মুক্তি মিলুক জাদু বাস্তবতা থেকে


প্রকাশিত: ০৩:৩৫ এএম, ০৫ অক্টোবর ২০১৫

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ম্যাজিক রিয়ালিজম বা  জাদু বাস্তবতার সঙ্গে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। চিত্রকলা কিংবা চলচ্চিত্র নিয়ে যারা মাথা ঘামান তারা জানেন বিষয়টি। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ কিংবা ইসাবেল আলেন্দের লেখায় যে  জাদু বাস্তবতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম আজ তাতেই যেন হোঁচট খাচ্ছি প্রতিক্ষণ। অনাদৃত অর্কের ফেসবুক স্ট্যাটাসে উপলব্ধিটা প্রগাঢ় হয়েছে। সত্যিইতো, গোটা বাংলাদেশই যেন এখন  জাদু বাস্তবতার সুবিশাল খনি! এখানে সাংসদের ছেলে গুলি করে মানুষ মারে, মাতাল সাংসদ গুলি করে শিশুর পায়ে। রাতের অন্ধকারে কিংবা দিনের আলোয় খুন হয় বিদেশি। প্রকাশ্য রাস্তায় কিংবা ঘরের ভেতরে কুপিয়ে মারা হয় ব্লগারদের। কোনো কিছুতেই যেন কিছু যায়-আসে না কারোরই। রাষ্ট্র চলে রাষ্ট্রের মতো। সুযোগ বুঝে অভিযোগের তীর একেক সময় একেক দিকে তাক করে সরকার। কখনো বলে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতা। এখানে ওখানে গ্রেপ্তার হয় কয়েকজন। কিছু সিডি আর জিহাদি বই দেখিয়ে বলা হয় আল-কায়েদা কিংবা আইএস। বুমেরাং-এর ফাঁদে পড়লে তীর যায় ঘুরে। আইএসমুক্ত হয় বাংলাদেশ। আবারো অভিযুক্ত হয় বিরোধী জোট। অন্যদিকে ভাঙ্গা রেকর্ডের মতোই সরকারের ব্যর্থতা খোঁজে সরকারবিরোধীরা। এসব শুনতে শুনতেই ঘুমাতে যায় জনগণ। সকালে উঠে আবার শুরু হয় তাদের কর্মব্যস্ততা।

৯০ দিনের আন্দোলনে হত্যার শিকার হয়েছিলো প্রায় দেড়শো মানুষ। এদের মধ্যে শতাধিক নিরীহ মানুষকে মারা হয় পুড়িয়ে। এবারের টার্গেট নিরীহ বিদেশি নাগরিকরা। সমীকরণ মেলানো কি খুব কষ্টের কিছু? না, সরকার হয়তো সহজ সমীকরণটাই মেলাতে চাইছে। এই সমীকরণটা মিললেও আইএসের বিষয়টা কি সত্যিই উড়িয়ে দেয়া যায়? নাকি উড়িয়ে দেয়া উচিত হবে? সরকার আর বিরোধী পক্ষ নিজেদের মতো করেই সমীকরণ মেলাবে। সেই মেলানো সমীকরণ তারা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টাও করবে। এটাই এই দেশের রাজনীতিতে স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব মেলাতে পারে না কখনোই। তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী কিংবা নেতারা ঢালাওভাবে এক বা একাধিক গোষ্ঠীর ওপর দায় চাপিয়ে যান। বিরোধী পক্ষও পাল্টা দায় চাপায় সরকারের ওপর। বড় করে দেখাতে চায় সরকারের ব্যর্থতাকে। তারা একবারও কি ভাবেন না- তাদের এসব বক্তব্য তদন্তে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? তারা না ভাবুক, জনগণ কিন্তু ঠিকই ভাবে। কারণ সব পক্ষের সমীকরণ মেলে তর্কের টেবিলে। শুধু জনগণের প্রশ্নের জবাব মেলে না। কেন ধরা পড়ে না অপরাধীরা?

দায়ী যেই হোক না কেন ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু বাংলাদেশই। চোখ-কান একটু খোলা রাখলেই বোঝা যায় গভীর ষড়যন্ত্রের কবলে এই ব-দ্বীপটি। সেই ষড়যন্ত্রের হোতা দেশি হোক আর বিদেশিই হোক। জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বিশেষ গোষ্ঠী যে এই দেশকে ব্যর্থ হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছে- তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। এই প্রেক্ষাপট তৈরির দায় আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি কেউই এড়াতে পারে না। জামায়াতের রাজনীতি সব সময়ই জঙ্গি ঘরানার ছিলো। বিশেষ করে তাদের ছাত্র সংগঠনটির সহিংসতার ধরন তেমনই। কিন্তু বিএনপিকেও জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সব সময়ই সোচ্চার থেকেছে আওয়ামী লীগ। সেটা দেশে-বিদেশ সবখানেই। আর বিএনপি তা অস্বীকার করে এসেছে বরাবর।

কিন্তু এখন এই ব্লেইম গেম চলছে উল্টো রথে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে এখন ধর্মীয় মতবাদ কিংবা মৌলবাদ- দুইই রাজনীতির বড় অনুষঙ্গ। এ বছরই হত্যা করা হয়েছে চারজন ব্লগার ও মুক্তমনা লেখককে। যাদের হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী। এবার পাঁচদিনের ব্যবধানে খুনের শিকার ইতালি এবং জাপানের দুই নাগরিক। এখানেও দায় কাঁধে নিয়েছে আইএস। সব শেষ দুইটি ঘটনায় আওয়ামী লীগ বলছে দেশে কোনো আইএস জঙ্গি নেই। উল্টো সুর বিএনপি`র কণ্ঠে।

দুই পক্ষের এই ব্লেইম গেম এই দেশে চলতেই থাকবে। কিন্তু শেকড় খুঁজে বের করবে না কেউ। অন্তত সেই চেষ্টা এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। হতে পারে এই ছয়টি হত্যাকাণ্ডের কোনোটিই আইএস ঘটায়নি। শুধু ভীতি ছড়ানোর জন্য এবং বাংলাদেশে নিজেদের একটি ক্ষেত্র তৈরির জন্য এই সুযোগটি নিচ্ছে। অন্যকারো অপরাধের দায় স্বীকার করে নিচ্ছে তারা। যাতে বাংলাদেশে থাকা আইএসের ধারণায় বিশ্বাসীরা মনোবল পায়। সেটি হলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশেও আইএসের কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেয়া সহজ হবে। সেক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে জঙ্গিদের জন্য এই সুযোগ, এই ক্ষেত্রটি কারা তৈরি করে দিচ্ছে। তারা কি সত্যিই জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী,  নাকি জুজু`র ভয় দেখিয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে চাইছে?

বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে যাদের ধারণা আছে, তারা ভালোই জানেন কেন আর কিভাবে একটি দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হয়। একের পর এক আক্রমণে এই দেশের ব্লগারদের মধ্যে কিছুটা ভীতি ছড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু তারাও মাঠে নেমে প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে অনলাইনে। হঠাৎ করেই রাজপথে নেমে আসলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। উস্কানি ছাড়াই তাদের ওপর গুলি চালালো পুলিশ। তারপর কয়েকদিন ধরে অচল রাজধানী। ভাগ্য ভালো এই শিক্ষার্থীরা কোনো সহিংসতায় যায়নি। অন্যদিকে টানা আন্দোলনে আছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকরা। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এনে আন্দোলন করছেন মেডিকেল কলেজের পরীক্ষার্থীরা। মোদ্দা কথা দীর্ঘদিন ধরেই বই খাতা আর ক্লাস ছেড়ে আন্দোলনেই আছে এই দেশের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা। এদিকে সপ্তাহ না ঘুরতেই খুন দুই বিদেশি। তাহলে কি কৌশলে দেশে অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে? এর পেছণে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ? নাকি ভূ-রাজনীতির জটিল হিসেব নিকেশ?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশের অর্জনগুলো ম্লান করার জন্যই এসব ঘটানো হচ্ছে। আপনি স্পষ্টতই এসবের পেছনে বিএনপি-জামায়াতের মদদ আছে বলে অভিযোগ করেছেন। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রে বসেই বলেছেন, বিএনপি`র এক নেতাকে ধরে জিজ্ঞেস করলেই সব জানা যাবে। তাহলে ধরছেন না কেন? সব জানছেন না কেন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই দেশের সাধারণ মানুষ দলমত বোঝে না। দেশি-বিদেশি চক্রান্ত বোঝে না। তারা শুধু বোঝে এই দেশটাকে, এই দেশের অর্জনকে। স্বাধিকারের সংগ্রাম থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ। তারপর আজকের বাংলাদেশ। কোনো অর্জনই সহজে আসেনি। অনেক রক্ত আর ঘামে ভিজে সোনা হয়েছে বাংলাদেশের মাটি। গভীর মমতায় গভীর ভালোবাসায় পাওয়া অর্জনগুলো ম্লান হবে না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আপনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন। আপনি শুধু জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করুন। সবার সামনে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দেন এসবের সঙ্গে কারা জড়িত। দোষারোপের রাজনীতি আর রাজনৈতিক মন্তব্য আমরা শুনতে চাই না কোনো পক্ষ থেকেই। মানুষ চায় দেশের অভিভাবক হিসেবে এই দেশকে আপনি সব চক্রান্ত থেকে মুক্ত রাখতে পারছেন। যারা চক্রান্ত করছে- তাদের শাস্তি দিতে পারছেন। নইলে আমাদের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে ঘোর অমানিশা।

কারণ সরকার এখন স্বীকার করুক আর নাই করুক- এই দেশে যে ইসলামি মৌলবাদের একটা পকেট তৈরি হয়েছে তা স্পষ্ট। এই পকেট কিন্তু হঠাৎ করেই তৈরি হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পরই তৎকালীন শাসক শ্রেণি এই পকেটের বীজ বুনে দিয়েছে। যাকে পরে লালন করেছে সামরিক শাসকেরা। কিন্তু তা থেকে কখনোই বেরিয়ে আসতে পারেনি নব্বইপরবর্তী তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারগুলো। বরং প্রধান দুই দলই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং রাজনীতিতে বিতর্কিত জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। বর্তমান সরকার একদিকে বলছে, জামায়াত জঙ্গিবাদের মদদদাতা। যুদ্ধাপরাধে তাদের শীর্ষ নেতাদের বিচার হওয়ায় তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। সে কারণেই দুই বিদেশি হত্যার শিকার। অন্যদিকে, সরকার জোর গলায় এও বলছে যে, এই দুই হত্যাকাণ্ডে আইএসের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কারণ সরকারের দাবি, আইএসের অস্তিত্বই নেই বাংলাদেশে। সরকারের দাবি অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াত জোট যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালে এসব হত্যাকাণ্ডে মদদ দিয়ে থাকে তাহলে তারা জঙ্গিদের সহায়তা নিতেই পারে। সেই আশঙ্কাকে সরকার এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চাইছে কেন? সরকার কেন সুষ্ঠুভাবে সঠিক তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই বিএনপি-জামায়াতের নাম উল্লেখ করে দায় চাপাচ্ছে? সঠিক তদন্তেই বেরিয়ে আসবে অন্তরালের নামগুলো। সে অনুযায়ী তাদের বিচারও হবে। তার আগ পর্যন্ত সরকার কিংবা বিরোধী পক্ষ- সবারই অতিকথন বন্ধ করা উচিত।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভি
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।