অর্থনীতির নিম্নগামী অবস্থা ঠেকান
বাংলাদেশের অর্থনীতির কী হাল এখন? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমরা সহসা দুর্দিনের মুখোমুখি হচ্ছি যদি সতর্ক না হই। কিন্তু সরকারি মুখপাত্রদের কথাবার্তায় তা মনে হয় না। এইতো কুমিল্লায় বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে সুন্দর সময় আমরা এখন পার করছি। গত দুই দশকে পৃথিবীতে কয়েকবার অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। তাতে বেশ কিছু দেশ চরম অবস্থায় পতিত হয়। কিন্তু তখনও আমাদের অর্থনীতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি।
মন্ত্রী বলেছেন, এখন পৃথিবীতে তৃতীয় চরম অবস্থা বিরাজ করছে আর সেটি হচ্ছে তথাকথিত বাণিজ্যযুদ্ধ। চলমান এই বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে নিম্নমুখিতা দেখা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অথনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে অর্থনৈতিক খাতে উন্নতি সাধন করে চলেছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। গত অর্থবছরে আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরেই আমরা ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা করছি, যা ২০২৪ সাল নাগাদ দাঁড়াবে ১০ শতাংশ এবং সেটা অব্যাহত থাকবে।
অর্থমন্ত্রী সবকিছুতে আত্মতৃপ্তি পেলেও বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে রেমিট্যান্স ছাড়া সব সূচকের তুলনামূলক নিম্নগামী অবস্থা। এই অবস্থায় সরকারের অন্যতম কাজ হচ্ছে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা। বিশ্বব্যাপী মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। এই সময় অর্থনীতিকে ঊর্ধ্বগামী করা কঠিন কাজ, তবে পিছুটান অবস্থা যেন অর্থনীতিতে না আসে সে জন্য প্রাণপণ প্রয়াস চালাতে হবে। অর্থনীতির মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে এটা মাথায় রেখে ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হতে হব। অস্বীকার করার বা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আমাদের চেয়ে বড় অর্থনীতির দেশগুলো মন্দা অবস্থা মেনে নিয়েছে।
আমাদের রফতানি বাণিজ্যে ধীরে ধীরে মন্দাভাব আসছে, তা থেকে বাঁচানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ দরকার। বিশ্বে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেকে পেছনে ফেলে ভিয়েতনাম দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান নিয়েছে আর বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। এখন আয় কম হওয়ায় সরকারের ঋণপ্রবাহ বেড়েছে, সে কারণে ব্যাংকগুলোর শিল্পবাণিজ্যে ঋণপ্রবাহ কমেছে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশের পোশাক রফতানি কমে গেছে। তার প্রথম কারণ হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো মন্দাক্রান্ত হওয়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা মন্থর হয়ে গেছে। যে কারণে বিশ্ববাজারে পোশাকের দাম কমে গেছে। আর সে কারণে এই শ্লথ গতিকে কাটানোর জন্য বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ বাড়াতে পারেনি। বাংলাদেশের প্রতিযোগী রাষ্ট্রগুলো তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছে। শুধু ভারত গত এক বছরে ডলার প্রতি ৬৪ থেকে ৭২ রুপিতে নামিয়ে এনেছে। অর্থাৎ তারা এক বছরে তাদের মুদ্রামান সাড়ে ১২ শতাংশ অবমূল্যায়ন করেছে। ভিয়েতনাম ৬ শতাংশ অবমূল্যায়ন করেছে। আর পাকিস্তান অবমূল্যায়ন করেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ তার মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেনি, যে কারণে বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পিছিয়ে পড়ছে। রফতানি বাড়ানোর জন্য মুদ্রার অবমূল্যায়ন করলে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য বেড়ে যায়। সেদিকে লক্ষ্য রেখে মুদ্রামান অবমূল্যায়নের প্রয়োজন আছে কিনা তা অর্থমন্ত্রী বিবেচনায় রাখবেন বলে আশা করি।
আর কয়দিন আগে রেগুলেটরি কমিশন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য গণশুনানি করেছে এবং সম্ভবত আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বিদ্যুতের নতুন দর ঘোষণা করবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করব বিদ্যুতের মূল্য যেন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন। এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। কল-কারখানার ওপর বিশেষ করে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিগুলোর ওপর হবে মরার ওপর খাড়ার ঘা। আর দেশের কল-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা বিবেচনা করে সুদের হার কমানোর বিষয়টি যেন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনার কথা বলেছেন এক বছর হয়ে গেছে কিন্তু ব্যাংকগুলো তা এখনো কার্যকর করেনি। ব্যবসা-বাণিজ্য জটিলতার মধ্যে কখনও আগায় না। সুতরাং সর্বক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহারের উপায় উদ্ভাবন করতে হবে। আর ব্যাংকগুলো যদি প্রয়োজনীয় পুঁজি সরবরাহ না করে তাহলেও কারখানা সচল রাখা মালিকদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।
আমাদের বর্তমান অর্থমন্ত্রীর ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। তিনি বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে এই পর্যন্ত এসে পৌঁছেছেন। আমরা তো আশা করেছিলাম তিনি সমস্যা সমাধানে খুবই পরিপক্ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন। ব্যাংকের যে এলোমেলো অবস্থা সৃষ্টি হয়ে আছে তাও ঠিক করবেন। ব্যাংক ব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে অর্থনীতিতে অচল হয়ে যাবে।
দেশে বর্তমানে দুই কোটিরও বেশি মানুষ হতদরিদ্র। যাদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১১-১৩ শতাংশ। আবার দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ এক কোটি ৫৫ লাখ মানুষ দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত। দেশের আড়াই কোটি মানুষ নাকি পুষ্টিহীনতার শিকার। গত ১০ বছরে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা সাত লাখ বেড়েছে। আমরা বলছি আমাদের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে আবার বলছি আমরা উন্নয়নের রোল মডেল।
উপরে বর্ণিত পরিসংখ্যান কিন্তু রোল মডেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখন ব্যাংক থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ নেয়ার প্রবাহ বেড়ে গেছে। এক জুলাই থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে ৪৩ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। অথচ পুরো বছরে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। তাতে বেসরকারি খাতে ব্যাংকের পুঁজি বিনিয়োগ কমে গেছে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রায়োরিটি বিবেচনায় না করলে তো সরকার টাকার অভাবে পড়বেই। সর্বক্ষেত্রে সমন্বয় প্রয়োজন। রফতানি আয় কমেছে রাজস্বও কমেছে। সুতরাং সরকারকে উন্নয়নের বিষয়ে ধীরে চলতে হবে। বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ এখন সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পা বাড়ালে অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত হবে। সুতরাং আমরা আশা করব সরকার কোনো লাগামহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/বিএ/এনএফ/জেআইএম