করোনাকালে হাসপাতাল: একটি অভিজ্ঞতা
এক.
শুরুতেই বলে নিচ্ছি, ব্যক্তিবিশেষের চরিত্রহনন বা কাউকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে এই লেখা নয়। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা কেমন চলছে, তার একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরাই এই লেখার লক্ষ্য।
আরও বলতে চাই যে, আমাদের চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অবশ্যই বিশ্বমানের। এইতো কয়েক দিন আগে আমাদের একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী হেপাটাইটিস বি-এর মতো দুরারোগ্য ব্যাধির ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। গর্ভের সন্তানের থ্যালাসেমিয়ার মত কঠিন রোগ নির্ণয়, নিঃসন্তানের ঘর কচিকাঁচার হই-হুল্লোড়ে মুখরিত করে তোলার মতো চিকিৎসা দিচ্ছেন অনেক চিকিৎসা গবেষক। এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে আমাদের দেশীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ঈর্ষণীয় অগ্রগতি সম্পর্কে।
আমার কন্যার চোখের ট্রিটমেন্টের জন্য মাঝে মধ্যে আমি ভারতের চেন্নাইতে যাই। ‘কলা বেচা আর রথ দেখা’র মত সেখানে আমরা পরিবারের অন্য সদস্যরাও হালকা চেকআপ করি। সাংবাদিক হওয়ার কারণে মনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সবসময়ই প্রশ্নের উদ্রেক হয়ে থাকে। ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। চেন্নাই গিয়েও আমার তেমনটি হয়। আমার দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা সম্পর্কে ওখানকার চিকিৎসকের সঙ্গেও আমার দু’চারবার আলোচনা হয়েছে।
ওখানকার ডাক্তারদের বক্তব্য হচ্ছে, তোমাদের ডাক্তাররা আমাদের চেয়েও মেধাবী। সরল ভাষায় বললে, তোমাদের ডাক্তাররা আমাদের চেয়েও ভালো। তোমাদের বিভিন্ন টেস্টের মেশিনারিজও আমাদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো। কারণ, টেস্টের মেশিনারিজ আমদানির ক্ষেত্রে আমাদের যে সব বিধিনিষেধ মোকাবেলা করতে হয়, তা তোমাদের ক্ষেত্রে নেই।
কিন্তু তোমাদের সমস্যা দুটি। এক. তোমাদের ডাক্তারদের অনেকে রোগীকে পর্যাপ্ত সময় দেন না; দুই. তোমাদের টেকনোলজিস্টরা তুলনামূলক কম দক্ষ। ডাক্তারের যথাযথ ট্রিটমেন্ট দেয়ার ক্ষেত্রে টেকনোলজিস্টদের ভূমিকা অন্যতম। টেস্টের রিপোর্ট যদি যথার্থ না হয়, তাহলে পরামর্শ যথাযথ হবে না। এখানেই তোমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রথম দুর্বলতা।
দুই.
জনপ্রিয় এই অনলাইন পত্রিকার পাঠকের তালিকায় দেশের অনেক চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী আছেন। দয়া করে আপনারা মাইন্ড করবেন না। যদি ইতিবাচকভাবে নেন, তাহলে আমার এ লেখা আপনাদের জন্য একটা চিন্তার খোরাক হতে পারে বলে বিশ্বাস করি। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের জন্য একটা দৃষ্টান্তমূলক ইনফর্মেশনও হতে পারে এটা। একজন পেশাজীবী হিসেবে, আরেকজন পেশাজীবীকে বা আরেকটা পেশাকে হেয় করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
তাছাড়া আমার পেশাটাই হলো, সমাজের অসঙ্গতি আর সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা, এজন্য যে, যাতে তা সংশোধিত হয়। আমার মতের সঙ্গে আপনাদের মতে অমিল থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ একই বিষয়ে, আপনি বা আপনারা দেখছেন আপনার অবস্থান থেকে, আর আমি দেখছি আমার অবস্থান থেকে। ইংরেজি হরফের সংখ্যা, যেটা আমার অবস্থান থেকে সিক্স, আপনার অবস্থান থেকে সেটা নাইন। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো আমরা উভয়েই সঠিক। এ নিয়ে বিতর্ক না করে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আমরা যদি সংখ্যাটির বার্তাটা অনুধাবনের চেষ্টা করি, তাহলে আর বিতর্ক থাকে না।
তিন.
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। বুধবার (১ এপ্রিল, ২০২০) থেকে আমার গলার নিচের অংশ ব্যথা করছে। বাইরে থেকে হালকা চাপ দিলে ব্যথাও অনুভূত হয়।
আমি থাইরয়েডের রোগী। দু’বছর ধরে এ রোগের ওষুধ নিচ্ছি। একটা সময়ের ব্যবধানে টিএসএইচ টেস্ট করার ব্যাপারে আমাকে ডাক্তারের পরামর্শ দেয়া আছে। টেস্ট দেব, এজন্য ৮-৯ দিন ধরে থাইরক্সিন খাচ্ছি না।
আমার সর্দি-কাশি নেই। জ্বর নেই। তাই গলা ব্যথার হেতু জানতে আজ গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগে।
বিভাগে যাওয়ার আগে উপাচার্য মহোদয়ের দফতর থেকে ফোন করিয়ে যাই। ফোনটা এজন্য করাই যে, ভেতরে একটা আশঙ্কা ছিল, বিপাকে পড়তে পারি। ক’দিন ধরে শুনছি, গলা ব্যথা, সর্দি-কাশির রোগী হলে ডাক্তারের দেখা মেলে না, চিকিৎসা মেলে না।
আমি বিপাকে পড়িনি, তবে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা শেয়ার করছি।
আমি যাওয়ার পর বিভাগের সাপোর্টিং স্টাফ (পিয়ন) জানতে চাইলেন, আমি কোথা থেকে এসেছি বা কে পাঠিয়েছে? প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমি তার কাছে জানতে চাই, আপনাদের বিভাগে রোগীর পরামর্শ কর্নার কোন দিকে?
তিনি জবাব না দিয়ে কিছুটা রাগতস্বরে ফের জানতে চান, আমাকে কে পাঠিয়েছে।
তখন আমি উপাচার্য মহোদয়ের দফতরের সেই কর্মকর্তার নাম বললাম যিনি ফোন করে আমাকে পাঠিয়েছেন। এরপর ওই সাপোর্টিং স্টাফ একটু হেসে বলেন, বলবেন না, এটাই তো জানতে চাই!
তারপর তিনি সমস্যা জানতে চাইলেন। ভাবলাম, ডাক্তার হয়তো আগে থেকেই ব্রিফ করে রেখেছেন, সন্দেহজনক রোগী কিনা আগেভাগে জানতে হবে। তাই ডাক্তার না হওয়া সত্ত্বেও এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে (সাপোর্টিং স্টাফ) সমস্যা বললাম।
কেচি গেটের বাইরে রেখে ভেতর থেকেই তিনি আমার সাথে কথা বললেন। এরপর বাইরে দাঁড়াতে বলে ভেতরে গেলেন। ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন, জ্বর, কাশি ইত্যাদি আছে কি-না।
আমি হেসে দিয়ে বললাম, জ্বর, কাশি, সর্দি কিছুই নেই। আমার ব্যথাটা গলার নিচের অংশে।
ভেতরে গিয়ে ফিরে এসে সাপোর্টিং স্টাফটি কেচি গেটের বাইরে একটি বেঞ্চি দেখিয়ে বললেন, এখানে বসেন। স্যার এখন বিজি। ফ্রি হয়ে আপনাকে দেখবেন।
কিছুক্ষণ পরে শুনতে পাচ্ছি, ভেতরে বলাবলি চলছে, একজন সাংবাদিক এসেছে। গলা ব্যথা নিয়ে। তখন কেউ একজন (সম্ভবত সেই স্যার) সাপোর্টিং স্টাফটিকে বলছেন, জিজ্ঞেস করো কোন পত্রিকার?
আমার গলায় পত্রিকার নাম-লোগো সম্বলিত বেল্ট ছিল। হয়তো লোকটি তা খেয়াল করেনি। আমি মুখে পত্রিকার নাম বললাম।
(আমি সাধারণত পত্রিকার বেল্ট পরি না। নিজের অধিক্ষেত্র ছাড়া অন্যত্র সাংবাদিক পরিচয় দেই না। আজকে রাস্তায় সেনাবাহিনী থাকবে, আগের চেয়ে বেশি কড়াকড়ি হবে- এসব কারণে অনেক খোঁজাখুঁজি করে বেল্ট বের করে আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে বের হয়েছিলাম)।
পাশাপাশি লোকটি আবার জানতে চাইলেন (এটা তৃতীয় বার), আমার সমস্যা সম্পর্কে। এরপর তিনি আবার সেই স্যারের কাছে চলে গেলেন। আমি মজা পাইলাম।
কয়েক মিনিট পর ভেতর থেকে একজন ফিমেল জুনিয়র ডাক্তার এলেন। তিনি এসে সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি আবার বললাম। জ্বর, সর্দি, কাশি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। বললাম এসব নেই।
এরপর তিনি জানতে চাইলেন, পুরনো কোনো কাগজপত্র বা হাসপাতালের টিকেট নিয়ে এসেছি কি-না। বললাম না, আনা হয়নি। তবে গত ১১ মার্চ দেয়া স্যাম্পলের টেস্টের একটা রিপোর্ট নিয়ে এসেছি, যা এখনই ডেলিভারি নিয়ে আসলাম।
ডাক্তার কিছুটা অনুচ্চস্বরে শব্দ আওড়ালেন, ‘কাগজপত্র আনেননি, স্যার কী দেখবেন? জানি না।’
এরপর তিনি সেই স্যারের কাছে গেলেন। মিনিটখানেক পর বেরিয়ে এলেন। আমি তখনো কেচি গেটের বাইরেই আছি। ওই জুনিয়র ডাক্তার আমাকে ফের খুঁজলেন। এবার সাপোর্টিং স্টাফটির আহ্বানে আমি কেচি গেটের ভেতরে ঢুকলাম।
ডাক্তার ম্যাডাম জানতে চাইলেন, আমার ভিজিটিং কার্ড আছে কি-না। হ্যাঁ, বলে বের করে দিলাম। কার্ডটি দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমাকে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন।
আমি এ জুনিয়র ডাক্তারের নাম জানতে চাইনি, ওই স্যারের নামও জানতে চাইনি। এমনকি সাপোর্টিং স্টাফটির নামও নয়। এর অন্যতম কারণ, অনাকাঙ্ক্ষিত কোনোপরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়।
কারণ, আমার অভিজ্ঞতা হলো, কোনো পরিবেশে, যেখানে ব্যক্তি বা কর্তারা অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি করেন, সেই জায়গাটা যদি নিজের অনুকূলের হয়, তাহলে তিনি নিজের ত্রুটি ঢাকতে ও জয়ের জন্য সার্বিক চেষ্টা করেন। পাশাপাশি এমন অবস্থা তৈরি করেন যাতে আগন্তুক হেনস্থা হয়।
আমি ভাবছি- বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের দফতর থেকে ফোন করিয়ে গেলাম, আমার পরিচয়ও তারা জানলেন, আমি করোনায় আক্রান্ত নয়- এরপরও স্যারের দেখা পেলাম না!
চার.
ওখান থেকে বের হওয়ার পর থেকে ভাবছি, মানুষ কি এতটাই অচ্ছুৎ হয়ে গেল? যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন ডিউটিতে, তার সময়টা তো নাগরিকের জন্যই হওয়ার কথা এবং হয়তো আমার (রোগী) জন্যই তিনি বসে আছেন। তাহলে কেন তার দেখা পেলাম না? অথবা তিনি কার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন? কর্তৃপক্ষকে দেখাতে যে, তিনি কর্মস্থলে হাজির আছেন?
পাঁচ.
আবারো বলতে চাই, আমার এই লেখা কোনো ব্যক্তিবিশেষকে বিব্রত করার জন্য নয়, কিংবা কোনো কমিউনিটির বিরুদ্ধে নয়। তাহলে আমি সংশ্লিষ্টদের নাম জেনে আসতাম।
আমিও একটি কমিউনিটির সদস্য। আমার কমিউনিটির সব সদস্যের সার্ভিস যে ‘আপ টু দ্যা মার্ক’, তা নয়; এমনকি আমার সার্ভিসও যে জনগণের চাহিদা মতো, তা না-ও হতে পারে। কিন্তু সার্ভিসের মূল স্পিরিটের সঙ্গে কোনো সাংবাদিকের এ ধরনের আচরণ আছে বলে আমার জানা নেই।
ছয়.
একটা বিষয় হচ্ছে, শিক্ষা, চিকিৎসা, সাংবাদিকতা- ইত্যাদি কোনো পেশা নয়, সেবা। আমিতো জেনেশুনেই বিষ পান করেছি। ঘূর্ণিঝড়, দুর্বিপাক, মহামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত-সংঘর্ষ ইত্যাদির মধ্যে একজন সাংবাদিককে দায়িত্ব পালন করতে হবে- সেটা জেনেই একজন ব্যক্তি সাংবাদিকতায় আসেন। কিন্তু সংঘাত-সংঘর্ষের অ্যাসাইনমেন্ট দিলে কোনোসাংবাদিক যদি বলেন, নাহ, আমি যাব না। আমার পিঠে পুলিশের লাঠি কিংবা মাথায় বিক্ষোভকারীদের ইট পড়তে পারে, তাহলে কি সেটা সাংবাদিকতার পেশাজীবীর মত রেসপন্স হবে?
সাত.
আমাদের সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। ‘সবার উপর মানুষ সত্য’- এই অনুধাবন প্রোথিত হোক আমাদের মাঝে। পেশার প্রতি সু-আচরণ যেন সবাই করি, রইল এ প্রত্যাশা।
লেখক
মুসতাক আহমদ
সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক যুগান্তর
এইচএ/এমকেএইচ