বাংলাদেশ ক্রিকেটে ড. জেকিল এন্ড মি. হাইড
মাত্র কিছুদিন আগে রাজন-রাকিব এই দুই শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে মানুষ। ওই সময় শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড হাতে প্রতিবাদ জানান বাংলাদেশ টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। এর মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মুশফিকেরই সতীর্থ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পেস বোলার শাহাদাত হোসেন রাজিব শিশু নির্যাতন করে পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম। বাসার বাচ্চা গৃহকর্মীকে অকথ্য নির্যাতন করেছেন শাহাদাত ও তার স্ত্রী দুজনে মিলে। ওই শিশুটির অপরাধ সুজী রান্না কেন ঠিকমত হয়নি। ওই শিশু গৃহকর্মীর ভাষ্য মতে, শারীরিকভাবে তাকে নির্যাতন করাটা শাহাদাত দম্পতির প্রাত্যহিক রুটিন।
হ্যাপি নামের বাচ্চা এই মেয়েটিকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। সমালোচনার ঝড় ওঠে স্যোশাল মিডিয়াতে। নড়ে চড়ে বসে আইনী সংস্থা। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বাসা তালাবদ্ধ করে পুরো পরিবারসহ গা ঢাকা দিয়েছেন শাহাদাত। তবে তৎপরতা থেমে নেই শাহাদাতের পরিবারের। তার বাবা -মা ঘোরাঘুরি করছেন বিসিবিতে। শিশু নির্যাতনের জন্য রাষ্ট্রীয় আইনে যে শাস্তি তা এড়ানোর জন্যই শাহাদাতের পরিবারের যে বিসিবিতে দৌড়ঝাপ সেটা অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। বিসিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই পেস বোলারের পরিবারের লোকজন বলার চেষ্টা করছে যে, তাদের কৃতি সন্তানকে(!) যতটা খারাপভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে শাহাদাত ততটা খারাপ নয়। এই ঘটনায় তারা বিব্রত এখন পর্যন্ত শুধু এটুকুই জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট শাসক সংস্থা বিসিবি।
শাহাদাতের পরিবার ধরেই নিচ্ছে যে তাদের সন্তানকে বাঁচাতে পারবে বিসিবি। বিশ্বকাপের আগে নারী নির্যাতন মামলায় জেল হাজত থেকে রুবেল হোসেনকে দ্রুত বের করে আনার জন্য বিসিবির তৎপরতা হয়তোবা উৎসাহিত করে থাকতে পারে শাহাদাতের পরিবারকে। ক্রিকেটারদের সঙ্গে মডেল-চিত্রনায়িকাদের রোমাঞ্চ কিংবা এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশান কোনো নতুন ঘটনা নয়। এছাড়া চিত্রনায়িকা হ্যাপি প্রাপ্তবয়স্ক। তারপরও নৈতিকতার প্রশ্নটা থেকেই যায়। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে বৃহত্তর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই রুবেলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল বিসিবি। বাংলাদেশ ক্রিকেট অভিভাবকের নিরঙ্কুশ সমর্থন না থাকলে রুবেল যে এত দ্রুত মাঠে ফিরতে পারতেন না এটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেকে বলতেই পারেন, ক্রিকেট অভিভাবক হিসাবে ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়ানো বিসিবির দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। স্বভাবতই প্রশ্নটা এসেই যায় যে ক্রিকেটারদের অপরাধ সমূহের দায়ও তাহলে বিসিবির ওপরই বর্তায়।
ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা (জেন্টলম্যান্স গেম)। তবে ভদ্রলোকের খেলা বিবেচিত ক্রিকেটে অনেক নেতিবাচক অনুষঙ্গই দেখতে হচ্ছে ক্রীড়াপ্রেমীদের। টাকার বিনিময়ে ক্রিকেটারদের ম্যাচ ছেড়ে দেয়া, ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিং এগুলো এখন ক্রিকেটের নিত্য অনুষঙ্গ। সঙ্গে ডোপ টেস্ট আর নারী কেলেঙ্কারি তো আছেই। কিন্তু বাসায় গৃহকর্মীকে নির্যাতন এমনটা বোধকরি ক্রিকেটে এই প্রথমবারের মত ঘটলো। আর এর সঙ্গে শাহাদাত হোসেনের কল্যাণে এই ঘৃণ্য কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল বাংলাদেশের নামও। ক্রিকেটে নেতিবাচক বিষয়গুলো থেকে রক্ষা পেতে আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচিও নিচ্ছে প্রায় সব দেশের বোর্ডগুলো। ক্রিকেটারদের মননে অনুশোচনা-অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য হাতে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রিহ্যাব প্রোগ্রাম। এই প্রক্রিয়ার বাইরে নয় বিসিবিও। যেমন রিহ্যাব প্রোগ্রামে অংশ নিতে হবে বিপিএলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য নিষিদ্ধ বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুলকেও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিশ্ব সেরা দলগুলোর সঙ্গে মাঠের লড়াইয়ে হাড্ডহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। স্বভাবতই আমরা ধরেই নেব যে ক্রিকেটারদের জন্য বিসিবির নেয়া সব প্রোগ্রামগুলোই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেটাররা এদেশে সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটি। স্বভাবতই বিসিবির কাছ থেকে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বটাই সবার প্রত্যাশিত।
শাহাদাত হোসেনের সাম্প্রতিক কাণ্ডে বিসিবির পেশাদারিত্বের এই জায়গাটা প্রশ্নবিদ্ধ। রুবেল কাণ্ডের পর কেন আরও বেশি সচেতন হয়নি বাংলাদেশে ক্রিকেট কর্ণধারেরা। ক্রিকেটারদের জন্য মনোবিদ আছে, মেডিটেশনের ব্যবস্থা আছে, কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এটা নতুন করে বলার প্রয়োজন নাই যে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অ্যাম্বেসেডর আমাদের ক্রিকেটাররা। আরও সহজ করে ক্রিকেটারদের ভাল ও মন্দ কাজের সঙ্গে আমাদের দেশের মান-সম্মান জড়িত প্রত্যক্ষভাবে। আর তাই আমাদের ক্রিকেটারদের পদস্খলন মানে পুরো দেশের মান সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। স্বভাবতই আশরাফুল-রুবেল কাণ্ডের দায়ভার এসে বর্তায় ১৬ কোটি মানুষের ওপর, সর্বোপরি পুরো বাংলাদেশের ওপর। এদেশের ১৬ কোটি মানুষের সবচেয়ে বড় আবেগ ক্রিকেটকে ঘিরেই। আর বাংলাদেশ ক্রিকেট তথা ক্রিকেটারদের দেখভালের দায়িত্ব বিসিবির। এই গুরু দায়িত্বের মূল্য আমাদের ক্রিকেটের কর্ণধাররা কতটুকু অুনধাবন করেন আমরা নিশ্চিত নই। ক্রিকেটাররা কোনো অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়লে, আইনী প্রক্রিয়া যথাযথ অনুসরণ করা হবে, আমরা বিব্রত কিংবা আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে- এসব ভাঙা রেকর্ড বাজানোর মধ্যেই যদি বিসিবি তাদের দায়িত্ব সীমিত রাখে তাহলে বলার কিছুই নাই।
আমাদের সমাজে অস্থিরতা আছে। শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতন এখানে নিত্য নৈমিত্ত্যিক ঘটনা। দুর্ণীতি আষ্টে পৃষ্টে জড়িয়ে আছে আমাদের সমাজে। আর এই প্রসঙ্গগুলো টেনে ক্রিকেটাররাও এ সমাজের বিচ্ছিন্ন নন, আমাদের সামজীকরণের প্রতিফলন ক্রিকেটারদের ওপর পড়তেই পারে- এভাবে দার্শনিক সুলভ অনুসিদ্ধান্ত টানার কোনো সুযোগ নাই। কেন না মহল্লার একজন মাস্তান আর ক্রিকেটারদের পরিবেশের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। মহল্লার মাস্তান আর ক্রিকেটারদের আচরণের পার্থক্যটা ধরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করার জন্যই তো বিসিবি। দুদিন আগে শাহাদাত কাণ্ডের পর ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেখলাম। ওই স্ট্যাটাসে লেখা হয়েছে, ভারতের ছিন্নমূল শিশুদের জন্য স্টিভ ওয়াহ ওরফানেজ প্রতিষ্ঠিত করেছেন আর আমাদের ক্রিকেটার শিশু গৃহকর্মীকে মারধর করেন নির্দয়ভাবে।
মানুষের ভেতরের সুপ্রবৃত্তি আর কুপ্রবৃত্তি নিয়ে বিখ্যাত লেখক আর এল (রবার্ট লুইস) স্টিভেনসন লিখেছেন, তার অমর সাহিত্যকর্ম ‘ড. জেকিল এন্ড মি. হাইড’। মানুষের ভেতরে সু ও কু দুটো প্রবৃত্তিই থাকে, এটাই নির্মোহ দার্শনিকতায় তুলে এনেছেন স্টিভেনসন। বাংলাদেশ ক্রিকেটকে যদি আমরা একটা একক ইউনিট ধরি তাহলে ‘ড. জেকিল এন্ড মি. হাইড’ সাহিত্য কর্মটিই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এখানে মুশফিক-মাশরাফিরা শিশু নির্যাতনের জন্য প্রতিবাদ করেন। ‘সে নো টু অ্যাবিউজ কিডস’ সংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ান মুশফিক আর একই দলের শাহাদাত সভ্যতা ভব্যতা ভুলে নির্দয়ভাবে প্রহার করেন একজন শিশুকে।
এইচআর/এমএস