বিএনপি কেন গোঁফে তেল দিচ্ছে?
দেশের রাজনীতিতে দৃশ্যত কোনো উত্তেজনা না থাকলেও ভেতরে ভেতরে কিছু চাঞ্চল্য আছে বলে মনে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতিয়ে পড়া কোনো কোনো নেতার আবার গা-ঝারা দিয়ে ওঠার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপি নেতারা আজকাল সরকারকে নতুন করে হুমকিধামকিও দিতে শুরু করেছেন।
সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা বিএনপিকে উৎসাহিত করে তুলেছে বলে শোনা যাচ্ছে। বুয়েট ছাত্র আবরারকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নৃশংসভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় মানুষের মধ্যে চরম অসন্তোষের জন্ম দেয়। বুয়েটসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। বুয়েটের পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। পুরো বিষয়টি সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। ঘাতকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার পক্ষ নিয়ে সরকার উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত করতে পারলেও পুরো বিষয়টি সরকারবিরোধীদের জন্য প্রেরণাদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। আন্দোলনে বর্তমান সরকার নত হয় না বলে এতোদিন যে ধারণাটা চলে আসছে, তা বুয়েটের ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হওয়ায় মনে করা হচ্ছে, যুৎসই ইস্যুতে ভালোমতো চেপে ধরতে পারলে সরকারকে মাথা নোয়াতেই হয়।
বুয়েটের পর ঘটনার পাশাপাশি কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগ এবং কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি-অনিয়ম এবং অন্যান্য কারণে অসন্তোষ এবং বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নপ্রকল্প থেকে ছাত্রলীগের কথিত চাঁদাবাজির ঘটনায় সরকার কিছুটা বিপাকে পড়ে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেওয়া হলে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। সরকার সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, খুনখারাবিসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠতে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রধান নিজেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানের ঘোষণা দিয়ে তিনি প্রথমেই কাজটি শুরু করেন নিজের ঘর থেকেই।
কেঁচো খুড়তে সাপ বেরুনোর মতো ঘটনা ঘটে। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগসহ সরকার সমর্থক কতিপয় নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের প্রমাণ মিলতে থাকে। জুয়ার আসর বসিয়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জনের প্রমাণ পাওয়া যায় হাতেনাতে। দলের মধ্যে শুদ্ধি অবিযানের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়, সংগঠন থেকে বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতি দেওয়া হয়। সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাট এবং সম্পদ পাচারের ঘটনাগুলো মানুষের মধ্যে প্রধান আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
বিরোধী দলের জন্য এসব ঘটনা হট ইস্যু হলেও তারা এগুলো কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। কারণ বিরোধী দল এখন বিপন্ন অবস্থার মধ্যে আছে। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এতোই হীনবল যে তাদের পক্ষে আন্দোলনের ডাক দেওয়াও সম্ভব নয়। তাছাড়া ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি এতো বেশি দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে যে মানুষের আস্থা আর তাদের প্রতি নেই। তবু মানুষ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলে তার স্বাভাবিক বেনিফিট বিরোধী দল পায়। সরকারের যা কিছু মানুষ অপছন্দ করছে তার সবকিছু অবশ্য বিএনপি নিজেদের পক্ষে নিতে পারছে না। তাদের বেনিফিট সংগ্রহের পাত্রে রয়েছে বিশাল ফুটো।
সরকারের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে আসে পেঁয়াজসঙ্কট। পেঁয়াজের বাজারে যে এভাবে আগুন লাগবে সেটা সরকারের মন্ত্রী-আমলারা কেউ বুঝতে পারেননি। পেঁয়াজের দাম কেজি তিনশো টাকার ঘর ছোয়ায় মানুষ যারপরনাই অখুশি হয়েছে। পেঁয়াজ ঘরে ঘরে লাগে। তাই পেঁয়াজ সঙ্কট ঘরে ঘরে ক্ষোভ ছড়িয়ে দিয়েছে। পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক করার জন্য সরকার কিছু বিলম্বিত উদ্যোগ নিয়েছে। কার্গো বিমানে করে পেঁয়াজ আনার ব্যবস্থা করেও বাজার স্বাভাবিক করতে পারেনি সরকার। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পেছনে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি আছে বলে মনে করা হলেও সরকারকে কাউকে ধরে শাস্তির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এরমধ্যে একদিন গুজব ছড়িয়ে লবণের বাজার অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালানো হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। তবে চালসহ অনেক নিত্যপণ্যেরই দাম উর্ধ্বমুখী। শীতকালীন সবজির দামও এখন আকাশছোঁয়া। বিশেষ করে পাইকারী ও খুচরা বাজারে সবজির দামের তারতম্য ক্রেতাদের ক্ষুব্ধ করে তুলছে। দেশে একটি শক্তিশালী কার্যকর এবং মানুষের আস্থাভাজন বিরোধী দল থাকলে সরকারের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া খুব সহজ হতো না।
সরকারের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ার আশায় আছে বিএনপি এবং তার সহযোগীরা। বিএনপির সিনিয়র নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের আলামত দেখতে পাচ্ছেন বলে বক্তৃতা করেছেন। তিনি কি আশা করছেন যে চুয়াত্তর আসলে পঁচাত্তরও আসবে? হ্যাঁ, আরেঠারে তেমন কথাও বলেন না তা নয়। এখানেই তাদের সমস্যা। তারা সবকিছুর মধ্যই সরকারের পতন দেখতে পায়! তারা ভুলে যায় যে, নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তনের পথে হাঁটলে তাদেরই সর্বনাশ হবে।
দেশে চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের পরিস্থিতি বা ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার কোনোই আশঙ্কা কিংবা সম্ভাবনা নেই। যতো কারসাজিই করা হোক না কেন, দেশে আর খাদ্য ঘাটতি হবে না। দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরি হবে না। দেশে এখন পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হয় এবং মওজুদ থাকে। কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে হলে যে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকা দরকার, তা-ও এখন নেই। বিএনপি-জামায়াত এবং সহযোগীরা শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যতোটা উদগ্রীব দেশ কিংবা দেশের বাইরে আর কারো সেটা নেই।
বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থেকে বহুবার সরকারবিরোধী আন্দোলনের সলতে পাকিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর অবস্থা হয়নি। এখনও সরকারের কিছু ভুল, কিছু দুর্বলতার কারণে কোথাও কোথাও কখনো অস্থিরতা দেখা দিলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের আছে। তবে সরকার পক্ষেরও সাবধান-সতর্কতার প্রয়োজন আছে। মনে রাখতে হবে, পঁচা শামুকেও পা কাটে। মানুষ কারো কাছেই বাড়াবাড়ি আশা করে না। বাড়াবাড়ি মানুষ পছন্দ করে না। শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ ধৈর্য ও সংবেদনশীলতার সঙ্গে দূর করতে সচেষ্ট থাকতে হবে। বাজারে নিত্য ব্যবহার্য দাম নিয়ে মুনাফাখোরীর অপচেষ্টাকারীদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। মানুষ কিসে খুশি হয়, কীসে অখুশি হয় – সেটা বোঝার ক্ষমতাও সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের থাকতে হবে। ভাত দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেই কিল মারাটা সহনীয় হয়। নচেৎ নয়।
দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান সফল হলে সরকারের নৈতিক ভিত্তি আরো মজবুত হবে। বিএনপি অস্থিরতা দেখাতে গেলে নিজেদের বিপদ বাড়াবে। সরকারের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি দৃশ্যমান না হলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মানুষ জীবনবাজি রেখে নামে না। শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো দেশ চালানোর মতো আর কেউ দেশে আছেন- এটা হাসিনাবিরোধীরাও বিশ্বাস করেন বলে মনে হয় না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
bibhu54@yahoo.com
এইচআর/এমকেএইচ