আসুন, মানুষের কথা ভাবি
শেখ মামুনুর রশীদ
সবাই বলি, কথায় কথায় বলি। দাবিও করি আমরা মানুষ। আমরা স্বভাবতই মানুষকে নিয়ে বেশি ভাবি। দিন শেষে মানুষ আসলেই একা। তবুও একলা মানুষ বাঁচতে পারে না। একলা মানুষ থাকতে পারে না। মানুষ তখনই একা থাকে, যখন সে নিঃসঙ্গ থাকে। দুঃখ, কষ্ট আর হতাশায় ভোগে। দিন শেষে সব ভুলে মানুষই আবার মানুষের মোহনায় মেলে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই মানুষ পুরোপুরি একা হয়ে গেছে। থেমে গেছে প্রাণের আড্ডা। জাগতিক নিয়মের সবরকম কলাকৌশল থমকে গেছে। থমকে আছে- করোনা নামের এক মহারণের ধাক্কায়। আগে মানুষ ঘরে আশ্রয় নিত গুলির হাত থেকে, বোমার আঘাত থেকে জীবন বাঁচাতে। এখন গুলির শব্দ নেই। বোমার গর্জন নেই। তবুও মানুষ ঘরে- করোনার ভয়ে।
পুরো পৃথিবী থমকে অাছে। পৃথিবীর মানুষ থমকে গেছে। সচল পা অচল মুদ্রার মতো আটকে আছে শঙ্কায়, মূল্যহীনভাবে। মানুষ নতুন করে তা আবার শিখতে-ভাবতে শুরু করেছে। সাগর, নদী, পাহাড়- সব শক্তির কাছে মানুষ আজ পরাজিত। মানুষ আজ বড্ড বেশি অসহায় প্রকৃতির নির্মমতার কাছে।
অথচ এই মানুষই, যারা কিছুদিন আগেও রোবট বানিয়ে উল্লাস করেছে। নতুন নতুন আবিষ্কারে পুলকিত হয়েছে। সৃষ্টি, ধ্বংস ও বিনির্মাণে সুখী হয়েছে। আহ্লাদিত হয়েছে। বড়াই করেছে দম্ভের সঙ্গে। করোনা তাদের অসহায়ত্বের ফাঁক-ফোঁকড় পুরোপুরি উন্মোচন করে দিয়েছে।
আজ চারদিকে মৃতের সারি, অসহায় মানুষের দীর্ঘলাইন। চাপাকান্না, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। ঘরে ঘরে আজ বেঁচে থাকার করুণ আর্তি।
করোনা- নয়া এক রসায়নের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা নেই। ওষুধ নেই। হাসপাতালে ঠাঁই নেই। খাবার নেই। মৃত্যুর পর সৎকার নেই। আপনজন পাশে নেই। পুরো পৃথিবী এখন ভুতুড়ে পল্লী। পৃথিবীজুড়ে কেবল হাহাকার। যার আছে সব- হাহাকার তারও। যার ভাণ্ডার শূন্য- হাহাকার তারও।
এই প্রথম লড়াই হচ্ছে করোনা নামের এক ভয়ার্ত জীবাণুর বিরুদ্ধে ধনী-গরিব একসঙ্গে। এই প্রথম জীবাণু অস্ত্রের জন্মদাতারাও হিমশিম খাচ্ছে। এই প্রথম তেল-গ্যাস লুটেরা, ধর্ম ব্যবসায়ী, বণিক শ্রেণি নেমে এসেছে এক কাতারে। গাজা থেকে সুয়েজ খাল, সোমালিয়া থেকে আমেরিকা, সবখানে জীবনের রং মানে কেবলই ভয়ার্ত মুখ।
তবুও শেষ হাসি হাসবে মানুষই। ঘুরে দাঁড়াবে আবার মানুষই। পৃথিবীকে নয়ারূপে সাজাবে আবার মানুষই। নতুনের জয়গান গাইবে আবার মানুষই। এটাই মানুষের শক্তি।
কিন্তু এবার এমন মানুষ চাই, যারা মানুষের কথা ভাববে। ধ্বংসস্তূপের মাঝ দিয়ে গড়ে ওঠা নয়াজীবনের পাঠশালায় এমন মানুষ চাই, যারা মানুষের কথা ভাববে। যুদ্ধ বন্ধ হবে। দেশদখল বন্ধ হবে। কেউ ঘরবাড়ি হারা হবে না। শরণার্থীর তালিকায় নাম লেখাবে না। সমুদ্রতীরে পড়ে থাকবে না শিশুর মৃতদেহ। মারণাস্ত্রের খেলা বন্ধ হবে। মানুষের কল্যাণে সব পথ মিলবে এক মোহনায়।
আসুন, অন্তত এ যাত্রায় উতড়ে গেলে, এবারের ক্ষত সেরে গেলে, মানুষের কথা বলি। মানুষের কথাই ভাবি।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
সদস্য- পরিচালনা পর্ষদ, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)
এবং নির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।
এইচআর/বিএ