আমরা কবে স্বেচ্ছায় আইন মানবো?
সারাবিশ্বে করোনা নামক যে ভয়ঙ্কর ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আঘাত হেনেছে, কেড়ে নিচ্ছে হাজারো মানুষের প্রাণ। বিশ্বজুড়ে আজ মৃত্যুর মিছিল শুধু দীর্ঘই হচ্ছে, থমথমে হয়ে পড়ছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জনাকীর্ণ লোকালয়। জিংজিয়ান, উহান, সাংহাই, সানফ্রান্সিসকো, ফ্লোরিডা, ওকলোহামা, লসএঞ্জেলস, ইলিনয়, দিল্লি, কলকাতা, লন্ডন, নিউইয়র্ক, রোম, মিলান, ভেনিস, ওয়াশিংটন, কাঠমান্ডু, এথেন্স, প্যারিস, সিঙ্গাপুর, হংকং, কুয়ালালামপুর, মক্কা, মদিনা, জেদ্দা, বাগদাদ, তেহরান, কেপটাউন, প্রিটোরিয়া, হেগ, ভিয়েনা, অসলো, স্টকহোম, গোথেনবার্গ, মন্ট্রিল, কুইবেক, টরেন্টো, অটোয়া, লুক্সেমবার্গ, ইস্তাম্বুল, মুম্বাই, মহারাষ্ট্র, জাকার্তা, লিমা, কায়রো, কলম্বো, বুদাপেস্টসহ পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর ও প্রদেশ আজ থমথমে হয়ে গেছে।
জনাকীর্ণ এ জনপদগুলো যেন জনমানবহীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। সমগ্র বিশ্বব্যবস্থায় আজ একটি অচলাবস্থা। ঘোষিত এবং অঘোষিত লকডাউন। প্যারিসের রাস্তাঘাটে সুনসান নীরবতা, একটি প্রাণীও দেখা যাচ্ছে না। অথচ যে শহর মানুষে গিজগিজ করে সবসময়। ভেনিসের বাণিজ্য নগরী যেন জনশূন্য। ভেনিসের খালগুলো স্বচ্ছ সেখানে এখন মাছও দেখা যায়। নিউইয়র্কের মতো ব্যস্ত নগরী থমকে গেছে। এ কোন শূন্যতা এনে দিল করোনাভাইরাস। চীনের ব্যস্ততম বাণিজ্যিক শহর উহান এখন ভূতের শহর। লুক্সেমবার্গ আজ লোকশূন্য। ঝকঝকে লন্ডন যেন একটি অসহায় নগরী। লন্ডন ব্রিজে আর জনসমাগম। প্রথমে চীন থেকে শুরু করে একে একে এখন বিশ্বের প্রায় ১৮৭টি দেশে আঘাত হেনেছে করোনা। অবশেষে আমাদের প্রাণের জন্মভূমি বাংলাদেশেও। এ পর্যন্ত দুজনের মৃত্যুর খবরও নিশ্চিত করেছে দেশের গণমাধ্যম।
জনস্বার্থে ও মরণঘাতী এ ভাইরাস রুখতে দেশের জনগণকে সংক্রমণমুক্ত রাখতে প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদফতর, আইইডিসিআর মহাপরিচালকসহ সকল পর্যায়ের চিকিৎসক ও গবেষক জনসমাগম এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিয়েছেন। সকল মিডিয়ায় একই তথ্য প্রচারণা করা হচ্ছে। অথচ বাঙালি নির্বিকার ও নির্লিপ্ত। কে শোনে কার কথা? আইন মেনে চলার কোনো প্রবণতা বাঙালির কোনোকালে ছিল না, থাকবেও না হয়তো। এ জাতিকে দড়ি দিয়ে বেঁধেও আইন মানাতে শেখানো সম্ভব নয়। বাঙালি কোয়ারেন্টাইন, স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইন, হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন নামক উচ্চমার্গীয় কথাবার্তা বোঝে না, বুঝতেও চায় না। বাঙালি বোঝে কারফিউ, ১৪৪ ধারা, লাঠিচার্জ আর মাইর। মাইরের ওপর কোনো ওষুধ নেই।
আমরাই সরকারকে বাধ্য করি সে পথে যেতে। কী আজব একটা জাতি আমরা। নিজেরা সচেতন হই না অথচ বসে বসে অন্যের সমালোচনায় মুখর হই। প্রবাদে আছে- ভাইয়ের শত্রু ভাই, মাছের শত্রু চাঁই। আমরাই আমাদের এ সর্বনাশটা করেছি। এখন ধীরে ধীরে লাশের মিছিল বড় হবে। মৃতুর মিছিলে নির্বিকার হাহাকার আর অরণ্যে রোদন কেউ শুনবে না। একটা মানুষকে কথা শোনানো যায়নি। লাঠিপেটা করেও না। ছলেবলে কৌশলে, চুরি করে, পলায়ন করে, ওয়াল টপকিয়ে, জানালার গ্রিল ভেঙে অদম্য, অদমনীয় প্রবাসী বাঙালি বীর জওয়ানরা এদেশের মানুষের সংস্রবে প্রবেশ করেছে। কী দরকার ছিল এ ভুতুড়ে আবেগ। এ সংস্রবতো বাঙালির ১২টা বাজিয়ে ছাড়বে। বাঙালির মাশুল দিতে হবে তিলে তিলে।
এমনিতেই আমাদের ক্যাপাসিটি কম, চিকিৎসাব্যবস্থা দুর্বল ও ভঙুর। জনসংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত ও ঘনবসতিপূর্ণ। কেউ সচেতন না এই দেশটা নিয়ে। যে যেভাবে পারছে মনগড়া চলছে। আর যারা চিল্লাচ্ছে, ছুটছে তাদের আমরা পাগল বলছি। মানুষের নির্লিপ্ততা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এহেন জাতীয় ও বৈশ্বিক দুর্যোগেও মানুষের বিলাসিতার ঢং কমে না। বাড়ছে ঘোড়ারোগও। এত বড় জাতীয় মহামারির সময়ও কেমন করে মানুষ ঘটা করে বিয়ের আয়োজন করে। খোদ ঢাকার ধানমন্ডির সভ্যপাড়ার ফোর সিজন রেস্তোরাঁর পার্টিও সেখানকার সুযোগ্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ধানমন্ডি থানার এসিল্যান্ড রবিউল ইসলাম কর্তৃক মোবাইল কোর্ট করিয়ে বন্ধ করাতে হয়েছে। চাঁদপুর সদরের কল্যাণপুর ইউনিয়ন পরিষদে বিদেশফেরত ছেলের ঘটা করে জনসমাগম করে বিয়ের আয়োজন বন্ধ করেন চাঁদপুর সদর উপজেলার সুযোগ্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কানিজ ফাতিমা।
এ দুটো রেফারেন্স ছাড়াও দেশের অলিতে গলিতে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় এমন আরও অনেক জনসমাগমের পার্টি, মজমা, মহরত ও মাহফিল আয়োজিত হয় যা সরকারি উদ্যোগে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন দ্বারা বন্ধ করতে হয়েছে। কেন? বাঙালি কি কারফিউ ছাড়া, জরুরি অবস্থা, ১৪৪ ধারা ছাড়া কথা শুনবে না? রাষ্ট্রের আদেশ মানা কি নাগরিক দায়িত্ব নহে? কেন আমরা আজও এত বর্বর? স্বয়ং সৌদি সরকার যেখানে মক্কা ও মদিনা শরিফে জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, সেখানে আমরা কেন সামান্য একটু সেলফ কন্ট্রোল করতে পারি না।
ভয়াবহ এ মহামারির করাল গ্রাস থেকে বাঙালিকে এখন কে বাঁচাবে। তাতে করে জ্যামিতিক হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। দুই থেকে চার, চার থেকে আট, আট থেকে ষোল, ষোল থেকে বত্রিশ… এভাবে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা কয়েক হাজারে পরিণত হতে বেশিদিন লাগবে না যদি না আমরা সতর্ক হই। দেশটা নিয়ে ভাবুন, জাতিকে নিয়ে ভাবুন, শুধু নিজেকে নিয়ে নয়। মনে রাখবেন, আজকের দূরত্বই হয়তো বা আগামী দিনের কাছে আসার পথ সুগম করবে। আর আজকের অপ্রতিরোধ্য নৈকট্য হয়তো বা শেষ করে দিতে পারে গোটা জাতির সু্খের বুনিয়াদ।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতাই কেবল এনে দিতে পরে সুন্দর-সুশৃঙ্খল নাগরিক জীবন। হ্যাঁ, আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে, আছে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোগত দুর্বলতা। তবে এর মাঝেই সংকট মোকাবিলা করতে হবে আমাদের ঐক্য ও সংহতি দ্বারা। আমরা যদি দেশ স্বাধীন করতে পারি, আমরা যদি ভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে ইতিহাস রচনা করতে পারি, তবে কেন এ সংকট মোকাবিলা করতে পারব না। এটা তো কোনো আন্দোলন নয়, কোনো যুদ্ধ নয়। এটা শুধু একটা কঠিনতম পরীক্ষা, ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সরকারের আদেশ মেনে চলা। এইটুকু ফরমায়েশ সীমিত সময়ের জন্য আমরা কেন মানতে পারব না? কম্প্লায়েন্স, প্রয়োজনীয় সঙ্গতিপূর্ণ সংহতি।
আমি অবাক হই। এখনও বাঙালি ভাবলেশহীন। কোনো সতর্কতা নেই। মনে হয় যেন করোনা শুধুই আতঙ্ক অথচ কোনো সতর্কতা বলতে নেই কারও মাঝে। অথচ সরকার বারবার বলছে আতঙ্কিত নয়, সতর্ক হোন। হ্যাঁ পরিবর্তন এসেছে, শুধু বাজার ব্যবস্থাপনায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি। বাজারগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। মুদি দোকোনগুলোতে লোকের ভিড়ে দোকানদারদের পোয়াবারো। ৩০ টাকার পেঁয়াজ আজ ৭০ টাকা। তন্নতন্ন করে খুঁজে স্যাভলন, ডেটল, হ্যাক্সিসল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাওয়া যাচ্ছে না। ৪০ টাকা দামের হ্যাক্সিসল এখন ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৩০ টাকার মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। শুধু এইটুকুই বাঙালি জাতির মাঝে পরিবর্তন।
রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলার মাঝেই রাষ্ট্রে শান্তি ও শৃঙ্খলা আনয়ন সম্ভব। করোনা মোকাবিলায় সরকারের প্রতিটা নির্দেশ যদি বাঙালি যথাযথভাবে মেনে চলতো তাহলে হয়তো বা এ ভাইরাসটি রাষ্ট্রে এতটা ছড়াতো না। এখন তা মোকাবিলায় জনগণের সাহায্য অতীব প্রয়োজন। জনগণের তা স্বেচ্ছায়, সানন্দে, স্ব-প্রণোদিত হয়ে করা উচিত। এটা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। জনসমাগম এড়িয়ে চলা, স্বেচ্ছায় নিজেদের শারীরিক অবস্থা বুঝে সেলফ কোয়ারেন্টাইনে থাকা, এলোপাতাড়ি ঘুরে না বেড়ানো, অন্যের ক্ষতি না করা, নিজের পরিচিত মহলের সবাইকে সতর্ক করা, নিজে সাবধান থেকে অন্যদের সাবধান করা- এগুলো আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। অথচ আমরা করছি তার উল্টোটি।
বিদেশফেরত লোকগুলো অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রেখে অবাধে লোকসমাগমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর তার বা তাদের সংস্পর্শে আসা লোকগুলো প্রথমে নিজেরা আক্রান্ত হচ্ছে, অতঃপর তাদের থেকে আবার অন্য কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এভাবে ধীরে ধীরে গোটা দেশ ছড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ ভয়ে করোনা পজিটিভ তথ্য গোপন করছে। অনেকে পরীক্ষাই করাচ্ছে না। কিন্তু এর শেষ কোথায়? চীন তো একটা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, বাঙালি কী করবে? প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশ এবং আয়তন সীমিত ও অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে সংক্রমণের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এখনও গণপরিবহনে কোনো জীবাণুনিরোধক ব্যবহার করা হচ্ছে না, বাস-ট্রেনগুলো উপচেপড়া যাত্রী নিয়ে ছুটছে। কোনো নিষেধাজ্ঞার বালাই নেই। আর মানুষও ছুটছে।
সরকার ইতোমধ্যেই দেশের সকল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টার আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে শুধু জনসমাগম ও লোকজমায়েতের কারণে হিউম্যান টু হিউম্যান ডিরেক্ট কন্ট্যাক্ট ও ট্রান্সমিশন এড়াতে। তবুও আমরা দিব্যি আড্ডা দিচ্ছি, মজমা করছি, পার্টি দিচ্ছি, বাজারে সমবেত হচ্ছি, লোকসমাগমের স্থানগুলোতে আজও লোকে লোকারণ্য। আমাদের চৈতন্যবোধ কবে জাগ্রত হবে? কবে আমরা মানুষ হব? কবে আমাদের সভ্যবিবেক জাগ্রত হবে? আমাদের বোধোদয় কি হবে না কোনোদিন? কবে আমরা নিজ থেকে রাষ্ট্রের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব? আসুন না বিধিমালা মেলে একসঙ্গে জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা করি?
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ