করোনাভাইরাসে মৃত সার্ককে মনে পড়েছে মোদির

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১০:০৫ এএম, ১৯ মার্চ ২০২০

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী কৌশল প্রণয়নের জন্য সার্কভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে উদ্যোগের ডাক দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রায় ছয় বছর আগে ২০১৪ সালের নভেম্বরে সার্কের শেষ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল নেপালের কাঠমান্ডুতে। এরপর সার্কের দুই সদস্য ভারত ও পাকিস্তানের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে ২০১৬ সালের নভেম্বরে ইসলামাবাদে নির্ধারিত সার্ক সম্মেলন বাতিল হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে সার্ককে অকার্যকর করে তোলে তখন থেকে। পাকিস্তানে সার্ক সামিট বয়কটের প্রশ্নে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কাও ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

অথচ সার্ক প্রতিষ্ঠার সময় কথা ছিল, দুই সদস্য দেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে সেখানে কোনো আলোচনা হবে না- এই প্ল্যাটফর্মে গুরুত্ব পাবে শুধুই আঞ্চলিক বিষয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে তার উল্টোটাই ঘটেছে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ছায়া সার্ককে বারবারই অকার্যকর করে তুলেছে। পাকিস্তান সম্মেলন বয়কটের আগে বাংলাদেশে ‘৭১ এর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের নাক গলানোতে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কও তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। সার্কের বড় সদস্য দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তান। তিনজনের মধ্যে বিরোধ কার্যকর থাকলে কি আর সার্ক সক্রিয় থাকে!

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের ক্ষমতায় থাকাকালে সার্ক কার্যকর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই ধরে নেয়া হয়েছিল। সার্কের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভারত বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর বিমসটেক জোট কিংবা বাংলাদেশ-ভুটান-নেপালকে নিয়ে বিবিআইএনের মতো বিকল্প জোটের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। অবশ্য পর্যবেক্ষকরা তারপরও সার্কের মৃত্যু পরোয়ানা লিখে দেয়ার পক্ষে ছিলেন না।

বলে রাখা ভালো, সার্কের সদস্য দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান। শক্তিশালী আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় এর প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাত দেশকে নিয়ে। আফগানিস্তান পরে যোগ দিয়েছে এই জোটে।

পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে বন্ধ হওয়ার পর বলা যায় আর কোনো বড় ধরনের কার্যক্রম চলেনি সার্কের। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন আগের থেকেও জটিল। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধ তো ছিল জন্মলগ্ন থেকেই। এখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যেও চলছে মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, জনগণনা, নাগরিকপঞ্জি ইত্যাদি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এই নিয়ে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্কের আলামত প্রকাশ পেয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলমানদের নির্যাতন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতাদের নানা কটূক্তি এবং সর্বশেষ দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায়- বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়াও ভারতের শাসক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গেছে।

বাংলাদেশের মানুষের প্রতিক্রিয়াকে শেখ হাসিনার সরকার অবহেলা করতে পারে না। যে কারণে উপরে ভালোত্ব দেখালেও কিছুদিন থেকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ উপস্থিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার চীনপন্থীরা সরকারে, নেপালেও চীনাপন্থীরা ক্ষমতায়। বাংলাদেশ যদি নিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তবে ভারতের সঙ্গে থাকে কে?

সম্ভবত নরেন্দ্র মোদি এই নিঃসঙ্গতাকে কেটে ওঠার জন্য করোনার ভয়াবহতা প্রতিরোধে সার্ককে সক্রিয় করার একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি করোনার প্রার্দুভাব নিয়ে একযোগে কাজ করতে সার্ক নেতাদের ভিডিও কনফারেন্সের দাওয়াত দিয়েছিলেন টুইট করে। সবাই সম্মত হলে তার প্রেক্ষিতে গত ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় নরেন্দ্র মোদির সূচনা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এক ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি ও ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং।

তবে অন্য সব দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত থাকলেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন দেশটির একজন উপদেষ্টা জাফর মির্জা। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এতে অংশ নেননি।

করোনা আরম্ভ হয়েছে চীনের উহান প্রদেশ থেকে। মাত্র দুই-আড়াই মাসের মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব কয়টি দেশে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। তার প্রতিষেধক কোনো ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার হয়নি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভাইরাসটি সম্প্রসারিত হচ্ছে বেশি। সার্কভুক্ত দেশগুলোতে মানুষের বসতি বেশি, যদিওবা এখনও পর্যন্ত সার্ক দেশগুলোতে আক্রমণ ইউরোপের মতো ভয়াবহ আকারে দেখা দেয়নি। তবে সংক্রমণ আরম্ভ হয়েছে এবং বাংলাদেশেও এখন পর্যন্ত একজন রোগী মারা গেছে। সুতরাং তা যে কোনো মুহূর্তে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।

এমন সময় নরেন্দ্র মোদি বিভাজন ত্যাগ করে যে সম্মিলিত উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছেন তা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলব। তবে হঠাৎ করে নিজের হাতে মৃতপ্রায় সার্ককে নরেন্দ্র মোদির কেন মনে পড়ল সেই নিয়েও কথা হচ্ছে। আগেই বলেছি সম্ভবত নরেন্দ্র মোদি বহির্বিশ্বে ভারতের নিঃসঙ্গতাকে কাটাতে এই উদ্যোগ নিয়েছেন। সার্কদেশে তার একমাত্র বন্ধু বাংলাদেশের সঙ্গে যখন তার মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ চলছে বলে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে টিটকারী হচ্ছে এবং মুসলিম নির্যাতন নিয়ে সারাবিশ্বের ভারতের যে নিন্দা চলছিল তাকে কাটিয়ে ওঠার জন্য মোদি সার্ককে ব্যবহার করার মওকা নিয়েছেন। এতে করোনার ভয়াবহতা নিরসনে সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়াও সম্ভব হয় আবার দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের মাতব্বরি রয়েছে সেটাও বিশ্বকে দেখানো যায়।

যেমন ১৮ মার্চ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদি। রয়টার্স জানিয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারির সংকট মোকাবিলায় পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে কথা বলেন তারা। সৌদি যুবরাজের সঙ্গে ফোনালাপে সার্ক দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক ভিডিও কনফারেন্স আয়োজনের কথাও উল্লেখ করেন মোদি। এতেও স্পষ্ট যে, মোদি সাউথ এশিয়ায় তার মাতব্বরি রয়েছে এটি প্রদর্শনের চেষ্টা করছেন। আবার মুসলমান নাগরিকদের নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা করলেও সৌদি যুবরাজের সঙ্গে কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম শাসকদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে তাও প্রমাণের চেষ্টা করছেন।

করোনাভাইরাস মানুষের জীবন সংহারে ব্যাপকতা খুব বেশি যে তা নয়, তবে আক্রমণটা খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং মানুষের মাঝে ভীতি ছড়িয়েছে খুবই ব্যাপকভাবে। আবার দেশে দেশে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে দেয়ায় যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে তাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এমন কি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এখন করোনাভাইরাস ইউরোপকে কেন্দ্র করে ছড়াচ্ছে আরও বেশি করে। ইতালিকে গ্রাস করে ফেলেছে প্রায়। যদি ব্রিটিশ এবং জার্মানিকে গুরুতরভাবে আক্রমণ করে তবে বিশ্বে মহামন্দার আক্রমণ ঠেকানোর মুশকিল হয়ে যাবে।

আমেরিকা এবং জাপানও আক্রান্ত। চীন বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি। তারাও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারতের অর্থনীতি এখন খুবই দুর্বল, তাদের প্রবৃত্তি ৮ থেকে ৪ এ নেমে এসেছে। তারা যদি গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয় তবে খুবই কঠিন আর্থিক অবস্থার সম্মুখীন হবে ভারত।

সবকিছু চিন্তা করে নরেন্দ্র মোদি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রয়াসের কথা বলেছেন। করোনা প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন সার্ক নেতারাও। ওই ভিডিও কনফারেন্সে উদ্ভুত পরিস্থিতি সামলাতে মোদি সব সদস্য দেশের যোগদানে একটি ‘আপদকালীন তহবিল’ গঠনের আহ্বান জানান। প্রাথমিকভাবে তহবিলে ভারতের এক কোটি ডলার অনুদান প্রদানের কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদি।

বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অন্য দেশগুলো রাজি থাকলে বাংলাদেশ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় একটি প্রতিষ্ঠান (ইনস্টিটিউট) স্থাপনে বা আঞ্চলিক সম্মেলন আয়োজনেও প্রস্তুত আছে। একটি ঐক্যবদ্ধ আঞ্চলিক উদ্যোগ খুব জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা প্রয়োজন। লোকবসতির ঘনত্বের কারণে সার্ক দেশগুলোতে দ্রুত ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং সাংগঠনিক কাঠামো প্রদানের যে কথা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তা অতি শিগগিরই করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ যেহেতু এই অবকাঠামোর ব্যাপারে আগ্রহী সে দায়িত্বটা সবাই একমত হয়ে বাংলাদেশকে দেয়াই ভালো হবে।

এই উদ্যোগ সফল হলে পুনরায় সজীব হবে সার্ক। ভারত যে সন্ত্রাসের অভিযোগে সার্ককে অকার্যকর করে রেখেছে তা দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হয়নি। সার্ক কার্যকর থাকলে আঞ্চলিক সমস্যাগুলো সমাধানের পথ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই বের হয়ে আসবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/বিএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।