অস্থিরতা আর সংশয়ের আবহে শিক্ষা
শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে তিনি যা বলেছিলেন তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, তিনি জ্ঞানের অভাব নয়, তথ্যের অভাব বলতে চেয়েছিলেন। মন্ত্রিসভায় নতুন বেতন স্কেল অনুমোদনের পর একুশ লাখ সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও আধা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি যখন আহ্লাদিত, তখন অস্থির শিক্ষাঙ্গন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিরা টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেয়ায় আপত্তি তুলেছেন, তবে আন্দোলনে নেমেছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। টিউশন ফি’র উপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে রাজপথে আছে তারা। অষ্টম জাতীয় বেতনকাঠামোতে আমলাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য বেড়েছে এবং শিক্ষকদের মর্যাদাহানি হয়েছে বলে অনেকদিন থেকেই প্রতিবাদ করে আসছেন শিক্ষকরা। এরই মধ্যে মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শিক্ষকদের সম্পর্কে যা বলেছিলেন তা ছিল আগুনে ঘি ঢালার মতো। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, “দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছেন। তাঁদের কর্মবিরতির কোনো যুক্তি নেই। তাঁরা জানেনই না যে নতুন বেতনকাঠামোতে তাঁদের জন্য কী আছে, কী নেই”।
যাই হোক, অর্থমন্ত্রী বৃহষ্পতিবার সিলেটে এক সংবাদ সম্মেলন করে এই বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানালেন, তিনি জানাতে চেয়েছিলেন যে শিক্ষকরা তথ্যের অভাবে আন্দোলন করছেন।
তিনি আরো বলেছিলেন “বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের করাপ্ট প্র্যাকটিস নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। প্রত্যেকেই এখানে সহজেই অধ্যাপক হয়ে যান। সহযোগী অধ্যাপকদের তাঁরা খেয়াল খুশিমতো পদোন্নতি দেন। দেখা গেছে, নিচে ১০ জন প্রভাষক; কিন্তু ওপরে এক হাজার অধ্যাপক। এটা কিছু হলো? শুধু ওপরে পদোন্নতি হবে, এটা ঠিক না”। অর্থমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের একটা একাডেমিক আলোচনা হতেই পারে। তবে শিক্ষকদের পদোন্নতিকে ঘিরে তিনি যখন দুর্নীতির কথা বলেন, তখন তার কি কখনো মাথায় আসে যে, তিনি অর্থমন্ত্রী থাকা অবস্থায় লোপাট হয়ে গেল বেসিক ব্যাংক? এই তিনিই প্রায় চার হাজার কোটি টাকার হল-মার্ক কেলেঙ্কারিকে কিছুই মনে করেন না বলে বলেছিলেন! শুধু তাই নয়, তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির কথা বলছেন, সেই তিনি কি একবার মাথা ঘামিয়েছেন, আমলতন্ত্রে বিরাজমান দুর্নীতির সংস্কৃতি নিয়ে?
এবারের পে-স্কেলে আমলাস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। যিনি কমিশন প্রধান হয়েছিলেন তিনি একজন সাবেক আমলা, অর্থমন্ত্রী নিজেও সাবেক আমলা। তাই আমলাতন্ত্রের পক্ষে কথা বেশি উচ্চারিত হচ্ছে।
তবে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের কিছু অংশকে মূল্যায়ণ করতে পারেন শিক্ষকরা। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্থ। শুধু কি পদোন্নতি ব্যবস্থা?, নিয়োগ প্রক্রিয়া নয় কী? এখন কতজন শিক্ষক নিয়োগ হয়, আর কতজন ভোটার নিয়োগ হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে? তারা কিভাবে কোন বিবেচনায় নিয়োগ পায় এসবতো এখন অনেক মুখরোচক গল্প নাগরিক সমাজে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন একাধিক চাকুরি করেন এবং সেটা করেন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজটি অবহেলা করে। হয়তো সবাই নয়, কিন্তু অনেকেই। এমনকি বাইরে ফুলটাইম জব করছেন অনেকে? রাজনৈতিক দলের পদ আছে অনেকের। শিক্ষকদের পদ-পদবী পাওয়া, পদোন্নতি, পুরোটাই হয় রারজনৈতিক বিবেচনায়, একাডেমিক সাফল্য বিবেচনায় নয়।
আর একটি বিষয় মাথায় আসলোনা শিক্ষকরাইবা কেন পে-স্কেলের আন্দোলনে সচিব, যুগ্ন-সচিবদের সাথে নিজেদের মর্যাদার তুলনা করছেন?
যে ধারণাটা প্রচলিত, সবচেয়ে বেশি মেধাবীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয় তাও এখন কতটা সত্য? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথম শ্রেণি দেয়া নিয়ে ভূরি ভূরি কেলেংকারির অভিযোগ আছে। আবার সেই মেধাবী আর জ্ঞানীরাই কিন্তু ঘাট শ্রমিকদের মতো উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনের নামে মাসের পর মাস ক্লাশ পরীক্ষা বন্ধ রাখেন। আবার এসব জ্ঞানীরাই জোর করে উপাচার্য গদিতে বসে থাকেন যখন তার সহকর্মিরা বা ছাত্রছাত্রীরা তাদের সে পদে দেখতে চায় না!
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ, যিনি নিজেও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তার এক লেখায় লিখেছেন, “উপাচার্য থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে নিয়োগ এখন এতই দলীয় ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় যে মেধা বা যোগ্যতার প্রশ্ন অনেক নিচে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কিংবা তাঁদের অভিভাবকদের উদ্বেগের বিষয় এখন দুটি: ১. নিরাপদে সময়মতো পাঠ সম্পন্ন করা। ২. নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া। এই দুই ক্ষেত্রেই এখন বহুবিধ জট তৈরি হয়েছে, এর পেছনে ওপরের কারণগুলোই”।
মর্যাদার প্রশ্নে তিনি বলছেন, “মর্যাদা উদ্ধার বা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমত, সর্বজনের কাছে জবাবদিহির প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে শিক্ষকেরা কিঞ্চিৎ সুবিধা পাওয়ার জন্য সন্ত্রাসী বাহিনীর কোলে আশ্রয় নেন, কিংবা সচিবালয়ে গিয়ে আমলাদের সামনে হাত কচলান, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের আধিপত্য দূর করতে হবে। আর তৃতীয়ত, নিজেদের সম্মান দিতে জানতে হবে। সমাজ শিক্ষককে অনেক ওপরে স্থান দেয়। সেখানে শিক্ষক যদি নিজেকে সম্মান করতে না পারেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যদি নিজেদের অধ্যাপক, উপাচার্য এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারপারসনের চেয়ে ‘মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন’ বলায় বেশি গৌরববোধ করেন, তবে তাঁদের সম্মান কেউ রক্ষা করতে পারবে না”।
এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে শিক্ষকদের। হয়তো সব শিক্ষক এমনটা করছেন না, হয়তো অল্পসংখ্যকই করছেন, কিন্তু এরাই সমাজে শিক্ষকদের সম্পর্কে ধারণা তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো আন্দোলনে আছেন সরকারি কলেজ শিক্ষকরাও।
শিক্ষকদের মর্যাদা আর বেতন কাঠামোকে দেখতে হবে বেতন কমিশনের বাইরে থেকে। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দীর্ঘদিনের দাবি। ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে আওয়ামীলীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছিল তাতে পরিষ্কারভাবে বলা ছিল এই স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের কথা। অর্থমন্ত্রী এখন বলেছেন, এটা দেয়া সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো তাহলে নির্বাচনী ইশতেহারে তা বলা হলো কেন? শিক্ষকদের জন্য জাতীয় বেতন স্কেলের বাইরে, প্রয়োজনে উচ্চতর স্কেল দেয়া খুব কঠিন কাজ হবে বলে মনে হয় না। তবে এক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি, পদ-পদবী বিতরণে যে বিশাল দুর্নীতির বিস্তার আর রাজনীতি ঢুকেছে তা দূর করাও সময়ের দাবি।
শিক্ষকদের এমন আন্দোলনের মাঝেই বৃহষ্পতিবার সারাদেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছিল টিউশন ফি’র উপর ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে। দিনভর অচল ছিল রাজধানী। তবে বিকেলে অর্থমন্ত্রী, রাজস্ব বোর্ড আর রাতে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে সংশয় কমার সম্ভাবনা কতটুকু তা সময়ই বলবে। তারা বলছেন, ভ্যাট দিবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষার্থীরা নয়। দু’একটি বিশ্ববিদ্যালয় এতে সম্মতিও জানিয়েছে। প্রশ্ন হলো, কর্তৃপক্ষ এই ভ্যাট দিয়ে যখন টিউশন ফি বাড়িয়ে দিবে তখন, তা ঠেকাতে পারবে কি সরকার? আর ভ্যাট এর নিয়ম অনুযায়ী তা পরিশোধ করবে গ্রাহক। এখানে গ্রাহক শিক্ষার্থীরা। তবে কি এখন থেকে দোকানে গিয়ে মিষ্টি কিনে আমরা দোকানিদের বলবো ভ্যাটটা তারাই যেন দেয়?
এইচআর/এমএস