সাংবাদিকতা : বাউফল থেকে কুড়িগ্রাম

মুসতাক আহমদ
মুসতাক আহমদ মুসতাক আহমদ , সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক যুগান্তর
প্রকাশিত: ০২:৪২ পিএম, ২০ মার্চ ২০২০

এক. ইতালিয়ান রেনেসাঁর অন্যতম রূপকার দার্শনিক মেকিয়াভেলি তার বিখ্যাত দ্য প্রিন্স গ্রন্থে বলেছেন, son can bear with equanimity the loss of his father, but the loss of his inheritance may drive him to despair (আমার কাছে এ কথার অনুবাদ হলো, মানুষ তার পিতার খুনিকে মাফ করে, কিন্তু পিতার সম্পদ লুণ্ঠনকারীকে মাফ করে না)।

এ কথার অর্থ হচ্ছে, নিজের জন্মদাতার চেয়েও সম্পদ বা অর্থ মানুষের কাছে অনেক বড়। পিতা থাকুক বা না থাকুক সেটা বড় কথা নয়, ভালোবাসি তার অর্থ। অর্থ থাকলেই চলে। এ কথার সঙ্গে হয়তো অনেকেই একমত পোষণ করবেন না। কারণ এমন মানুষও তো আছে যাদের বিত্ত-বৈভবের প্রতি লোভ তেমন নেই। সমাজ-সংসার বিমুখ বহু সাধক আমরা ইতিহাসে পেয়ে থাকি।

শুধু ইতিহাসেইবা বলছি কেন, এই সময়েও হয়তো এমন অনেক লোক আছেন, যারা সৎ ও নির্লোভ। অর্থের মোহ তাদেরকে অন্ধ বানায় না। তবে, অবক্ষয়ের ঊর্ধ্বমুখীতার এই সময়ে অর্থের পূজারী লোকের সংখ্যা যে দিন দিন বাড়ছে! নীতি-নৈতিকতা, আইন, সামাজিক রীতি ইত্যাদি অনুশাসনের বালাই নেই এ ধরনের লোকের কাছে।

যে কোনো উপায়ে বিত্তবান হওয়া বা অর্থ উপার্জন তাদের ব্রত। অর্থ উপার্জনের ধারা নির্বিঘ্ন রাখতে তারা হেন কোনো কাজ নেই যা করেন না।

দুই. সম্ভবত ২০০৫ সালের কোনো একদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'টি হলের ছাত্রদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। ওই ঘটনায় ছাত্রদলের বেশ কিছু নেতাকর্মী আহত হয়। আমি তখন দৈনিক যুগান্তরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার। ডাকসু কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গোয়েন্দা সংস্থার এক অফিসার আমার কাছে জানতে চাইলেন, হল দুটোর নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারি কেন হয়েছে।

আমি বললাম, বড় কোনো কারণ নেই। জুনিয়র পোলাপানের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি। তখন তিনি আমাকে বললেন, ভুল বলছেন। অন্য কোনো কারণ আছে কিনা খুঁজে দেখুন। আমি তাকে বললাম, আপনারা শুধু অযথাই উল্টাপাল্টা চিন্তা করেন। জবাবে তিনি বললেন, শুনুন-দুটি কারণে সব ধরনের অপরাধ ঘটে থাকে। এক. অর্থ, দুই. নারী।

আমি পুনরায় তাকে টিপ্পনী কাটলাম। তবে এটা ঠিক, পরে মারামারির কারণ অনুসন্ধানে নেমে পড়ি। শেষে জানতে পারলাম, নীলক্ষেতের বাবুপুরা বস্তি কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে মারামারিটি হয়েছিল।

তিন. কুড়িগ্রামে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে রাতে ঘরের দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে সামারি ট্রায়ালের মাধ্যমে জেলখানায় পাঠানো হয়। এর প্রধান নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সদ্য সাবেক ডিসিকে। নেতৃত্ব দিয়েছেন সেখানকার 'মহামান্য কালেক্টর'। তার হুকুমের লাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন অন্য সরকারি কর্মকর্তারা।

লাঠিয়ালদের একজনের কাহিনী সোমবারে জাগোনিউজ২৪ ডটকমে এসেছে। কী আলাদিনের চেরাগই না তার হাতে আছে! দিনমজুরের ছেলে, চাকরি পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যে উপজেলা সদরে ৪৫ লাখ টাকার জমি কিনেছেন। গড়ছেন সুরম্য অট্টালিকা। শ্বশুরের নামের সেই জায়গা-বাড়ির বাইরে স্ত্রীসহ অন্যদের নামেও আছে অনেক ভূসম্পত্তি। সবকিছুর মালিক সেই 'ন'। আলাদিনের ভূত তাকে সব দিয়ে গেছে!

অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে যে সব সম্পদ সে কামাই করেছে, তা যে তার ঊর্ধ্বতন বস (রা) জানেন না তা নয়। কেননা এটা এমন একখান জিনিস যা লুকানো সম্ভব নয়। অবৈধ অর্থের প্রমার্জন পেতে বসকে তার খুশি রাখতেই হয়। তাই সন্ধ্যার পর মোবাইল কোর্ট করা যায় কি না, সেসব দেখার প্রয়োজন নেই। সাংবাদিক তার পত্রিকায় দুর্নীতি তুলে ধরেছে, অর্থাৎ সে আয়ের পথে উপার্জনের পথে বাধা। তাই সাইজ করো তাকে। কেননা সে সম্পদের (উপার্জনের) উপর হস্তক্ষেপ করেছে।

চার. দেখুন না কি আশ্চর্য মিল বাউফলের সঙ্গে! ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ। প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, তিনি একা চারজন পুলিশকে পিটিয়ে কুপোকাত করে ফেলেছেন! যেই পুলিশ সদস্যরা অপরাধী ধরার প্রশিক্ষণ আর আত্মরক্ষার কৌশল আয়ত্ত করে চাকরিতে পদায়ন পেয়েছেন, তাদের চার চারজনকে একজন সাধারণ মানুষ পিটিয়েছে!

এ অপরাধে (!) ধরা হলো মিজানকে। সারারাত তাকে থানায় আটকে পেটানো হলো। সাংবাদিক পেটানোর সেই বাহাদুরিতে যোগ দিয়েছিলেন এক ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাও। যেভাবে আজকে আরিফের সারাশরীরে নির্যাতনের দগদগে ঘা আমরা দেখছি গণমাধ্যমে, ঠিক একইভাবে রাতভর নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত মিজানের ছবি তখন আমরা পত্রিকায় দেখেছি। নির্মম পিটুনির কারণে তার এমন দশা হয়েছিল, দু'পাশে-পেছনে তিন-চারজন পুলিশ সদস্য ধরেও ঠিকমতো দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছিলেন না মিজানকে।

মিজানের অপরাধ কী ছিল? সাংবাদিকতা করেছিল। উপজেলার সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ লুটেরা-দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখত। আরিফের লিখনীর ধাক্কায় যেমন প্রকম্পিত হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন, তেমনি মিজানের ক্ষুরধার লিখনীর কারণে অনেকের মুখোশ খুলে খুলে পড়ছিল বাউফলে। বন্ধ হচ্ছিল অনেকের অবৈধ ইনকাম। তাই মিজানকে শিক্ষা দিতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছিল। আর সেই নির্যাতনের চিহ্ন মুছতে ও ঢাকতে মিথ্যা মামলা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল কারাগারে।

মামলা শেষ হয়েছে। মিজান আজকে বেকসুর। কিন্তু মিজান যে আজকে প্রায় পঙ্গু হওয়ার পথে, অনেক নির্যাতন-কষ্ট সহ্য করেছে, চিকিৎসায় লাখ লাখ টাকা ব্যয় করেছে- এসবের দায় কে নেবে?

পাঁচ. বাউফল থেকে কুড়িগ্রাম। দূরত্ব কিন্তু কম নয়। সার্চ ইঞ্জিন গুগলের তথ্যমতে ৫৫৭ কিলোমিটার। কিন্তু দু'টি ঘটনা প্রায় অভিন্ন। মনে হয় পাশাপাশি দুটি জায়গায় বলবানের ক্ষমতার অবৈধ প্রয়োগ, দাম্ভিকতার বীভৎস উল্লাস আর হিংস্রতার নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে একই স্টাইলে।

ছয়. সাংবাদিক তার সমাজের অন্যায় অনিয়ম তুলে ধরেন। এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করেন। যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন- প্রতিনিয়ত তাদের ভুল ধরিয়ে দেন। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতন করেন, সোচ্চার করে তোলেন। এসব কারণেই সমাজে সাংবাদিককে আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়। বিপরীত দিকে এসব কারণেই সাংবাদিককে অত্যাচার, নির্যাতন, জেল, জুলুম, হুলিয়া, মামলা, চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি মোকাবিলা করতে হয়। তবু সাংবাদিকতা কিন্তু থেমে নেই। যে কারণে থেমে যাননি মিজান, থামবে না আরিফও।

সাত. সাংবাদিক সাধারণ মানুষের সঙ্গেই বৃহত্তর সমাজে বসবাস করেন। সাধারণ মানুষ তার জায়গা থেকে নিজের নাগরিক দায়িত্ব পালন করেন। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারাও ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপরও এই দুই গোষ্ঠীর থেকে সাংবাদিক আলাদা। আলাদা এ কারণে যে, সাংবাদিক সময়ের চেয়ে সামনে এগিয়ে থাকেন। লক্ষ্য থাকে সম্মুখে, অনেক দূরে। ছিদ্র অন্বেষণ করেন, ভিন্নমত পোষণ করেন- জাতীয় স্বার্থে।

আট. রাষ্ট্রের স্বার্থে এ ভিন্নমত বা মতের অমিল থাকাটাই স্বাভাবিক। এটা প্রয়োজনীয় স্বাভাবিকতা। এই স্বাভাবিকতা নষ্ট হলে কোনো কিছু টেকে না। নদীর স্বাভাবিকতা হলো- সে কুলুকুলু বয়ে চলবে। এই স্বাভাবিকতায় বিঘ্ন ঘটালে নদী ছাপিয়ে নেয় দু'কুল, অথবা কোথাও শুকিয়ে মরে যায়।

নদী হলো প্রাণের উৎস। নদী মারা গেলে যেমন মানুষের অস্তিত্ব মারা যাবে, তেমনি স্বাভাবিকতা হারিয়ে সাংবাদিকতা মারা পড়লে সেই রাষ্ট্র টিকবে না। গতি পাবে না রাষ্ট্র, দিশা পাবেন না এর পরিচালকরা। কেননা গণমাধ্যম তো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। একটা খুঁটি ছাড়া, বাকি তিন খুঁটিতে ঘর কী দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?

নয়. তাই রাষ্ট্রের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখতে হবে সাংবাদিকতা। বিপরীত দিকে গলা টিপে ধরতে হবে সাংবাদিকতার শত্রুর। আর এই গলা টিপে ধরার কাজটি রাষ্ট্রকেই করতে হবে। অপরাধী, সে যেই হোক, যদি নানা বিবেচনায় পার পেয়ে যায়, তাহলে কিন্তু অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না।

সুতরাং, বিচারের উপর নির্ভর করছে, সাংবাদিকতা তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়া হবে কি না- সেই মনস্তত্ত্ব।

মুসতাক আহমদ, সাংবাদিক, সভাপতি, এডুকেশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ইরাব)

এএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।