অনির্দিষ্টকালের লকডাউন ঘোষণা করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
‘বাবা তুমি কোথায়? বাসায় মাস্ক ফেলে গিয়েছ কেন? বাসায় কখন ফিরবে?’
ভাই, আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারি না। আমার কিছু হলে তিন বছরের ছেলেটার কী হবে! বউ পোলাপান নিয়ে গ্রামে চলে যাই। মরলে বাবা-মার কাছে গিয়ে মরি!’
প্রথম বাক্যটি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া আমার মেয়ের। দ্বিতীয়টি আমারই এক অনুজ সহকর্মীর। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজপোর্টালের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্বপালন করার সুবাধে নির্ভরযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন তৈরির জন্য নিত্যদিনই রিপোর্টারদের বিভিন্ন স্পটে পাঠিয়ে নির্দেশনা দিতে হয়।
কিন্তু সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় নিজের সন্তান ও অনুজ সহকর্মীর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর আমাকেও শঙ্কিত করে তুলেছে। গতকাল এক সংবাদকর্মীর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বাসায় বসে কাজের সুযোগ থাকলেও একজন পেশাদার রিপোর্টারের পক্ষে কি তা সম্ভব? যার নিত্যদিনের কাজই হলো স্পটে স্পটে ঘুরে অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করা, তার পক্ষে কি আর ঘরে বসে রিপোর্ট করা সম্ভব? তাই ঝুঁকি জেনেও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পেতে বেরোতে হচ্ছে।
কিন্তু করোনাভাইরাস আতঙ্ক সম্প্রতি জীবন যাপনের স্বাভাবিক রুটিন ওলট-পালট করে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রায় সব কার্যক্রম চলছে ভার্চুয়ালি। প্রধানমন্ত্রী কথা বলছেন ভিডিও কনফারেন্সে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবসহ স্বাস্থ্য সেক্টরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিন ব্রিফ করছেন অনলাইনে।
কিট সংকটের কারণে শুরুর দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আ্ইইডিসিআর) ল্যাবরেটরিতে স্বল্পসংখ্যক সন্দেহভাজনের পরীক্ষা করা হলেও বর্তমানে ১৮টি প্রতিষ্ঠানে করোনা শনাক্তে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
চলতি মাসের মধ্যে আরও ১০টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক। শুরুর দিকে হাতেগোনা কয়েকজন সন্দেহভাজনের নমুনা পরীক্ষা করা হলেও এখন প্রতিদিন শয়ে শয়ে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য রাজধানীসহ সারাদেশে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে আইসিইউ বেডসহ যাবতীয় প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। প্রবাসফেরত ও তাদের সংস্পর্শে আসা সম্ভাব্য ও নিশ্চিত করোনা আক্রান্তদের হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি রেখে যেমন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, তেমনি অনেককে নিজ বাড়িতে কিংবা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে (১৪ দিন) রাখা হচ্ছে।
দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয় থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত। সবাই বিশেষায়িত পার্সোনাল প্রটেকশন ইক্যুপমেন্ট (পিপিই) চাইছেন। স্বাস্থ্য মহাপরিচালক ও রোগ তত্ত্ববিদরা বলছেন, সবার জন্য বিশেষায়িত পিপিই প্রয়োজন নেই। জরুরি বিভাগ এবং অন্যান্য যেসব ওয়ার্ডে ডাক্তার, নার্স ও ওয়ার্ডবয়সহ অন্যান্য স্টাফ যারা সরাসরি করোনা রোগী নিয়ে কাজ করবেন, তাদের বিশেষায়িত পিপিই পরতে হবে। অন্যদের স্বাভাবিক মাস্ক ও গ্লাভস পরলেই চলবে।
কিন্তু এতেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না স্বাস্থ্যসেবকরা। কারণ এখানে যে চিকিৎসকদের দলাদলি ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অপব্যবসার পাঁয়তারাও রয়েছে। চিকিৎসকদের গ্রুপিংয়ের কারণে কেউ কেউ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য মহাপরিচালকসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এ গ্রুপটি- নাই নাই কিছুই নাই, এটা করা হয়নি, ওটা করা হয়নি- ইনিয়ে বিনিয়ে এসব খুঁত ধরতে ব্যস্ত। কেউ আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বাহবা দিয়ে বেড়াচ্ছেন- স্যার, যা করেছেন, আর কেউ অতীতে এমনটা করতে পারেননি।
একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী পিপিই সরবরাহের নামে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করছে। সাধারণ মানের পিপিইকে বিশেষায়িত বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায়ও লিপ্ত হয়েছেন। সত্যি কথা বলতে গিয়ে দুটি হাসপাতালের পরিচালককে বলির পাঠাও হতে হয়।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় গত ২৬ মার্চ থেকে প্রথমে ৪ এপ্রিল ও পরবর্তীতে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়। সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয় সবাইকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে মাঠে নিয়োজিত করা হয় সশস্ত্র বাহিনীকে।
সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে এখন পর্যন্ত দেশে সীমিত পর্যায়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবে, ওইদিন থেকে আজ ৪ এপ্রিল সকাল ৮টা পর্যন্ত ৭০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮ জন মারা গেছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩০ জন। বর্তমানে ২০ জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে এবং ১২ জন বাড়িতে চিকিৎসাধীন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ঘনবসতিপূর্ণ জনবহুল দেশ হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার। কিন্তু অত্যাবশ্যক প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হতে মানা করলেও সাধারণ মানুষ তা মানছে না, যা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাছাড়া আজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখা গেছে, ছুটির সময় গ্রামে চলে যাওয়া হাজারো মানুষ রাজধানীতে ফিরে আসছেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও পণ্য বহনের ট্রাক কিংবা অন্য কোনো জরুরি সেবার আওতাধীন যানবাহনে করে ফিরে আসছেন তারা। বিশেষ করে পোশাক কারখানা আগামীকাল থেকে খুলবে, এমন নির্দেশনায় ওই কারখানাগুলোর কর্মীরা দলে দলে ফিরে আসছেন।
এ মুহূর্তে কোনো ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা ছাড়া পোশাক কারখানাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ আক্রান্ত অঞ্চলসমূহের অনেকগুলোতে শুরুর দিকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কম থাকলেও ওই সময় লকডাউন ঘোষণা না করায় এখন প্রতিদিন হাজার হাজার আক্রান্ত বাড়ছে। ঘটছে শত শত মৃত্যুর ঘটনা। বাংলাদেশেও এমনটি হওয়ার জোর আশঙ্কা তৈরি।
আপাতদৃষ্টিতে অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সীমিত পর্যায়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। মড়ক লাগলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো তখন সব কিছু লকডাউন করতে হবে । কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যাবে, যা বর্তমান বিবেচনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়ে অনেক বেশি হবে।
তাই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন, অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করুন। শুধু তাই নয়, অত্যাবশ্যক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের নামে রাস্তাঘাটে মানুষের অবাধ চলাচল বন্ধ করুন। এজন্য কঠোর হওয়ার প্রয়োজন হলেও তা হতে বলুন। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য স্থান নির্ধারণ করে দিন। দেশের শিল্পপতিদের মাধ্যমে দুর্যোগকালীন তহবিল গঠন করুন। শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতিসহ হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখতে বলুন। দুর্যোগকালীন কত হাজার ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য সহযোগী স্টাফ রোগীদের সেবা দেবেন তার তালিকা প্রস্তুত করে পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এখনো যদি সঠিক প্রস্তুতি না নেই, তাহলে এমন সময় আসতে পারে করোনায় কলেরার মতো লাশের সারি বাড়তে থাকলে হাসপাতাল ছেড়ে পালাতে পারেন সেবাকর্মীরা।
লেখক
বিশেষ সংবাদদাতা ও প্রধান প্রতিবেদক
জাগোনিউজ২৪.কম
এইচএ/এমকেএইচ