সমিতি ৫০ লাখ টাকার একটা তহবিল করেছে। সেখান থেকে তাদের জন্য তিন বছর মেয়াদে বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সংবাদকর্মীদের সংগঠনগুলো সেই অবস্থায় নেই। প্রেক্ষাপটও ভিন্ন। আইনজীবীদের সমস্যা আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, কিন্তু সাংবাদিকদের কাজ বন্ধ হয়নি। সংবাদমাধ্যমের জন্য প্রণোদনা দেয়ার দাবি জোরালো হলেও প্রশ্ন উঠেছে এই প্রণোদনা দেয়া হবে কীভাবে? কাদেরকেই বা দেয়া হবে?
পাশের দেশগুলোর খোঁজ নিয়েছি। ভারতে সংবাদমাধ্যমের জন্য প্রণোদনা কেউ চায়ওনি, সরকারের বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজে এর কোনো উল্লেখও নেই। পাকিস্তানের অবস্থাও তাই। তবে একটি ঘোষণা আছে, যদি কোনো সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাহলে তার পরিবারকে ১০ লাখ রুপি দেয়া হবে। পাকিস্তানের কোনো কোনো প্রাদেশিক পর্যায়ে কিছু ঘোষণা আছে। শ্রীলংকায়ও একই অবস্থা।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ: করোনার জন্য জারি করা জরুরি পরিস্থিতির মধ্যেও সাংবাদিকরা যাতে স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন। ’গ্রুপস অব সেফটি অব জার্নালিস্টস [প্রায় ৪০টি দেশ] এর বিবৃতি, মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন অন প্রেস ফ্রিডম, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের বিবৃতি, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে তুলে ধরা জাতিসংঘ মহাসচিবের আট দফা প্রস্তাবনায় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, তথ্য প্রকাশে স্বাধীনতার কথা যতটা উচ্চস্বরে বলা হয়েছে, ততটা জোরে আর্থিক প্রণোদনার কথা বলা হয়নি।
আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি খুব জোরেসোরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮ জন ডেমোক্রেট সিনেটর ও একজন স্বতন্ত্র সিনেটর এই দুর্যোগের সময় ‘আঞ্চলিক’ সংবাদমাধ্যমগুলোকে সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। তারা বলেছেন : দেশজুড়ে আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমগুলোই সঠিক তথ্যভিত্তিক খবর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তুলে ধরে। সে জন্য তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষিত দুই ট্রিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে সহায়তা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। এই দাবির সাথে সহমত পোষণ করেছেন গণমাধ্যম সম্পর্কিত ২০০০-সংগঠনের প্ল্যাটফরম ‘নিউজ মিডিয়া অ্যালায়েন্স’। তারা এমনটিও বলছেন, জনগণের জন্য সরকার যে স্বাস্থ্যবার্তা প্রচার করে সেগুলো যাতে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন আকারে দেয়া হয়।
তবে প্রণোদনার বিষয়ে খুব সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিয়েছে ‘দ্য নিউজ গিল্ড’। এই সংগঠনটি সরাসরি সরকারের কাছ থেকে আর্থিক প্রণোদনা চেয়েছে। ‘জীবন বাঁচাতে সংবাদমাধ্যম চায় প্রণোদনা’ শিরোনামে তাদের আবেদনে বলা হয়েছে, এই দুঃসময়ে সংবাদকর্মীদের দায়িত্বপালনকে স্বীকৃতি দেয়া হোক। সরকারিভাবে একটি তহবিল গড়ে তোলা হোক, যাতে যেকোনো ঝুঁকির সময় সংবাদকর্মীরা সেখান থেকে সহায়তা নিতে পারেন। তবে নিশ্চিত করতে হবে, যারা এই তহবিল থেকে সহায়তা নেবেন তারা স্বাধীনভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। বলা হচ্ছে: যে মালিক এই তহবিল থেকে সহায়তা নেবেন তিনি দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবেন। গৃহীত অর্থ কীভাবে, কোন খাতে ব্যয় হবে মালিকদের তা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে। এই তহবিল থেকে যে প্রতিষ্ঠান অর্থ নেবে: পাঁচ বছর পর্যন্ত সেই প্রতিষ্ঠানে কোনো কর্মী ছাঁটাই করা যাবে না, বেতন কমানো যাবে না, লে অফ করা যাবে না, কর্মীদের অধিকার রক্ষা করতে হবে, পরিচালনা পর্ষদে কর্মচারীদের প্রতিনিধি রাখতে হবে। পাঁচ বছর পর্যন্ত এই তহবিল মালিক তার অন্য ব্যবসার কাজে ব্যবহার করতে পারবেন না। এই অর্থ শুধু এই প্রতিষ্ঠান ও এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্যই ব্যবহার করতে হবে। তবে এই প্রস্তাবনা বিতর্ক ছড়িয়েছে ব্যাপক। অনেকে বলছেন, যে প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্য সংবাদ সন্মেলনে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমকে গালাগাল করেন, পেশাদার সাংবাদিককে অপদস্ত করেন, সেই প্রেসিডেন্টের গড়া তহবিল থেকে অর্থ নিতে গেলে সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের মাথা বিক্রি করতে হবে। প্রেসিডেন্ট এই সুযোগ ছাড়বেন না। কাজেই এ রকম একটি সরকারি তহবিল থেকে অর্থসহায়তা নেয়া হবে পেশাদারিত্বের চূড়ান্ত অপমান।
সবশেষ খবর পাওয়া গেল আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমকে সহায়তার জন্য ৫০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া সরকার। তবে সব প্রণোদনা আলোচনাতেই দেখতে পাচ্ছি, আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যম- অর্থাৎ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে যারা তথ্য নিয়ে যেতে পারে তাদের কথাই বলা হয়েছে। আর সহায়তা দিতে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানকে। কোনো সংগঠন বা ব্যক্তিগত সুবিধার কথা বলা হয়নি।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের প্রণোদনা চাহিদা কেমন হওয়া উচিত সেটা একটু ঠান্ডা মাথায় দেখা যাক। এখানে পক্ষ কয়েকটি। প্রকৃতপক্ষে সব মিলেই একটি পক্ষ। তাদের দায়িত্ব বিভাজন সুনির্দিষ্ট, কিন্তু লক্ষ্য একই। প্রথম পক্ষ, সংবাদকর্মী এবং প্রতিষ্ঠানের সহযোগী কর্মী সবাই। সময় যত কঠিনই হোক, দুর্যোগ যত গভীরই হোক, এই কর্মীরাই আসলে প্রতিষ্ঠানের প্রাণশক্তি। বাংলাদেশের কোনো সংকটে সংবাদমাধ্যমের কোনো কর্মী কাজ করতে অনীহা দেখিয়েছেন এমন নজির নেই। এই কর্মীরা এবারের সংকটে প্রাথমিকভাবে দুটি দায়িত্ব পালন করছেন। একটি হচ্ছে সঠিক তথ্যের ব্যবহার করে, সব অপতথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে পেশাগত দায়িত্ব পালন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে অতিমাত্রায় সতর্ক থাকা নিজের জন্য, সহকর্মীদের জন্য, পরিবারের জন্য। এই সংবাদকর্মীদের প্রথম চাওয়া, তারা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে। অফিসে ও বাইরে দায়িত্ব পালনের সময় তাদের শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বাড়তি সতর্কতার জন্য তাদের প্রতি বাড়তি নজর দেয়া। সময়মতো বেতন বোনাস, চাকরি চলে যাওয়ার হুমকি না থাকা। এই ন্যূনতম চাওয়া ও পাওয়াটিই এই মুহূর্তের স্বাভাবিক প্রণোদনা।
দ্বিতীয় পক্ষ মালিক। কর্মীরা যখন এই কঠিন সময়ে স্বাভাবিক চাওয়া চাইবে, তখন মালিকদের এই বিষয়গুলো অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। তবে একথাও ঠিক সব মালিকের অবস্থা একরকম নয়। হয়তো ব্যবসাও ভালো চলছে না। আয় না করলে তিনি দেবেনই বা কোথা থেকে। এই পরিস্থিতিতেই আসে মালিকদের বা প্রতিষ্ঠানের প্রণোদনা চাওয়ার প্রসঙ্গটি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সংবাদমাধ্যম মালিক বা প্রতিষ্ঠান কোনো প্রণোদনা চাননি। মালিকরা যদি কোনো প্রণোদনা না নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারেন সেটাতো খুবই খুশির কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতন-বোনাস নিয়মিত হচ্ছে না, ছাঁটাই-লে অফের হুমকি আছে, যাদের চাকরি চলে গেছে তাদের পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতেই এগিয়ে আসার দায়িত্ব সাংবাদিক শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের। সামনে এসে তাদের বলতেই হবে: মাঠে দায়িত্ব পালনের সময় ও কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা জোরদার করুন, কর্মীদের স্বাস্থ্যবীমা নিশ্চিত করুন, বেতন-ভাতা নিয়মিত রাখুন, ছাঁটাই-লে অফ বন্ধ রাখুন, যাদের চাকরি গেছে আইন অনুযায়ী তাদের সব বকেয়া পরিশোধ করুন। মালিকরা যদি বলেন সরকারি প্রণোদনা না পেলে তার পক্ষে এসব দাবি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, তখনই প্রশ্ন আসবে কি প্রণোদনা চান তারা? মালিকপক্ষ তাদের প্রণোদনা প্রস্তাব করবে, সরকারের কাছে যাবে, ইউনিয়ন তাদের সহযাত্রী হবে। মালিকের প্রণোদনা প্রস্তাবে ইউনিয়ন সহযাত্রী হয়েছে এমন নজির আছে? অবশ্যই আছে। এই নিবন্ধকার সংবাদপত্র শিল্পের ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম [আংশিক] ওয়েজবোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বেতন কাঠামো চূড়ান্ত হলেই মালিকরা বলতেন, বিজ্ঞাপনের রেট না বাড়ালে আয় বাড়বে না, ওয়েজবোর্ডের সুপারিশও বাস্তবায়ন করা যাবে না। আমরা বলতাম, আমাদের দাবি নতুন কাঠামো অনুযায়ী বেতন; আপনাদের প্রস্তাব সেটি দিতে নতুন বিজ্ঞাপন রেট। চলুন সরকারের কাছে আপনাদের প্রণোদনার জন্য, আমরা সাথে থাকব। কারণ স্বার্থটি শিল্পের, সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের।
কাজেই সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা পাওনা চাইবেন মালিকের কাছে। মালিক যদি প্রণোদনা না নিয়ে পারেন ভালো, আর যদি প্রণোদনা চান, সরকারের কাছে যেতে হবে একসাথে। একই দাবি নিয়ে। সরকারের দায়িত্ব সর্বব্যাপী। করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে সংবাদমাধ্যম সরকারের সহযোগী দুই ফ্রন্টে। এক. অপতথ্য ও গুজবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, দুই. সঠিক তথ্য জানিয়ে মানুষকে সচেতন করা, মানুষের সতর্কতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে। এই দুঃসময়ে যখন সংবাদকর্মীরা যদি বেতন-বোনাস নিয়মিত না পান, ছাঁটাই-লে অফের হুমকি থাকে, চাকরিচ্যুতদের পাওনা পরিশোধ না করা হলে বিষয়টি অমানবিক শুধু নয়, শিল্পে অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিতও দেয়। ইতোমধ্যে সংবাদপত্রের মালিকরা সরকারের কাছে তাদের বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলগুলো পরিশোধের দাবি করেছেন। টেলিভিশনগুলোর স্যাটেলাইট ফি মওকুফ বা বিলম্বিত কিস্তি চাইছেন। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা যায়। কোনো কোনো মালিক দাবি করেছেন স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাংকঋণ। কোনো মালিক সরকারের ত্রাণ তহবিলে অর্থ দিচ্ছেন, আবার তার নিজের প্রতিষ্ঠানেই সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা হয় না। এই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি চলতে পারে না। প্রণোদনা যেহেতু শিল্পভিত্তিক, সে জন্য গোটাশিল্পকে নিয়েই ভাবতে হবে সরকারকে। চাহিদা বোঝার জন্য মালিক সমিতি আর ইউনিয়নের সাথে একসাথে বসা জরুরি। অন্য সংগঠনগুলো থেকে পাওয়া মতামতগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। আলোচনা করেই শিল্প ও কর্মীদের স্বার্থে প্রণোদনা প্যাকেজ নিশ্চিত করতে হবে। মাথায় রাখতে হবে এই প্রণোদনার অংশীজন হবেন: ১. প্রণোদনা নিতে আগ্রহী মালিকপক্ষ, ২. যারা নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন কিন্তু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, ৩. সংবাদমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে বেকার ও অসচ্ছল যারা ৪. এমনকি সংবাদমাধ্যমের সাথে জড়িত খণ্ডকালীন [হকার, বাইন্ডার, ক্যাবল অপারেটরদের মাঠকর্মী] অসচ্ছলদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সরকার স্বতস্ফূর্তভাবেই যে প্রণোদনাগুলো ঘোষণা করতে পারেন : ১.দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো সংবাদকর্মী মারা গেলে তার ও পরিবারের জন্য অর্থ সাহায্য, ২. কোনো সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হলে নির্ধারিত হাসপাতালে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ৩. বেকার সাংবাদিকদের তালিকা করে নীতিমালার ভিত্তিতে সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ তহবিল থেকে সহায়তা দেয়া ৪. বেকার, বয়স্ক, অসচ্ছল সাংবাদিক শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য সরকার ঘোষিত রেশন কার্ড থেকে পর্যাপ্ত রেশন কার্ড বরাদ্দ দেয়া। তবে সরকার যে প্রণোদনাই ঘোষণা করুন, সেটি যেন হয় দলমত নির্বিশেষে সবার জন্য। এই প্রণোদনা যেন ঢাকার বাইরের মালিক, সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারী সবার জন্যই অবারিত থাকে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ প্রণোদনার আরেক অর্থ মানবিকতাও।
তবে বলে রাখি প্রণোদনা সাময়িক। সংবাদকর্মীদের দীর্ঘমেয়াদেও ভাবতে হবে। বেসরকারি টেলিভিশনের কেউই এখনও আইনের দৃষ্টিতে সংবাদকর্মী নন, কোম্পানির কর্মচারী মাত্র। গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরিবিধি সংক্রান্ত আইনটি না হলে এই আত্মপরিচয়ের গ্লানি দূর হবে না। কাজেই শুধু নগদের দিকে না হেঁটে পেশা ও নিজেদের মর্যাদার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন।
এইচআর/বিএ