শিক্ষার আসল কাঠামো
সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র উপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন হয়ে গেল তার মধ্যে কিছু অযাচিত বিতর্কও হতে দেখলাম আমরা। অনেকেই বিতর্ককে নিয়ে গেছেন প্রাইভেট বনাম পাবলিক বিতর্কে, দু’একটি কথা এসেছে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে।
পাবলিক প্রাইভেট বিতর্কে একে অন্যের দোষ খোঁজার যে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন সেখানে আবেগ যত ছিল, খিস্তি যা ছিল, যুক্তি ছিল তার চেয়েও কম। এর মধ্যে এসেছে কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বতো দূরের কথা, দক্ষিণ এশিয়ার র্যাংকিং-এও নেই। নেই কারণ, আমরা এগুলোকে নষ্ট হতে দিয়েছি। অবহেলা, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি, আর তার সঙ্গে নোংরা রাজনীতির ঘুষোঘুষিতে পর্যুদস্ত আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ বিদ্যালয়, এবং সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বত্র এক নিদারুণ করুণ পরিবেশে আমাদের পাঠদান চলছে। আমরা কোনও রকমে টিকে আছি। আমাদের স্বপ্ন বিশ্বমানের পড়াশোনা, কিন্তু আমাদের চেষ্টা কেবল শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা। আর এসব করে কবে মান থেকে দূরে চলে গেছি তা জানিই না আমরা। কোনও মানই নেই যেখানে, সেখান থেকে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একেবারে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া যায় না।
স্বপ্ন যদি থাকে তাহলে চেষ্টাটা করতে হবে। রাজনীতি থেকে শিক্ষাকে সরিয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের কথা ভাবতে হবে। আর এজন্য দরকার গভীর অধ্যাবসায় এবং অসীম ধৈর্য। মূল ব্যাপার মানসিকতা, সামাজিক কাঠামো, বিশেষত দৃষ্টিভঙ্গির আপাদমস্তক পরিবর্তন। শিক্ষা যদি কেবল লড়াই করতে শেখায়, তাহলে সুকুমার হব কি করে আমরা?
আবার একথাও ঠিক যে, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। সমাজের বিশৃঙ্খলা এখানেও লাগে। সমাজ যদি উচ্ছৃঙ্খল হয়, অশিক্ষিত হয়, গুণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেয়, শিক্ষার্থীরাও সেদিকেই যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন রাজনীতি আছে, এবং একটু বেশিই আছে। শিক্ষার্থীরা যতটা করছে, তার চেয়ে বেশি করছে শিক্ষকরা। কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতা আছে কতটা তা এখন ভাববার সময়। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে শুধুই ক্যারিয়ারের রসায়ন। জীবনযুদ্ধের দামামা এখন এতো বেশি যে সমাজ নিয়ে ভাববার উদ্যম উৎসাহ থাকে না, থাকলেও তা দ্রুতই হারিয়ে যায়।
ধারণার পিঠেও ধারণা আছে। যে কথা সাধারণত ভাবা হয় যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মানে গরিবের সন্তানদের জায়গা আর প্রাইভেট মানেই ধনীর দুলাল-দুলালীদের আখড়া, তা এখন মস্ত বড় ভুল। গ্রামতো আছেই, শহরের অনেক পরিবারের অনেক সন্তানই অভাবের তাড়নায় বিদ্যালয়কে বিদায় জানিয়েই যে ভাবে হোক দু’পয়সা রোজগার করতে মাঠে নামে। গ্রামেই অভাবটা বেশি, কিন্তু সেই গ্রাম থেকেই কতনা ছেলে মেয়ে আসছে এই রঙিন শহরে। কতজনের স্বপ্ন উবে যায় বাষ্পের মত, কতজন টিকেও যায়। স্বপ্ন ভঙের বুকফাটা কাহিনি আমাদের শহরে ততটা নয়, যতটা গ্রামগঞ্জে। বলতে গেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তানরাই বেশি।
তবে, এখনো পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বের হলে শহরের উচ্ছল সব ধনী স্কুল কলেজের বাজনা বাদ্যের মাঝে দু’একটা গ্রাম গঞ্জের ছেলে মেয়েও জানান দেয় তারাও আছে সামনের কাতারে। এসব গামগঞ্জ থেকেও খবর আসে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার।
আগামী বাংলাদেশ যেমন শহরের ঝা চকচকে ছেলেমেয়রা গড়ছে, গড়ছে গ্রাম গঞ্জের বর্ণহীন তরুণ তরুণীরাও। হীরের টুকরা ছেলেমেয়ে ছড়িয়ে দেশের সব কোণে। কিন্তু বেশিরভাগই অভাবকে মোকাবেলা করতে, চারটি অন্ন জোগাড়ের আশায় চাকুরি নামক দাসত্বে নাম লেখায়, আর বাকিরা হারিয়ে যায় শহরের জঙ্গলে।
কিছুদিন আগে একটি কলেজের নবীর বরণ উৎসবে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আলাপ করার সময় কয়েকটি মেয়ে বলে শিক্ষকরা খুব গতানুগতিক ক্লাশ নেয়, ঠিকমতো ক্লাসে আসেওনা, বেশি নজর প্রাইভেট পড়ানোর দিকে। ক্লাশের পড়ানোতে কোনো উদ্যম নেই, উৎসাহ নেই, উচ্ছ্বাস নেই। উদ্যম আছে কেবল প্রাইভেট পড়ানোর দিকে। নগদ পয়সা যে!
প্রতিবছর বাজেট হয়, বলা হয় শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ। আমরা বলতে থাকি আমরা আরো বিশ্ববিদ্যালয় বানাব, আরো স্কুল করবো, গবেষণাগার তৈরি করবো। কথাগুলো শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু মানুষ তা বিশ্বাস করে না। এতো এতো পাবলিক আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, বেশুমার শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে, কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করছে, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র কি একবার ভাবে যারা স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ঝরে পড়ে তাদের কথা?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমন্ধে আমাদের গভীর ভাবে ভাববার সময় হয়েছে। এরাই তো এদেশকে গড়বে, এরাই তো শিক্ষার প্রথম সোপান। আমরা কেন অবহেলা করি, ফ্যাশনেবল নয় বলে? বিশ্বমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তখনই তৈরি হবে, যখন প্রতিষ্ঠানের প্রথম ইট শক্ত ও মজবুত হয়। উচ্চশিক্ষার ফাউন্ডেশন স্টোন যত্নের সঙ্গে, অধ্যবসায়ের সঙ্গে তৈরি না হলে উচ্চ শিক্ষায় গলদ হতে বাধ্য, শিক্ষার আসল কাঠামো ভেঙে যেতে বাধ্য।
এইচআর/এমএস