করোনা নিয়ে বাণিজ্য করো না

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ১৬ মার্চ ২০২০

কবি ইতিবাচক অর্থেই লিখেছিলেন, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…। এটা দেশাত্মবোধক গান তো বটেই, জাতীয়তাবাদী গানও। আবেগ বাদ দিয়ে নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ বিবেচনায় ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি’ কথাগুলো সত্য নয়। বাংলাদেশের চেয়ে উন্নত, সমৃদ্ধ, সুন্দর আরও অনেক দেশ আছে। তবুও আমার দেশই আমার কাছে সেরা। প্রেম কখনও যুক্তি মেনে চলে না, আবেগে চলে; দেশপ্রেমও। এই গানটি বাংলাদেশের জন্য লেখা হলেও, এটি বিশ্বের সব মানুষের গান। সবার কাছে তার দেশই সবার সেরা। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনায় বাংলাদেশ সত্যিই অনন্য, অতুলনীয়; সত্যিই এমন দেশ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্তত ব্যবসার নৈতিকতার প্রশ্নে আমরা বিশ্বের সবাইকে টেক্কা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছি।

বিশ্বের অনেক দেশেই উৎসবে, উপলক্ষে বিভিন্ন পণ্যে ছাড় দেয়া হয়। কারণ উৎসবে মানুষ কেনাকাটা বেশি করে। তখন অল্প লাভ করলেও বিক্রি বেশি হয় বলে লাভের অঙ্ক বেশি হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটে উল্টো ঘটনা। কোনো উপলক্ষ পেলেই আমরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেই। এই যে সামনে রমজান আসছে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, রমজান এলেই ছোলা, খেজুর, বেগুন, পেঁয়াজ, সরবত, চিনির দাম বেড়ে যাবে। ভারতের পেঁয়াজের উৎপাদন কম হলে সাথে সাথে বাংলাদেশে বেড়ে যায় এর দাম। যদিও কেনা থাকে আগের কম দামে।

বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর তার ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশেও। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর প্রথম চীনের উহানে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তারপর দ্রুতই সেটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। করোনা এখন বৈশ্বিক মহামারি। এতদিন বাংলাদেশে আসেনি, এই সন্তুষ্টি নিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম। করোনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক ফান হয়েছে, মজা হয়েছে। কিন্তু ৮ মার্চ বাংলাদেশে তিনজন করোনা রোগী শনাক্তের পর হঠাৎ করে আতঙ্ক গ্রাস করে নেয় গোটা বাংলাদেশকে। করোনার খবর ছড়ানোর পর থেকেই মাস্ক, বিভিন্ন জীবাণুনাশকের দাম বাড়ছিল। কিন্তু ঘোষণার পর হঠাৎ করেই যেন বাজারে আগুন লেগে যায়। চাহিদা আর সরবরাহের ভারসাম্য না থাকলে যেকোনো পণ্যের দামই বাড়তে পারে। কিন্তু তাই বলে আপনি ২০ টাকার জিনিস তো ২০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন না। আপনার দোকানে থাকা মাস্কের কেনা দাম তো আর বাড়েনি।

সরকার র্যাবের অভিযান, দাম ঠিক করে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে বটে। কিন্তু সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়ার পুরোনো প্রবণতা থেকে আমাদের ব্যবসায়ীরা এবারও বেরুতে পাররেন না। করোনা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের আরও অনেকে দেশে ছড়িয়েছে। করোনা এখন এক বৈশ্বিক আতঙ্ক। তাই সব জায়গাতেই নিত্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছে। আতঙ্কে মানুষ বেশি করে কিনে রাখছে। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও জিনিসপত্রের দাম বাড়ার খবর পাওয়া যায়নি। উল্টো কোথাও কোথাও দাম কমিয়ে দেয়ার খবর মিলেছে।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও জাতীয় দুর্যোগে লাভের অঙ্ক কিছুটা কমিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু সেটা তারা করেননি। আবারও ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা প্রশ্নের মুখেই পড়লো। তবে বড় বড় ব্যবসায়ীদের মুখে থাপ্পড় মেরেছেন এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এনামুল হক গাজী গুলশান-১ নম্বর মার্কেটের সামনে তৈরি পোশাক বিক্রি করেন। হঠাৎ মাস্কের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তিনিও মাস্ক বিক্রি শুরু করেন। শুরুর দিকে লাভ করলেও এখন উল্টো কমিয়ে দিয়েছেন। ৫৫ টাকায় মাস্ক কিনে তিনি ২০ টাকায় বিক্রি করছেন। তবে কারও কাছে একটির বেশি মাস্ক বিক্রি করছেন না। তার উদ্দেশ্য ব্যবসা নয়, জনসেবা। এই রাস্তার হকার এনামুল হক গাজীর কাছে কি নৈতিকতা শিখবেন আমাদের বড় বড় ব্যবসায়ীরা?

শুধু ঝোপ বুঝে কোপ মেরে ব্যবসা করার ক্ষেত্রেই আমরা অনন্য নই, হুজুগেও আমরা সবার সেরা। করোনা শোনার পর থেকেই আমরা মাস্ক আর স্যানিটাইজার কিনতে পাগল হয়ে গেলাম। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োজনীয়তাটা যাচাইও করলাম না। চিলে কান নিয়েছে শুনেই আমরা দৌড়াচ্ছি চিলের পেছনে, কানে হাত না দিয়েই। প্রথম কথা হলো মাস্ক আমাদের কতটা রক্ষা করবে? এমনিতে ঢাকার দূষিত বাতাস থেকে ফুসফুসকে রক্ষা করতে অনেকেই নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করেন। আমি নিজেও একজন শ্বাসকষ্টের রোগী। তাই বাইরে গেলে চেষ্টা করি ধুলাবালি, ধোঁয়া থেকে
ফুসফুসকে রক্ষা করতে। কিন্তু মাস্ক আপনাকে করোনা থেকে রক্ষা করবে কিনা জেনে নিন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়ায় না। তাই সবার মাস্ক ব্যবহারের দরকার নেই। শুধু শনাক্ত হওয়া করোনা রোগী বা সন্দেহভাজন রোগী মাস্ক ব্যবহার করবে; যাতে তার কাছ থেকে ভাইরাসটি ছড়াতে না পারে। কিন্তু এখন তো সন্দেহভাজন সবাইকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে, তাই সাধারণভাবে মাস্ক ব্যবহারের দরকার নেই। তারচেয়ে বড় কথা হলো, চড়া দামে কেনা মাস্ক নিশ্চয়ই আমরা একবার ব্যবহার করবো না; বারবার, অনেকদিন ব্যবহার করবো। অতি ব্যবহারে ময়লা হয়ে যাওয়া মাস্কটি বরং জীবাণুর কারখানা হিসেবে আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে। তাই হুজুগে মাস্ক ব্যবহার করার আগে আবার ভাবুন। তারপরও ব্যবহার করতে চাইলে, আপনার মাস্কটি পরিষ্কার রাখুন।

করোনা থেকে নিরাপদ থাকতে যেসব সাবধানতার কথা বলা হচ্ছে, তা কিন্তু নতুন কিছু নয়। প্রথম কথা হলো, আপনাকে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কিন্তু এখন যেভাবে মানুষ লিকুইড সাবান, স্যানিটাইজার কিনতে ব্যাকুল হয়ে গেছে; মনে হচ্ছে করোনা আসার আগে তারা সাবান ব্যবহার করতেন না বা পরিচ্ছন্ন থাকতেন না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা থেকে মুক্ত থাকতে আপনার দামি সাবান বা স্যানিটাইজার দরকার নেই। আপনাকে স্রেফ পরিষ্কার থাকতে হবে। হাত না ধুয়ে কিছু খাবেন না। আচ্ছা, করোনা আসার আগে কি আপনি হাত না ধুয়ে খেতেন?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপনি নিয়মিত যে সাবান দিয়ে হাত ধুতেন, সেটা ব্যবহার করাই যথেষ্ট। এমনকি সাবান না পেলে ছাই দিয়ে হাত ধুলেও চলবে। মোদ্দাকথা হলো, আপনাকে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, জীবাণুমুক্ত থাকতে হবে। যেমন আমি বলি, একজন নিষ্ঠাবান মুসলমানের করোনার ঝুঁকি কম। নামাজ পড়ার জন্য দিনে পাঁচবার অজু করলেই তিনি অনেক পরিচ্ছন্ন থাকবেন। শুধু ইসলাম বলে নয়, সব ধর্মেই পরিচ্ছন্নতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। সব ধর্মের উপাসনালয়ে ঢোকার প্রথম শর্ত পরিচ্ছন্নতা।

তবে করোনামুক্ত থাকতে হলে খালি নিজে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত থাকলেই হবে না, আপনার চারপাশও পরিষ্কার রাখতে হবে। আপনি নিজে জীবাণুমুক্ত থাকলেন, মুখে মাস্ক লাগিয়ে চলাফেরা করলেন। আর সবার চোখের আড়ালে টুক করে কফ, কাশি বা থুথু যেখানে সেখানে ফেললেন; তাতে কিন্তু লাভ নেই। আপনার ফেলা কফ থেকে ছড়িয়ে পড়া জীবাণু ঘুরেফিরে কিন্তু আপনার কাছেও আসতে পারে। তাই স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিরাপদ না রেখে সবাইকে নিরাপদ রাখুন। মনে রাখবেন, নগরে আগুন লাগলে কিন্তু দেবালয় রক্ষা পায় না।

অতীতে আমরা অনেকবার প্রমাণ করেছি, দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরাই সেরা। দুর্যোগ এলেই আমরা একে অপরের পাশে দাঁড়াই। করোনার চেয়ে বড় দুর্যোগ শুধু বাংলাদেশে কেন বিশ্বেই খুব বেশি আসেনি। তাই এ দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সবাইকে মানবিকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সবার পাশে দাঁড়াতে হবে। নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। করোনায় মানুষে মানুষে সংযোগ কমাতে হবে। বিচ্ছিন্নতা থেকেই সৃষ্টি হোক ঐক্য, মানবতার ঐক্য। যেন সত্যি সত্যিই আমার দেশ সকল দেশের রানি হয়, মানবতায় যেন আমরা অতুলনীয় হই।

এইচআর/বিএ/এমএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।