স্থানীয় সরকারে নির্বাচিতদের সরকার যেন বরখাস্ত করতে না পারে


প্রকাশিত: ০৩:০৯ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০১৫

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সব পর্যায়ে দলীয়ভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এই পাঁচটি ধাপে স্থানীয় সরকার পরিচালিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হয়ে আসছে। এক পর্যায়ে নির্দলীয় কথাটি কাগজে কলমেই থেকে যায়। বাস্তবতা হলো স্থানীয় সরকারের সব ধাপেই দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন হয়ে আসছে।

যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো স্থানীয় নির্বাচনে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করে এবং দলীয়ভাবে মনোনয়ন দিয়েই নির্বাচনে অংশ নেয় তাই সরকারের ওই সিদ্ধান্তের একটি ইতিবাচক দিক হলো স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহিতা বাড়বে। আর স্থানীয় সরকারগুলোর প্রকল্পে দলীয় বিবেচনায় অর্থায়নের চিন্তা বাদ দিয়ে সরকার যদি কাজ করার সুযোগ দেয়, তাহলে প্রকৃত অর্থেই স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হবে, উন্নয়ন হবে, স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন মানে দেশেরই উন্নয়ন। দলীয়ভাবে নির্বাচনের আয়োজনের ওই নীতিগত সিদ্ধান্তের পক্ষে বা বিপক্ষে নানা যুক্তিতর্ক তুলে ধরা যাবে। সেগুলোর চেয়ে আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি বর্তমানে স্থানীয় সরকার আইনে আমলাদের দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের বরখাস্ত করার ক্ষমতা বাতিল করার বিষয়টি।

আমরা দেখেছি গত কয়েক বছরে সারাদেশে সিটি করপোরেশনের মেয়র, পৌরসভার মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরকারি আদেশে বরখাস্ত করা হচ্ছে। এই সুযোগটি সরকার নিচ্ছে আইনে বর্ণিত ধারাবলে। স্থানীয় সরকার যে পাঁচটি আইনে চলে সেগুলোতে বলা আছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হলে বা অপরাধ আমলে নিলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে চেয়ারম্যান অথবা সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারবে।

সরকার আইনের দোহাই দিয়ে গত দুই বছরে প্রায় দুশ জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে। বরখাস্তকৃতদের মধ্যে গাজীপুর, রাজশাহী ও সিলেটের মতো বড় সিটি করপোরেশনের মেয়ররাও রয়েছেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নির্বাচন আয়োজনের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ ভোট পেয়ে যে ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন সচিবালয়ে বসে প্রজাতন্ত্রের কোনো এক কর্মচারির আদেশে তিনি বরখাস্ত হয়ে যান। তার মানে জনগণের রায় সরকারের একটি আদেশেই বাতিল হয়ে যায়। সরকার কী নির্বাহী আদেশে জনগণের রায় বাতিলের ক্ষমতা রাখে?

আমরা দেখেছি বরখাস্তকৃত সব জনপ্রতিনিধিই বিরোধী রাজনৈতিক পরিচয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। প্রশ্ন ওঠেছে সরকার রাজনৈতিকভাবে ওই আইনের ব্যবহার করছে। কারণ বরখাস্তকৃতদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হলো- তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় গাড়ি ভাংচুর করেছে, আগুন দিয়েছে অথবা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করেছে।  এই সব অভিযোগ প্রমাণিত হলে যে কোনো জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা যেতেই পারে। কিন্তু প্রমাণ হওয়ার আগে শুধু আদালত আভিযোগ আমলে নিলেই তাদের বরখাস্ত করা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। স্থানীয় সরকার আইনে ওই ধারা থাকায় সরকার বিরোধীদের ক্ষেত্রে তা কাজে লাগাচ্ছে। তাই এধরনের আইনই থাকা উচিত না।

ভোটাররা প্রশ্ন তুলতেই পারে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে নির্বাহী আদেশে অপসারণের মধ্য দিয়ে তাদেরকে অপমানিত করা হচ্ছে। অথচ জাতীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও এভাবে মামলায় অভিযুক্ত করে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে এটা বলা যায় যে, এক দেশে দু`রকমের আইন চলছে। সংবিধানের ৬৬ (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী,‘একজন সংসদ সদস্যের পদ বাতিল হয় তখনই যখন তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কমপক্ষে দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর পার না হয়।’ অর্থাৎ জাতীয় সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে শুধু অভিযোগপত্রই যথেষ্ট নয়, তাকে দণ্ডিত হতে হবে। তাও কমপক্ষে দু বছর। আর স্থানীয় সরকারে নির্বাচিতদের ক্ষেত্রে শুধু অভিযোগপত্রে নাম থাকলেই সরকার আদেশ দিয়ে তাকে বরখাস্ত করতে পারে। স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের অপসারণের ওই সুযোগ স্পষ্টতই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী,‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। আবার ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী,‘মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন থাকতে পারবে না।’

মেয়র বা কাউন্সিলরদের শুধু মামলায় আসামি দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়ার বিধানটি ভোটারদের সঙ্গে প্রতারণামূলকই মনে হয়। তারা সরকারি কর্মচারি নন, জনপ্রতিনিধি। লাখ লাখ মানুষ তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। আর সরকার কোনো মামলায় আসামি করে চার্জশিট দিয়ে তাকে বহিষ্কার করার সুযোগ রেখেছে। আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে মিথ্যা মামলা দেওয়ার উদাহরণ হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। আদালত রায় না দেওয়া পর্যন্ত অন্তত সরকারের হাতে এই সুযোগ রাখা উচিত নয়। সরকার এর অপব্যবহার ঘটাতেই পারে এবং ঘটছে বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে।

সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী,‘নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার দেওয়ার লক্ষ্যেই’ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজন করা হয়। সে ভার নেওয়ার পর মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার আদেশে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিকে দোষী সাব্যস্ত না হয়েও বরখাস্ত হতে হয়। আইনের ওই বিধান বহাল থাকলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যের পাহারার মধ্যে, লাখ লাখ মানুষের মাসব্যাপী উৎসবের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই সরকার যখন এবার দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের আয়োজনের লক্ষ্যে আইনগুলো সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, আমরা আশা করবো শুধু অভিযোগ আমলে নেয়ার ভিত্তিতেই নির্বাচিত কাউকে যেন বরখাস্ত করা না যায় সেই সংশোধনীও আনা হবে।

pintu

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।