শিক্ষায় ভ্যাট, অর্থসন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়


প্রকাশিত: ০৩:১২ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি? কিসের ছাত্র, কিসের কী? ছেলেগুলো ইয়ো ইয়ো, সীসাবার, মেয়েগুলো তো সব ফ্রেঞ্চফ্রাই, বার্গার, কেএফসি, ককটেল, রুমডেট, বয়ফ্রেন্ড, ফ্রেন্ডের বাইক, লং ড্রাইভ- এইতো ছিল এতদিন, ধারণা আমাদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে। বাবা-মায়ের অঢেল টাকা, বড় লোকের গরুগাধা, লেখা নেই, পড়া নেই, লেখাপড়ার নামে হাওয়ার মতো টাকা উড়োচ্ছে। এতদিনের এই ধারণার গায়ে অন্তত হঠাৎ করে এক বিকট ধাক্কা লেগেছে। ধাক্কা তারা দিতে পেরেছে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। যে ধাক্কাটা খুব জরুরি ছিল, এতদিন ধরে।

অনেকেই বলতেন, মনে করতেন এই ছেলেমেয়েরা  মেধাবী নয়, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, রাজনীতি সচেতন নয়। এদের ‘কাউন্ট’ করার কিছু নেই। অন্তত দেশের রাজনীতি ভাবনায়। এরা এত ‘ইম্পর্ট্যান্ট’নয় বলে যারা ভাবতেন, তারাই এখন রীতিমতো নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের আন্দোলনে দেখে। তাই যদি না হবে, তবে কেন দফায় দফায় মোবাইলে সরকারি এসএমএস ‘বিদ্যমান টিউশন ফির মধ্যে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত থাকায় ভ্যাট পরিশোধ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের, ছাত্রদের নয়।’ একই বাণী গত কদিন ধরে দেশের সব টেলিভিশন স্ক্রলে সারাদিন প্রচারিত হচ্ছে।

পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আর কজন পড়ে? সুযোগ কোথায়? প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিই তো বরং বেশি সারাদেশে। খুব সহজ একটি হিসেব দিই। এ বছরই উচ্চমাধ্যমিকে সবচেয়ে কম পাশ করেছে, গত কয়েক বছরের মধ্যে। তারপরও সেই সংখ্যা ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭২ জন। সারাদেশে জিপিএ ৫-এর সংখ্যা ৭০ হাজার ৬০২ জন। বিপরীতে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, সব মিলিয়ে আসন সংখ্যা ৫০ হাজার প্রায়। অর্থ্যাৎ জিপিএ ৫ পাওয়া অর্ধেকেরই সুযোগ থাকছে না পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। বাকি এ প্লাস, এ মাইনাস, বি এদের কথা তো আলোচনাতেই আসে না। এরা কী ছাত্র না? ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৮শ ৭২জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি হতে হবে অন্য কোথাও, বাস্তবতা এটাই! ফলে এই বিপুল সংখ্যক ছাত্রদের আমলে আনতে হবে। কোনো সুযোগ নেই, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক কোনোভাবে ছোট করে দেখার।

তারপরও সরকার দলীয় কেউ কেউ এই আন্দোলনকে ভিন্নভাবে দেখবার প্রয়াস পাচ্ছেন। ফেসবুকে নানা ধরনের ছবি, মন্তব্য পোস্ট করছেন। কখনো কখনো  তা শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করে, রীতিমতো অশ্লীল। একজন লিখেছেন, রাস্তায় ভিআইপিদের জন্য ট্র্যাফিক জ্যাম হলে বা রাস্তা বন্ধ হলে আমরা বিরক্ত হই। এখন আন্দোলনকারীদের জন্য রাস্তা বন্ধ, যানজট। আমরা বিরক্ত হচ্ছি না কেন? এমন মন্তব্য, প্রশ্ন বরং বিরক্তিরই উদ্রেগ করে, কে বোঝাবে কাকে? ভিআইপি মুভমেন্টের জন্য ৩ ঘণ্টা আগে থেকে রাস্তা বন্ধ হওয়া আর ছাত্রদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, এই দুই পরিস্থিতি কী এক?

টেলিভিশন টকশোতে সরকার বিরোধী, সমালোচক হিসেবে পরিচিত ড. আসিফ নজরুল, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যানজটের কারণে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। তার হেঁটে যাবার ছবি তুলে, ছবিতে গোল চিহ্নিত করে, তিনি এই আন্দোলনের পেছনে রয়েছেন এমন প্রমাণ করতে চাওয়া হাস্যকর, অমূলক ও নেহাত নির্বুদ্ধিতা। “জয় বাংলা’ ভ্যাট সামলা”- তরুণদের এই ভ্যাট বিরোধী স্লোগানটিকে প্রচার করা হচ্ছে নেতিবাচকভাবে। কে বলেছে এই ছাত্ররা জয়বাংলা বিরোধী? বরং আমি তো বলব, এখানে ইতিবাচকতা আছে। এরা ‘জয় বাংলা’র শক্তি অর্জন করে, ভ্যাটের বিরোধিতা করছে। ‘মন পাবি, দেহ পাবি, ভ্যাট পাবি না’র- ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে অশ্লীল। ফেসবুকে আপত্তিকর, অরুচিকর মন্তব্যের ছড়াছড়ি। অথচ মেয়েটি মন ও দেহের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিভাবে বাক্যটি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা কতটা অসুস্থ্য, বিকারগ্রস্থ যে, আন্দোলনের স্লোগানকেও বিকৃত করছি, যৌনগন্ধ খুঁজছি।

খুব ভুল ধারণা, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মানেই ‘শুধু ব্যবসা’। প্রতিষ্ঠান গড়ার পেছনে কোনো মহৎ উদ্যোগ নেই, উদ্দেশ্য নেই। প্রাইভেট? ব্যক্তি মালিকানাধীন উদ্যোগ? তবেই জরুরি সেই প্রতিষ্ঠানটির টুটি চেপে ধরা। বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থী নয়, ভ্যাট দেবে প্রতিষ্ঠান। অথচ শিশুও বোঝে আজ নয় কাল, এই ভ্যাটের টাকা কোনো না কোনোভাবে গুণতে হবে শিক্ষার্থীকেই। বরং সরকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট অংক ভর্তুকি দিতে পারে, শিক্ষার প্রসার ও মানউন্নয়নে। তা না করে শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর করের বোঝা!

সরকারের ব্যর্থতার জন্য শিক্ষার্থী কেন বেশি মূল্য দিয়ে শিক্ষা নেবে আর কর দেবে? শিক্ষা যদি পণ্যই হয়ে থাকে, তবে সরকারি বেসরকারি সকল শিক্ষাই পণ্য। কেবল সরকারি পণ্যে কর নেই, বেসরকারি পণ্যে কর, এটি মূল্য সংযোজন করের নীতি বিরুদ্ধ। শিক্ষা খাতেই তো সরকারের সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দের কথা ছিল। দীর্ঘদিন ধরে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবি অনুযায়ী শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের ৮ ভাগ এবং জাতীয় বাজেটের ২৫ ভাগ বরাদ্দের কথা বলা হলেও হয়নি আদৌ। খুব ভুল ধারণা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানেই, টাকা উপচেপড়া লোকদের সন্তানদের বিদ্যাপিঠ। প্রচুর মানুষ আছেন মফস্বল থেকে, ধারদেনা করে, জমি বিক্রি বন্ধক রেখে সন্তানদের পড়ান প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। কারণ, সরকার অসমর্থ, ব্যর্থ সরকারি প্রতিষ্ঠানে সকলকে শিক্ষার সুযোগ দিতে ।

বলা হয়, সরকার উন্নত রাষ্ট্র চায়। শিক্ষিত মানুষ চায়, যারা নেতৃত্ব দিবে আগামী দিনের বাংলাদেশের। তাই যদি হয় তাহলে কোনটি বেশি প্রয়োজন? ব্রিজ, কালভার্ট, ফ্লাইওভার নাকি শিক্ষিত জনগণ? একটি ব্রিজের ওপর দিয়ে গাধা পার করা বেশি জরুরি নাকি শিক্ষিত মানুষ? তাই যদি হয় তবে শিক্ষাকে পণ্য এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাবা অন্যায়। শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর করের বোঝা অর্থ সন্ত্রাস ছাড়া আর কিছু নয়!

লেখক: সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র। ডিরেক্টর, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ।

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।