যদি হবে প্রশ্ন ফাঁস পড়বো কেন বারো মাস


প্রকাশিত: ০৬:১৫ পিএম, ০২ অক্টোবর ২০১৫

আগে শুনতাম টাকা দিয়ে রাজনীতি কেনা যায়। সারাজীবন রাজনীতি না করেও টাকার বিনিময়ে নমিনেশন ও ভোট জিতে অনেকে পাত্তিওয়ালা হাইব্রিড নেতা হয়ে সংসদে বসে আরামছে জীবন কাটাচ্ছেন-অভিযোগ আছে। এরপর শুনেছি চাকরি পেতেও টাকা লাগে, কোথায কোথায় যেন দিতে হয়। শোনা কথায় কান দিতে নেই, দেই নাই। কয়েকদিন ধরে হুলস্থুল চলছে, শিক্ষাও নাকি কেনা-বেচা হয়, হচ্ছে। এটাও শুনেছি, দেখিনি।

ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনে কিছুটা বোঝা গেলেও পরিষ্কার ধারণা পাইনি। কিন্তু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, আবার অভিযোগ এসেছে, আন্দোলন চলছে। পুলিশ ভেতরে-বাইরে পেটাচ্ছে, ছাত্ররা তবু থামছে না!

‘যদি হবে প্রশ্ন ফাঁস পড়বো কেন বারোমাস’- এই স্লোগানে সারা দেশে টাকা দিয়ে প্রশ্ন না কিনতে পারা বা কিনতে না চাওয়া শিক্ষার্থীগণ, যারা ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়েছে, আন্দোলন করছে যে- পুনরায় পরীক্ষা নিতে হবে।

এর মধ্যে ফাঁসে জড়িত সন্দেহে বা অভিযোগে যে কয়েকজন আটক হয়েছেন তাদের মধ্যে একজন ইউজিসির সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজ র‌্যাব হেফাজতে মারা যাওয়ায় বিষয়টি আরো ঘোলা হয়েছে। যদিও র‌্যাব বলছে যে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন। কিন্তু অধাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘এই অনভিপ্রেত মৃত্যুই প্রমাণ করে যে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, রাঘব বোয়ালদের নাম বেরিযে আসার আগেই সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে’।

তবে তিনি র‌্যাবের কাছে কি বলেছেন, কাদের নাম বলেছেন সেই জিজ্ঞাসাবাদ রেকর্ড জাতির সামনে প্রকাশ করলেই অনেক গোপন সত্যি বের হয়ে আসবে বলে তিনি (আনু মুহাম্মদ) মনে করেন।

সৈযদ আবুল মকসুদ বলেছেন, ‘প্রশ্ন ফাঁস একটি ফৌজদারি অপরাধ। প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন যারা তাদেরকে পুলিশি লাঠিপেটা করাও আরেকটি ফৌজদারি অপরাধ’। কিন্তু একচ্ছত্র এই যে ক্ষমতার অপব্যবহার রাষ্ট্র করছে এতে তাঁর দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। তাই অবিলম্বে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হোক এবং উপযুক্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেলে ভর্তি হোক।

সরকার হয়তো ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার ভয়ে প্রশ্নফাঁস এর কথা স্বীকার করতে চাইছে না কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে জাতি হিসেবে এর জের এমনভাবে টানতে হতে পারে দেশের ভাব এবং মূর্তি দুটোই সংকটাপন্ন হবে। এই যে যারা টাকা দিয়ে চান্স পেলো তারা তো নৈতিকভাবেই অসততার মধ্যে দিয়ে প্রথম পাঠ নিলো, মানবসেবার নিষ্ঠা এদের থাকবে না!

এরা ভবিষ্যতে হার্টের অপারেশন করতে গিয়ে কিডনি কেটে ফেললে কে দায়ভার নেবে? টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আর উপযুক্ত ডাক্তার হওয়া এক কথা নয়। যারা মেধা থাকা সত্ত্বেও ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলো না, তারা এখন কোথায় যাবে? যেখানেই যাক, তাদের কি আর নিজের প্রতি ভরসা থাকবে। দেশের প্রতি তো থাকবেই না! তারাও যে সৎভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে, নিয়মনিষ্ঠ পড়াশুনা করবে, কেন করবে? তার সামনে তো চুরিতে পাসের উদাহরণ। আদর্শ না থাকলে জাতির ভবিষ্যৎ কোথায়?

ভোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মিশ্র স্যার নামে এক জাঁদরেল সায়েন্স টিচার ছিলেন। সারা স্কুল তার জ্ঞানের ভয়ে, নীতির দাপটে কাঁপতো। তাঁর নিজের ছেলে বোর্ড পরীক্ষায় বসেছে। স্যার হল সুপার। রুমে গিয়ে দেখেন ছেলে নকল করছে। আর দেরি নয়। সাথে সাথে এক্সপেল্ড। এই যে পিতা, সে পিতা হিসেবে আর শিক্ষক হিসেবে আসলে কেমন? এখন এমন শিক্ষক, এমন বাবা খুঁজতে হবে। কারণ প্রশ্ন যে শিক্ষার্থী কেনে তার মূল্য তো এক টাকা দুইটাকা নয়- ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা।

পয়সাগুলো তো বাবা-মা ই দেন নিশ্চয়ই। গরীব বাবা-মা তো চাইলেও টাকা দিতে পারবেন না! ছেলে বা মেয়ে ডাক্তার হবে কার? যার টাকা আছে ,যে প্রশ্ন কিনতে পারবে- তার! এভাবে সকল সাধারণ মানুষের হতে চাওয়া আশা আকাঙ্ক্ষা জলে যাবে, জাতি সকলের জন্য সমান শিক্ষা সুযোগ আর অধিকার বাস্তবায়নের অন্যায়ের স্বীকার হবে, হতেই থাকবে।

ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হতেই দশ লাখ যদি লাগে কোনো কোনো স্কুলে সে প্রাকটিসটাই বা কেমন? প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে যদি পরীক্ষাই দিতে হবে তবে সে শিশু স্কুলে কি পড়বে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এরকমই আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।

আগে পরীক্ষা পদ্ধতি ছিলো বর্ণণামূলক। সহজ পদ্ধতি এলো- বাছাই করে এ বি সি ডি ভরাট করো। এখন কানে যন্ত্র বসিয়ে শুনে শুনে ভরাট প্রক্রিয়া চলছে। টাকা থাকলে কানে শোনা যাবে আর না থাকলে না। এই যে মেধা বিনাশী চক্র সেটা আরও সহজ হতে চলেছে।

শিক্ষকদের আন্দোলন দমাতে এখন সকল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা পাঁচদিনে নেয়ার হুকুম হয়েছে। সেটা আরো সহজ কোনো উপায় হয়ত। ফাঁসচক্র বসে থাকবে এমন ভরসা নেই। তারা আরো আধুনিক উপায়ে উত্তরপত্র সরবরাহ করার নতুন কোন নিয়ম আবিষ্কার করবে, অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। তবে প্রথম শ্রেণি থেকে পাসের হার বাড়ানোর সরকারি পরোক্ষ চাওয়া যে দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে, যাচ্ছে সেটা অনুমেয়।

ক্লাসে ঢুকে এক শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলাম - ‘কালো টাকা কি?’ সে খানিক চিন্তা করলো। বললো যে, ‘স্যার আমি তো গত ক্লাসে আসি নাই।’ আমি কিন্তু এই উত্তরে একটুও হাসিনি। ভয় পেয়েছি যে- এরাই তো আসছে দলে দলে। গোল্ডেন জিপিএ নিয়ে।

মন খারাপ হয়। কেউ যেন ভাবছে না কিছু। সবাই নিজ নিজ আখের গোছাতে ব্যস্ত। ন্যায্যতার দাবি পূরণ হচ্ছে না। ক্ষোভের আকাশে মেঘ, ভারি বৃষ্টি কখন আসে- অপেক্ষা। পাস বেড়েছে, সৃজনশীল জ্ঞান বাড়েনি-এটা সত্য। কিন্তু এই কঠিন সত্যটা কেউ মানছে না। মানা দরকার।

এক ছেলেকে তার শিক্ষক প্রশ্ন করলেন, তোমার কাছে একশ’ টাকা আছে আর তুমি তোমার বাবার কাছে থেকে একশ’ চাইলে। মোট কত টাকা হলো? ছেলেটি ঝটপট বললো, একশ’ টাকা। স্যার অবাক হয়ে বললেন, তুমি দেখি অংক জানো না। ছেলেটি বললো, স্যার আপনিও আমার বাবাকে চেনেন না!

আমরা আমাদের সরকারকে চিনতে চাই, চাই সরকার আমাদের কথা শুনুক, বুঝুক। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস প্রমাণ হলে সেটা পুনরায় নেয়ার ব্যবস্থা করুক। ডাক্তার হতে যে পড়াশুনা করা লাগে, আন্দোলন নয়- এটা অন্তত প্রমাণ হোক। বড় হয়ে কি হতে চাও? প্রশ্নের জবাবে ‘ডাক্তার’ শব্দটি বলতে কোনো সন্তান না এড়াক, না ভুলুক!

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।